আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ আমাদের জাতীয় জীবনধারার বিকাশে মহৎ ব্যক্তিত্ব। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তার অনুসন্ধিৎসা ও নিষ্ঠার তুলনা করেছেন জার্মান পন্ডিতদের সাথে। রক্ষণশীল সামাজিক পরিবেশের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তার এক জীবনের শ্রম ও সাধনায় বিপুল সংখ্যক পুঁথি সংগ্রহ করেছেন, পাঠোদ্ধার সম্পন্ন করেছেন। তিনি অন্ধকারকে হারিয়ে যে আলো জ্বালিয়েছেন তা কাল থেকে কালান্তরে বহমান থাকবে। মনীষী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সার্ধশতজন্মবর্ষ স্মারকগ্রন্থের পাঠ উন্মোচন অনুষ্ঠানে আলোচকবৃন্দ এ অভিমত ব্যক্ত করেন। শিমূল বড়ুয়া ও রেবা বড়ুয়া সম্পাদিত স্মারক গ্রন্থটি প্রকাশ করে বলাকা প্রকাশন।
একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। রেবা বড়ুয়ার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্মারকগ্রন্থের উপর আলোচনায় অংশ নেন শিক্ষাবিদ প্রফেসর রীতা দত্ত, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক ড. মোবাররা সিদ্দিকা, বাংলা একাডেমি পদকপ্রাপ্ত শিশু সাহিত্যিক ও সাংবাদিক রাশেদ রউফ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর ড. আহমেদ মাওলা, সরকারি মহসিন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. ইলু ইলিয়াস। স্বাগত বক্তব্য রাখেন গ্রন্থটির প্রকাশক জামালউদ্দিন। অনুভূতি ব্যক্ত করেন স্মারক গ্রন্থের প্রকাশক অধ্যক্ষ শিমুল বড়ুয়া।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণীর জন্ম হয় না। এ কথাটি আমরা সবাই জানি, কিন্তু মানতে দ্বিধাবোধ করি। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের মতো নিভৃতচারী জ্ঞান সাধকেরও সঠিক মূল্যায়ন আমরা করতে পারি নি। তাই চট্টগ্রামের মানুষও তাঁর সম্পর্কে খুবই কম জানে। শিমূল বড়ুয়া ও রেবা বড়ুয়া স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে সে অসাধ্যকে সাধন করেছেন। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ বলেছেন, ‘তেঁতুল দেখিলে যেমন জিহ্বায় জল আসে, পুঁথির নাম শুনিলেও আমার তাহা না দেখা পর্যন্ত সোয়াস্তি থাকে না’। এই কথাটির মাধ্যমে তিনি আমাদের অনুধাবন করাতে চেয়েছেন পুঁথির মতো লুপ্তপ্রায় প্রাচীন সাহিত্য উদ্ধারে পুঁথি সাহিত্যের প্রতি তাঁর কতোটা অনুরাগ ছিল। তিনি অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার ধারক ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, আমরা সবাই মানুষ। যার যার ধর্ম তার তার। আমরা এ দেশের অধিকাংশ মানুষ এ ধারণাটাই মনের মধ্যে পোষণ করি। এম এ মালেক উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, গত ২০ অক্টোবর বিরল একটি ঘটনা ঘটেছে। মুসলিম ধর্মপ্রাণ মানুষ ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করেছেন, হিন্দুরা লক্ষী পূজা করেছেন আর বৌদ্ধরা প্রবারণা পূর্ণিমা করেছেন। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদও বলতে চেয়েছেন আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা মানুষ, আমরা বাঙালি, বাংলা বাঙালির মাতৃভাষা। তিনি প্রসঙ্গক্রমে বলেন, একুশের প্রথম প্রহরের কবিতা কাঁদতে আসি নি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি লিখেছেন কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, যেটি কোহিনূর প্রেস থেকে চরম ঝুঁকি নিয়ে ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিলেন আমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক। পরবর্তী ইতিহাস আমরা সবাই জানি। বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের রক্ত দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। আমি মনে করি, আমরা নানা ভাষার চর্চা করতে পারি, রপ্ত করতে পারি, কিন্তু বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে তা কোন ভাবেই নয়। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ প্রসঙ্গে বলেন, তিনি শুধু চট্টগ্রামের নয়, পুরো বাংলাদেশের গর্ব। জাতীয় জীবন ধারার বিকাশে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।
