জাফর আহমদ : অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা ও সরল রাজনীতিবিদ

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | বুধবার , ১০ নভেম্বর, ২০২১ at ৫:১১ পূর্বাহ্ণ

সেটা ছিলো ছাত্রদের যুগ; আরো সঠিক করে বলতে গেলে বলতে হয়, ছাত্র রাজনীতির যুগ। বায়ান্ন সালেও মাতৃভাষার দাবিতে ছাত্র আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু ষাটের দশকের ন্যায় ছাত্র আন্দোলনের এমন জঙ্গীরূপ পূর্ববঙ্গের ইতিহাসে আর কখনো দেখা যায়নি। বাষট্টিতে শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে ছাত্র বিস্ফোরণের পর ছাত্র আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। চৌষট্টিতে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রকাশিত হলে ছাত্র আন্দোলন আরো প্রবল আকার ধারণ করে। আন্দোলনের অভিঘাতে দেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ছাত্র-জনতার পদভারে রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।। মিছিলের পর মিছিল আছড়ে পড়ছিলো। তাদের কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত স্লোগান যেন আগুনের ফুলকি হয়ে আকাশে বাতাসে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিলো।
সিটি কলেজ তখন আন্দোলনের দুর্গ, ছাত্রলীগের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। মৌলভী সৈয়দ, মহিউদ্দিন চৌধুরী, আশরাফ খান, ইদরিস আলম, কিবরিয়া (পরে বাংলা ছাত্রলীগে চলে যান), বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের মন্ত্রী ও চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জহুর আহমদ চৌধুরীর পুত্র সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, মোহাম্মদ ইদ্রিস, হাজি কামাল, সাইফুল, জাহেদ, জাহাঙ্গীর চৌধুরী, জাফর আহমদ, কাজী ইনামুল হক দানু, খালেকুজ্জামান-এমনি আরো অনেক নেতা সিটি কলেজে ছাত্রলীগকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। কিবরিয়া বাংলা ছাত্রলীগ করা জন্য সিটি কলেজে মিটিং করতে গেলে তাকে যারা প্রতিহত করেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জাফর। কিবরিয়ার হামলায় সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী আহত হন।
ছাত্র-জনতার বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করার কারণে ছাত্র সমাজ জনগণের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলো। আরো দুটি কারণে ছাত্ররা জনগণের আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলো। প্রথমত তখন বাঙালি-বিহারী বিরোধ দানা বেঁধে উঠছিলো। বিহারীর ছেলেরা সবখানে দাপট দেখাতে চাইতো। যে কারণে বাঙালি ছেলেরা তাদেরকে টেক্কা দিতে পারলে মানুষ খুশি হতো। বাঙালি ছাত্রদের কাছে বাংলার জনগণের প্রত্যাশ ছিলো যে, তারা বিহারীর ছেলেদের সঙ্গে মারামারিতে যেন উচিত শিক্ষা দেয়। দ্বিতীয়ত আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দেয়ার পর সেই কর্মসূচি ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করছিলো। ছাত্র সমাজই ৬ দফার সমর্থনে মিটিং-মিছিলে মুখর থাকতো। ৬ দফা আন্দোলন থেকে সিটি কলেজ ছাত্রলীগ শহরে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে রাজপথে সরব থাকতো। উপর্যুক্ত ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ সিটি কলেজের নেতৃত্বে ছিলেন। সরকারি পেটোয়া সংগঠন এনএসএফ-এর মারদাঙ্গা রাজনীতির উপযুক্ত জবাব দিতে তৈরি থাকতেন ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ। অপরদিকে বক্তৃতার জাদুতে ছাত্র-জনতাকে মুগ্ধ করে রাখতেন ইদরিস আলম, আশরাফ খান।
সিটি কলেজ ছাত্রলীগের উপর্যুক্ত সময়ের দুর্দান্ত সাহসী নেতা জাফর আহমদের আজ ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী। জাফর আহমদ ১৯৪৫ সালে চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই উপজেলার ১নং করেরহাট ইউনিয়নে পশ্চিম জোয়ার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আলী আহমদ। তিনি বাল্যকালে গ্রামের স্কুলে ভর্তি হয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। জোরারগঞ্জ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ফেনী কলেজে ভর্তি হন। ফেনী কলেজের ছাত্র থাকাকালীন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। ফেনী কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ফেনী কলেজে থেকে আইএ পাস করার পর চট্টগ্রাম সিটি কলেজে ভর্তি হন। তিনি সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ছাত্রলীগের নির্বাচনী দল ‘অভিযাত্রিক’র মনোনয়ন নিয়ে ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে সিটি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহবানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জাফর আহমদ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাঁর সাহস ও শক্তিমত্তার জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধে একটি বিশেষ বাহিনীর সদস্য হিসেবে বিশেষ সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হন। প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর নির্দেশে তাঁর নামে গঠিত এই বাহিনীর নাম দেয়া হয় সি-ইন-সি অর্থাৎ কমান্ডার-ইন-চিফ স্পেশাল ফোর্স। বাছাই করা সাহসী ছাত্র-যুবকদের নিয়ে বাহিনীটি গঠন করা হয়েছিলো। চট্টগ্রামের কয়েকজন সি-ইন-সি স্পেশাল ফোর্স সদস্যের নাম উল্লেখ করলেই একথার প্রমাণ পাওয়া যাবে। সিটি কলেজের ছাত্র কদমতলীর জাহাঙ্গীর চৌধুরী, হাটহাজারীর হাজি কামাল, ফটিকছড়ির হালিম, রাউজানের ফেরদৌস হাফিজ খান রুমু, মিরসরাইর জাফর আহমদ সি-ইন-সি স্পেশাল ফোর্সের সদস্য ছিলেন। মিরসরাইর আরো ছিলেন, কিন্তু তাঁদের নাম আমার মনে নেই। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে তিনি দেশকে হানাদারমুক্ত করতে বিশেষ অবদান রাখেন। মিরসরাই থানার চার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি সি.ইন.সি জাফর নামে পরিচিতি পান।
জনাব জাফর আহমদ স্বাধীনতার পর কয়েক বছর ছাত্রলীগ করেন। তিনি ১৯৭২-১৯৭৩ মেয়াদের জন্য চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে মূল দল আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তিনি চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক, পরে সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
জনাব জাফর আহমদ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম জেলার কমান্ডার ছিলেন। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার তিনি অন্যতম সংগঠক ও বেশ কয়েকবার মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
জনাব জাফর আহমদ নীতির প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন এক নেতা। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট পরবর্তী দুঃসময়ে এদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জাফর আহমদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেনা শাসক জেনারেল জিয়া, এরশাদের লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে তিনি বিন্দুমাত্রও চিন্তা করেননি। হাজার বাধাবিপত্তি মোকাবেলা করেছেন তারপরও নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আমৃত্যু অটল ছিলেন সংগ্রামী নেতা জাফর আহমদ।
১৯৭৩ সালে তিনি ষাটের দশকের সিটি কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রী কলেজ তথা চট্টগ্রাম শহরে অগ্নিকন্যা-খ্যাত জাহানারা আঙ্গুরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের সংসারে দুই ছেলে জিয়া ও ইমন। ১৯৮৪ সালে হঠাৎ জাহানারা আঙ্গুর মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে জাফর আহমদ ১৯৮৮ সালে রাউজান থানার ডাবুয়া গ্রামের হাসান চৌধুরী বাড়ীর মোজাফফর আহমেদ (সাবরেজিস্ট্রার) এর জেষ্ঠ্য কন্যা খদিজা খানমের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। সেই ঘরে জাফর আহমদ একটি পুত্র সন্তান লাভ করেন। তার নাম জয়নুদ্দীন আহমেদ জয়।
জাফর আহমদ-এর কনিষ্ঠ পুত্র জয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড চট্টগ্রাম মহানগর এর আহবায়ক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম মহানগর এর সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন।
জাফর আহমদ সৎ, ত্যাগী, সাহসী ও আদর্শবান, রাজনীতিক ছিলেন। সহজ, সরল মনের স্পষ্টবাদী মানুষ। কাউকে ভয় করতে না। সত্য কথা বলতে কখনো কোথাও পিছিয়ে আসতেন না। দুর্দান্ত সাহসী ছিলেন। দল ও আদর্শের জন্য যে কোন বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবাহ
পরবর্তী নিবন্ধভক্তের চিঠি পেয়ে আবেগাপ্লুত পরীমণি