(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
রওজা পাকে সালাম দিতে এবং রিয়াজুল জান্নাতে নামাজ পড়তে বিশেষ অনুমতি লাগবে। এতে টেনশনের কিছু নেই। সৌদি ওমরাহ এজেন্টের লোকজন ও দেশীয় কাফেলা এজেন্সীর লোকজন সহায়তার হাত বাড়ায়। গোল্ডেন হজ্ব কাফেলার মালিক ইদ্রিস সাহেব বারে বারে অনুমতির ব্যবস্থা করেন। ফলে আমাদের পক্ষে কয়েক বার করে রিয়াজুল জান্নাতে প্রবেশ করার সৌভাগ্য হয়। রিয়াজুল জান্নাতে ৮/১০ মিনিট সময় দেয়ার পর সকলে দক্ষিণ দিকে গিয়ে রওজা পাকে সালাম দিয়ে পূর্ব দিকে বেরিয়ে যায়। বিশেষ অনুমতি প্রাপ্তগণকে চেক করে তুর্কি হেরেমে গ্রুপ গ্রুপ করে বসায়। এক এক গ্রুপে ৮০ থেকে ১০০ জন। তেমনিভাবে গ্রুপ গ্রুপ করে রিয়াজুল জান্নাতে নিয়ে যায়। অতঃপর রওজা পাকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে যায়।
পবিত্র মসজিদে নববী ও রওজা পাকে সৌদি কর্তৃপক্ষের শৃংখলা রক্ষায় প্রচেষ্টা, কষ্ট স্বীকার আমাকে অভিভূত করে। ইদ্রিস সাহেবের সহযোগিতায় আমরা বারে বারে অনুমতি প্রাপ্ত হয়ে রিয়াজুল জান্নাতে গমন এবং রওজা পাকে সালাম দেয়ার পরম সৌভাগ্য লাভ করি।
বাংলাদেশ বিমান ৬ অক্টোবর ঢাকা থেকে পবিত্র মদিনা ফ্লাইট চালু করে। অপরদিকে চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে জেদ্দার ফ্লাইট ত আছেই। পবিত্র মদিনায় দেশীয় শত শত ওমরাহ যাত্রী দেখা যায়। প্রায় সকলে ১০ থেকে ১৪ দিনের প্যাকেজে,যদিও ওমরাহ ভিসা এক মাসের। অনেক টাকা খরচ করে যাওয়া হয়। ইচ্ছা করলে ভিসা অনুপাতে বেশি দিন থাকা যায়।
সৌদি সরকার ১৭ অক্টোবর থেকে ২ পবিত্র মসজিদে সামাজিক দূরত্ব তুলে দেয়। ফলে পবিত্র মদিনায় ফজরের জামাআত নামাজির ব্যাপক উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করি। সাথে সাথে রওজা পাকে পূর্ব অনুমতিও প্রত্যাহার করা হয়। এতে আমাদের অনুমতি থাকলেও হাজারের অধিক লোক শৃংখলাভাবে লাইনে লাইনে গিয়ে রওজা পাকে সালাম প্রদান করতে থাকেন।
আজ ১৭ অক্টোবর সকালবেলা পবিত্র মক্কা রওনা হওয়ার প্রোগ্রাম। সৌদি ওমরাহ এজেন্ট সহযোগিতা করতেছে। সাথে আল হেরার স্নেহের মোরশেদ ত আছেই। মোরশেদ বেশ কিছু ওমরাহ যাত্রী নিয়ে ১৩ তারিখ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে বিমানের ফ্লাইটে সরাসরি মদিনা শরীফ যায়।
মিকাত মসজিদে এহরাম কাপড় পরিধান না করে টয়লেটে পরিধান করতে হয় যা অনেকটা সৌদি নির্দেশ বলা যাবে। আমরা সকাল ১০ টার দিকে হোটেলে এহরাম পরিধান করে পবিত্র মক্কার উদ্দেশ্যে যুল হুলায়ফা মিকাত মসজিদে চলে আসি। এখানে ওমরাহ এর নিয়ত করে পবিত্র মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হই।
সৌদি ওমরাহ এজেন্টের বাঙ্গালী প্রধান জাফর সাহেব আমরা ২ জনের দুপুর ৩ টা থেকে ৬ টা ওমরাহ করার অনুমতি নিয়ে রাখেন। আমরা পবিত্র মক্কা পৌঁছতে দুপুর ৩ টা পার হয়ে যায়। আমাদের হোটেল হল সাবেক ঐরষঃড়হ বর্তমান গড়শশধয ঐড়ঃবষ ্ ঞড়বিৎং যাকে স্থানীয় ভাষায় শরীকা মক্কা বলা হয়। এখানে ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে রেডি হয়ে আমরা উভয়ে ওমরাহ করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। বুঝতে পারলাম ওমরাহ করতে যেতে অনুমতি ও যাচাই বাছাই কড়াকড়ি রয়েছে।
