জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত যে অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন, সেই অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ যেন কলুষিত না হয় সে লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সুধী সমাবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের গত কয়েক যুগের রাজনৈতিক অস্থিরতা, দারিদ্র্য ও দুর্ভোগের মূল কারণ সামপ্রদায়িকতা। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার পর ধর্মীয় সামপ্রদায়িকতাকে রাষ্ট্রীয় সামপ্রদায়িকতায় রূপ দেওয়া হয়েছে। এটা সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের ফল। আগে যা ছিল সমপ্রদায়ে সমপ্রদায়ে হানাহানি এখন তা-ই রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে হানাহানির রূপ ধারণ করেছে। ভারতবিরোধিতা এই রাষ্ট্রীয় সামপ্রদায়িকতার একটা ছদ্ম আবরণ। কয়েক শতাব্দীর সাম্রাজ্যবাদী এবং অভিশপ্ত সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ হিসেবেই স্বাধীন জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের অভ্যুদয়। আমরা যদি সকল প্রতিকূলতার মধ্যে সেক্যুলার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারি তাহলে এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সফল হবে।’ বাংলাদেশ কোনও একক জনগোষ্ঠীর নয়। বাংলাদেশ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার। প্রতিটি নাগরিকের এই দেশের প্রতি মমত্ববোধ, দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ যাতে জেগে উঠে সেজন্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন- ‘এই দেশ হিন্দুর না, এই দেশ মুসলমানের না। এই দেশকে যে নিজের বলে ভাববে, এই দেশ তার। এই দেশের কল্যাণ দেখে যার মন খুশিতে ভরে উঠবে এই দেশ তার। এই দেশের দুঃখে যে কাঁদবে এই দেশ তার। এবং এই দেশ তাদের যারা এই দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দিবে।’ ১৯৭১ সালে ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার কদিন পরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ভারত থেকে ঢাকায় পৌঁছান। প্রধানমন্ত্রী এসে প্রথম যে সাংবাদিক বৈঠক করেন তখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার নতুন সরকার সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে কি নীতি গ্রহণ করবেন? তিনি বলেছিলেন ‘আমাদের নতুন সরকারের কাছে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু বলে কিছু নেই। আমাদের কাছে সব নাগরিকই সমান।’
২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ধর্মীয় কয়েকটি সংগঠনের নেতৃত্বে সংঘটিত সারাদেশ জুড়ে সামপ্রদায়িক সন্ত্রাসী কার্যকলাপের পর ক’দিন পূর্বে দেশব্যাপী একযোগে সংঘটিত বড় সামপ্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা আমাদেরকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। সেসময় সরকার ও প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে হয়তো সারাদেশে নাসিরনগর, সুবর্ণজয়ন্তীর সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া বা রামুর মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতো। ঘটনাগুলো ঘটার সময় পুলিশের তৎপরতার বিরুদ্ধে ও হিন্দু সমপ্রদায়ের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দিতে দেখা গেছে কয়েকটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের। এমনকি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আশ্চর্যরকম নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে গোষ্ঠীগত সংখ্যালঘু নির্যাতনের মত সামপ্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনার বিচার হয় না। এর ফলে হামলাকারীরা একধরনের নিশ্চিত থাকে যে, ধর্মের নামে সামপ্রদায়িক হামলা করলে কিছুই হবে না। তার আগে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় মদদে প্রায় ১৮ হাজার সামপ্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার ঘটনার সময় দেশের ত্রিশটি শহর সহ প্রায় সবক’টি জেলায় সামপ্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছিল। সেই নৃশংসতায় দগদগে ঘা এখনো শুকায়নি।