সভাপতি প্রফেসর ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া বলেন, আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা বাঙালি। তারপর আমরা কে কোন ধর্মাবলম্বী সে বিষয়টা বিবেচ্য হবে। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের মধ্যেও সেই অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনা ছিল। তাঁর জীবনী তাই আমাদের জানা উচিত। সম্প্রতি যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হচ্ছে, তার নেপথ্যে আছে জ্ঞানের অভাব। আমরা একে অপরকে বুঝতে চেষ্টা করছি না। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের লেখা বিশ্লেষণ করলে তা দূর হবে। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে মনুষ্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। এ বাংলাদেশকে যদি আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশে পরিণত করতে পারি তবেই এদেশ সোনার বাংলায় পরিণত হবে।
প্রফেসর রীতা দত্ত বলেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের জীবনের ব্রত ছিল সাহিত্য, মানব ও স্বদেশ সেবা। কিন্তু আমরা এই ব্রতকে অন্তরে ধারণ করি না বলেই সামাজিক অবক্ষয় ও পতনের বিষবৃক্ষ ধীরে ধীরে মাথা তুলছে। চট্টল মনীষী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ সম্পর্কে যদি আমরা না জানি, সে গ্লানি কিন্তু আমাদেরই। তিনি আমাদের বাঙালিত্বকে উদ্দীপ্ত করেছেন। তাঁর কোন মৃত্যু নেই, তিনি অবিনশ্বর। তিনি আমাদের আলো দেখাবেন, সেই আলোর পথ ধরে আমরা আলোকিত হবো।
প্রফেসর ড. মোবাররা সিদ্দিকা বলেন, স্মারক গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের উত্তর প্রজন্ম হিসেবে আমরা হৃদয়ের আর্তি প্রকাশ করেছি। তিনি চট্টগ্রামের সন্তান হয়ে পুরো বাঙালির গর্ব হয়ে উঠেছিলেন। আমরা যারা এ স্মারকগ্রন্থে লিখেছি, তারা সাহিত্য বিশারদের প্রতি নিজেদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছি।
কবি ও সাংবাদিক রাশেদ রউফ বলেন, স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে অধ্যক্ষ শিমূল বড়ুয়া ও রেবা বড়ুয়া একটি যুগোপযোগী সম্পাদনা উপহার দিয়েছেন। গ্রন্থে লেখকগণ সাহিত্য বিশারদের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং তাঁকে বড় করে তোলার প্রবণতা দেখিয়েছেন। লেখাগুলো মূল্যবান সম্পদ। যে কাজটা আমরা করতে পারি নি, সেটা শিমূল বড়ুয়া ও রেবা বড়ুয়া করে দেখিয়েছেন। দায়বোধ থেকে এ সংকলনের প্রকাশ। আদুল করিম সাহিত্য বিশারদের মতো মনীষীর যতোটা মূল্য হওয়া উচিত, ততটা না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক।
প্রফেসর ড. আহমেদ মাওলা বলেন, এ মহৎ কাজটি করার মধ্য দিয়ে শিমূল বড়ুয়া ও রেবা বড়ুয়া একটি জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। বাঙালি কখনো তার ইতিহাস লিখতে চায় নি, লিখতে যায় নি। বাঙালিদের মধ্যে প্রথম আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ এ অনুসন্ধানে আসেন। একটি অজ পাড়া গাঁ থেকে তিনি নমস্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন।
প্রফেসর ড. ইলু ইলিয়াস বলেন, স্মারকগ্রন্থটি অত্যন্ত সময়পোযোগী। এটি পাঠ করে আমরা সমৃদ্ধ হবো। বাঙালি ইতিহাস সৃষ্টি করে, কিন্তু চর্চা করে না বরং নষ্ট করে। এক্ষেত্রে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ব্যতিক্রম। একাডেমিক শিক্ষা তেমন না থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজেই একাডেমি হয়ে উঠেছিলেন।