আমরা সূর্যাস্তের আগে আগে মাতাফে প্রবেশ করি ও তাওয়াফ শুরু করে দিই। সমাগম যেহেতু খুবই কম ২০/২৫ মিনিটে তাওয়াফ হয়ে গেল। মাতাফে মাগরিবের জামাআত পড়ার অপেক্ষায় থাকি। মাগরিবের জামাআত, সুন্নত ও ওয়াজিব তাওয়াফ নামাজ পড়ে আমরা সা’য়ী করতে যাই। সা’য়ী শেষ হলে ওখানেই আমরা এশারের মূল জামাআত পড়ি। অতঃপর সেলুনে গিয়ে চুল ফেলে ওমরাহ আহকাম শেষ করি। আমাদের মাজহাব মতে ওমরাহ এর ২ ফরজ, ২ ওয়াজিব। ফরজ: এহরাম পরিধান ও তাওয়াফ। ওয়াজিব: সা’য়ী ও মাথা মুন্ডন বা চুল কাটা। হোটেলে ওমরাহ এজেন্ট প্রতিনিধি হাতে বেল্ট লাগিয়ে দেয়। পবিত্র মদিনায় ৫ ওয়াক্ত নামাজে মোবাইলে ঞধধিশশধষহধ অঢ়ঢ়ং দেখাতে হত। মসজিদুল হারমে হাতের বেল্ট দেখলে হয়ে যায়।
মসজিদুল হারমে দু’তলা ও ছাদ জামাআতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার জন্য উম্মুক্ত। জায়গা অনুপাতে সমাগম কম, চাপ ত নয়,বরং জায়গা খালি থাকে। পবিত্র মক্কায় এসে বড় প্রতিকূলতা করোনার কারণে তাওয়াফ করতে মাতাফে যেতে না পারা। করোনার কারণে নিয়ম নীতি মেনে মনকে সান্তনা দেয়া ছাড়া গন্ত্যতর ছিল না।
২৬ তারিখ দিবাগত রাত জেদ্দা থেকে চট্টগ্রাম আমাদের ফ্লাইট। স্নেহের মোরশেদ সৌদি ওমরাহ এজেন্সীর সাথে যোগাযোগ করে ২৪ তারিখ আমাদের জন্য সন্ধ্যা ৬ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত ওমরাহ অনুমতি নিয়ে রাখে। সাথে তিনিসহ তার কাফেলার অন্যান্য সদস্যরাও। যা আমাদের মোবাইলের যিধঃংধঢ়ঢ় এ অনুমতি পত্র পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমরা ২ জন যোহরের নামাজের পর পর টেক্সী নিয়ে হুদুদে হারমের বাইরে জুরানা মসজিদে চলে যাই। যা পূর্ব দিকে ২৪/২৫ কি.মি দূরত্বে। সৌদিতে এখান থেকে ওমরাহ করাকে মিকাত হিসেবে গন্য করে থাকে। বাংলাদেশী টেক্সীচালক আমাদের পেয়ে তার আন্তরিকতা প্রকাশ করছিল। আমরা এখান থেকে এহরাম পরে হোটেলে চলে আসি ও দুপুরের খাবার খেয়ে নিই। হোটেল কর্তৃপক্ষ ভাড়ার ভিতর সকালে আমাদের ঈড়সঢ়ষবসবহঃধৎু নৎবধশভধংঃ প্রদান করে। পবিত্র মদিনায়ও হোটেলে ঈড়সঢ়ষবসবহঃধৎু নৎবধশভধংঃ দেয়া হয়। দুপুর ও রাতের খাবার আল হেরা কাফেলা প্রতিনিধি প্যাকেট করে পাঠিয়ে দেয়। আবহাওয়া মনোরম; শীতও নয়, গরমও নয়।
মাগরিবের আগে ওমরাহর উদ্দেশ্যে মাতাফের দিকে যেতে অত্যধিক কড়াকড়িতে পড়ি। তারা মোবাইলে যিধঃংধঢ়ঢ় এ ওমরাহর অনুমতি গ্রহণ করতে চাচ্ছে না। সৌদি ওমরাহ প্রতিনিধির উপস্থিতি চাচ্ছে। একাধিক বার প্রচেষ্টার পর মাগরিবের আজানের কয়েক মিনিট আগে আমরা মাতাফে পৌঁছতে পেরে টেনশনমুক্ত হলাম। মাগরিবের নামাজের পর তাওয়াফ শুরু করলাম। তাওয়াফ করে ওয়াজিবের নামাজ পড়ে আবারও তাওয়াফ করলাম। হজ্বে বিদায়ী তাওয়াফ ওয়াজিব হলেও ওমরাহর ক্ষেত্রে নয়। তারপরও আমরা আরেকটি তাওয়াফ করলাম। মাতাফ অনুপাতে তাওয়াফকারী কম বিধায় ২০ মিনিট মত সময় লাগছে। অতঃপর মাতাফে এশারের জামাআত পড়লাম। এশারের নামাজের পর দেখতেছি অনেকে সা’য়ীর দিকে না গিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। এতে শুনা কথার সত্যতা দেখতে পেলাম। অর্থাৎ এহরামের কাপড় পরিধান করে মোবাইলে ভূয়া অনুমতি পত্র দেখিয়ে অসংখ্য মানুষ তাওয়াফ করতে যাচ্ছেন। ইসলাম ধর্ম মতে এভাবে তাওয়াফ করা কতটুকু গ্রহণযোগ্য সম্মানিত পাঠক মহল ভাববেন আশা করি। এশারের নামাজের পর আমরা সা’য়ী করতে চলে গেলাম। সা’য়ীতে সমাগম আছে, চাপ নেই। অতঃপর সেলুনে গিয়ে মাথা মুন্ডন করলাম।