পবিত্র ধর্ম ইসলামেও অশান্তিকারী বিশৃঙ্খলাকারীদের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। এভাবে সত্য/মিথ্যা ধর্ম অবমাননার ধোঁয়া তুলে, মানুষকে কষ্ট দিয়ে, ঢাক ঢোল পিটিয়ে নিজেই নিজের ধর্মকে ছোট করার সামিল। অন্যের কাছেও আপনার ধর্ম সম্পর্কে ভুল বার্তা পৌঁছালেন। সামপ্রদায়িকতার খারাপ বৈশিষ্ট্য হলো- অন্য ধর্ম, জাতি বা অঞ্চলের ব্যাপারে অসহিষ্ণু হওয়া। ইসলাম সামপ্রদায়িকতাকে কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করে না। উগ্রবাদি আচরণ নয়, ধৈর্য ও সহনশীলতাই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা। আপনার নিজ দেশে অমুসলিমদের প্রতি আপনার আচরণের উপর অন্যদেশের মুসলিমদের প্রতি আচরণের বিষয়াদি প্রভাবিত করে। ইসলাম ধর্মের প্রতি বিদ্বেষের কারণে যদি কোনও ব্যক্তি প্রতিমার পায়ের কাছে পবিত্র কোরআন রাখার মতো ঘৃণ্য কাজ করেও থাকে, তাহলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আইনে তার অবশ্যই বিচার হবে। এক্ষেত্রে গোটা সমপ্রদায় কেন দায়ী হবে? মদিনার সনদের শর্তসমূহের মধ্যেও উল্লেখ আছে- ‘কোন লোক ব্যক্তিগত অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই বিচার করা হবে। তজ্জন্য অপরাধীর সমপ্রদায় কে দায়ী করা যাবে না।’ পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননার কথা বলা হল কুমিল্লায়, তাহলে ফেনী, নোয়াখালীর চৌমুহনী, কুড়িগ্রামের উলিপুর, রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দুদের বসতবাড়ি, মন্দির-মণ্ডপে অগ্নিসংযোগ করেছে, লুটপাট করেছে কেন? একটি ঘটনার জের ধরে আরো শত শত ঘটনার জন্ম নিচ্ছে কেন? তাহলে আমরা ধরেই নিতে পারি এসব আসলেই পূর্বপরিকল্পিত। কুমিল্লার ঘটনা স্পষ্টতই গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। বায়তুল মোকাররম মার্কেটে সহিংসতায় পবিত্র কোরআন পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও সকলের জানা। কই সেখানে তো কোন হিন্দু আসেনি।
তবে কিছু প্রশ্ন জনমনে এসেই যায়। কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের ঘটনার পর প্রশাসন দেশব্যাপী তড়িৎ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়নি কেন? এটি নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, সন্ত্রাসী ঘটনাগুলো পূর্বপরিকল্পিত। দেশব্যাপী এরকম সিরিজ সামপ্রদায়িক সন্ত্রাসী হামলা-নাশকতার ছকের তথ্য গোয়েন্দা বাহিনী বা প্রশাসনের অজানা কিভাবে থাকে? সরকারি দল, প্রশাসন সামপ্রদায়িক সন্ত্রাস ঠেকানোর ব্যর্থতার দায় কোনভাবেই এড়াতে পারে না। এক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা দরকার। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হল; নাসিরনগরের ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বা অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সরকারীদলের চেয়ারম্যানে প্রার্থী হিসেবে দলীয় মনোনয়ন পর্যন্ত পেয়ে যায়। পরে সেই মনোনয়ন বাতিল করা হলেও, মনে প্রশ্ন জাগে প্রার্থীর কোন যোগ্যতার বিচারে মনোনয়ন দেয়া হয়। এমনকি আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী অনেকে চরম সামপ্রদায়িক মনোভাব পোষণ করতে দেখা যায়। তারা কেন বিভ্রান্ত? তাদের ব্যাপারে এখনই দলের সজাগ হওয়া উচিৎ।
শেষ করতে চাই কাজী নজরুল ইসলামের প্রসঙ্গ দিয়ে। অসামপ্রদায়িক মানবিক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন কবি। তাঁর বিদ্রোহটা ধর্মের বিরুদ্ধে ছিলনা, ছিল ধর্ম-ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। ধর্মকে শোষণের অন্যতম হাতিয়ার তখনো ব্যবহার হত, যেমন এখনো হচ্ছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে এমন বাংলাদেশ আমরা চাইনি। ধর্মের ভিত্তিতে কাউকে বৈষম্য করা যাবেনা। আইন ও সরকারের চোখে সব সমান। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না’। এই দেশে ‘সংখ্যালঘু’ কিংবা ‘সংখ্যাগুরু’ বলে কোন শব্দের প্রচলন থাকতে পারেনা। যে আগুনে বাংলাদেশ পুড়ছে, সেই আগুনের উত্তাপ সবখানেই ছেয়ে যাবে। ঘটনা সাজিয়ে তারা এমন সহিংসতার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। কিছু মানুষ ষড়যন্ত্রকারীদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে। তাই মানুষকে জাগতে হবে, মননকে অসামপ্রদায়িক করে গড়ে তুলতে হবে। মানুষ সচেতন হলে ষড়যন্ত্রীরা কোনোভাবেই সফল হতে পারবে না। সামপ্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনায় জড়িতদের সুষ্ঠু তদন্ত-বিচার ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা ছাড়া সামপ্রদায়িক সন্ত্রাস বাংলাদেশে কখনো বন্ধ হবে না। সামপ্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানোর পেছনে যারা প্রকৃত দোষী তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হোক। বাংলাদেশ সামপ্রদায়িকতার কলঙ্কমুক্ত হোক।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাবেক ছাত্রনেতা।