আজ ২৪ তারিখ দিবাগত রাত সৌদি এজেন্সী প্রতিনিধি ফোন করল, কাল সকাল ৮ টার দিকে আল হেরার হাজীগণ যেখানে থাকে সেখানে আমাদের ২ জনকে নিয়ে যাবে করোনা পরীক্ষা করানোর জন্য। সকালবেলা নাস্তার পর ঘুমাবার প্রধান টাইম, কিন্তু অসময়ে কি করা। সৌদি ওমরাহ প্রতিনিধি আমরা ২ জনকে আল হেরার অবস্থান করা কাফেলা ঘরে নিয়ে গেল, কিছুক্ষণের ব্যবধানে সৌদি হাসপাতাল থেকে লোক আসল। করোনা পরীক্ষা করার জন্য আমরা ২ জনের মুখের লালা নিল। অতঃপর কাফেলার অপরাপরগণের মুখের লালা নিবে। আমরা হোটেলে ফিরে গেলাম ঘুমানোর জন্য। পরদিন অর্থাৎ নির্ধারিত ফ্লাইটের দিন আসরের পর সৌদি ওমরাহ প্রতিনিধি করোনা রিপোর্টসহ গাড়ি নিয়ে আসবে বলল। কিন্তু আসতে আসতে গাড়ি ছাড়তে দেরি হল। আমরা দু’জন বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম। বিমান বন্দরে মাগরিবের নামাজ পড়লাম। বাঁশখালী গুনাগরীর মুবিন লাগেজ উঠানামায় সহযোগিতা করেন আমরা ২ জন বয়স্ক বিধায়। বিমান বন্দর ফাঁকা, যাত্রী খুবই কম। এখানে বিভিন্ন কাউন্টারে কোভিড পরীক্ষার সনদের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি। বিমান বন্দরে এশার জামাআত পড়তে কষ্ট হচ্ছিল অত্যধিক ঠান্ডা বিধায়। অর্থাৎ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়। তেমনিভাবে বিমানের দেয়া লাউঞ্চে অত্যধিক ঠান্ডা যা আমার কাছে অসহনীয়।
আমাদের ফ্লাইট রাত ১২ টা ৩০ মিনিটের স্থলে বিলম্ব হয়ে ১ টা ৫০ মিনিটে হল। জেদ্দা থেকে চট্টগ্রাম আসতে ইড়বরহম-৭৭৭ বিজসেন ক্লাসে আমরা যাত্রী মাত্র ৫ জন। আমরা ২ জন ওযু করে উঠি। বিমান বালাকে বললাম আমরা ফজরের নামাজ পড়েই খাবার খাব। প্রায় ২ ঘণ্টা পর সৌদি সময় ভোর রাত ৪ টা বাংলাদেশ সময় সকাল ৭ টায় সুবহে সাদেক হলে আমরা ২ জন ফজরের নামাজ পড়ে নিই। অতঃপর বিমানবালা আমাদেরকে খাবার দিল। তাদের খাবারের মান খুবই দুর্বল। যা অগ্রহণযোগ্য ও পরিতাপের বিষয়। আমরা কিছুটা বিলম্বে বেলা ১১ টার দিকে চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে অবতরণ করি।
করোনা মহামারীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সৌদি নিয়ম নীতি মেনে ওমরাহ ও যেয়ারত করতেছেন। করোনার আগে মধ্যবিত্ত ব্যক্তিরা ৮০-৯০ হাজার টাকা দিয়ে ১২-১৪ দিন থেকে ওমরাহ ও যেয়ারত করে এসেছেন। এখন বিমান ভাড়া বেড়ে গেছে। দুই পবিত্র নগরীতে হোটেলের প্রতি কক্ষে ২ জন করে থাকবে। ফলে ওমরাহযাত্রীদের ব্যয় বেড়ে গেছে। একাধিক ওমরাহকারীদের সাথে আলাপে জানতে পারি ১২-১৩ দিনের প্যাকেজে তাদের কমপক্ষে ১ লাখ ৩৫-৪০ হাজার মত গেছে। অধিকাংশ ওমরাহ যাত্রী ১৪ দিনের প্যাকেজে ১ লাখ ৪০ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা প্রদান করেন।সৌদি সরকার করোনার বিধি নিষেধ কমিয়ে সহজ করতেছে। এখন করোনায় বড় বাধা কাবা শরীফে নফল তাওয়াফ করতে না পারা। সৌদি কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে এ বাধা উঠিয়ে নিয়েছে বা নিবে। মহান আল্লাহ পাক ওমরাহ ও যেয়ারতকারীগণের সফর কবুল করুক।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট