পৃথিবীটা কেমন বদলে গেছে। চারদিকে শুধু হাহাকার। এক অজানা ভাইরাস পৃথিবীর মানুষকে এক লহমায় স্তব্ধ করে দিয়েছে। প্রায় দুই বৎসর যাবত এই ভাইরাস মানুষ আর প্রকৃতির ছন্দটাই বদলে দিয়েছে। কত মানুষকে আমরা হারালাম। কত প্রিয়জন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু শেষ বিদায়ে আমরা কেউ সামিল হতে পারিনি। কি দুর্বিসহ যন্ত্রণা। এই যে কিছুদিন আগে হারালাম দৈনিক আজাদীর সাহিত্য সম্পাদক কবি অরুণ দাশগুপ্তকে, তারপর একে-একে বিদায় নিলেন অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের তিন যোদ্ধা- সংগঠক আবদুস সালাম আদু, কবি চিত্রকর খালিদ আহসান, চিত্রকলা ও সঙ্গীত শিল্পী, ‘সোলস’-এর অন্যতম সদস্য সুব্রত বড়ুয়া রণি এবং সদ্য প্রয়াত প্রখ্যাত কবি শাহিদ আনোয়ার। এই চারজন শুধু চট্টগ্রামের শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতিতে অবদান রাখেননি, বাংলাদেশে তাঁদের সৃষ্টিশীল কুচকাওয়াজ আমাদের বিনম্্রতায় নত করে রেখেছিল।
সারা পৃথিবী জুড়ে শুধু শূন্যতা আর বেদনার লহরা। যখন একেএকে প্রিয়জন হারানোর বেদনায় আমরা দংশিত হচ্ছি, ঠিক এই সময়ে চট্টগ্রামের একজন প্রবীণ নাট্যকর্মী ও সংগঠকের জন্মদিন পালিত হচ্ছে জেনে আনন্দিত হচ্ছি। তিনি আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রিয় মানুষ, প্রিয় আত্মীয় জাহাঙ্গীর কবির। চট্টগ্রামের নাট্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে সবার পরিচিত ব্যক্তিত্ব তিনি।
কি যাদু আছে মানুষটির? কি সম্মোহনী শক্তি আছে মানুষটির? কেউ জানেন না। শিল্পকলার প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই, মিলনায়তনের সামনে সবার আগে এক পলক অনুসন্ধান করেন সবাই ঐ প্রিয় মানুষটি আছেন কিনা? যাঁর যত কাজ থাকুক না কেন, সামনে গিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করেন, তারপর কাজে যোগ দেন। কেউ তাঁকে এড়িয়ে গেলে তিনি চিৎকার দিয়ে ডেকে জিজ্ঞেস করেন অথবা কাছে এসে কুশল জিজ্ঞেস করতে ভুলেন না। ঐ মানুষটির প্রতি অদ্ভুত একটা টান অনুভব করেন শিল্পকলার নিয়মিত বাসিন্দারা। শ্রদ্ধা ও স্নেহ ভালোবাসায় যিনি সবাইকে কাছে টানতে পারেন। তিনি সবার প্রিয় মানুষ নাট্যজন জাহাঙ্গীর কবির। তীর্যক নাট্যগোষ্ঠীর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমীর নির্বাচিত সহ-সভাপতি। ছোট, বড়, প্রবীণ, নবীন সকলের শ্রদ্ধার মানুষ। পড়ন্ত বিকেলবেলায় অথবা সন্ধ্যায় দশ-বারটি চেয়ার আর দুটি টুল সম্বল করে প্রায় ৪০ বৎসরের অধিক সময় ধরে, চলে আসছে ঐ আড্ডা। সন্ধ্যা হতে হতে বাড়তে থাকে আড্ডারুদের সংখ্যা। বেশ কয়েকবার হয়ে যায় তৃষ্ণা মেটানো চা।
চট্টগ্রামে সৃজনশীল আড্ডা নেই বললেও চলে, জাহাঙ্গীর ভাইয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ঐ-আড্ডা এখনো সচল। এই আড্ডা থেকে অনেক সংস্থার জন্ম হয়, এখানে আড্ডারুরা স্বপ্ন দেখেন এবং স্বপ্ন রচনা করেন, সমাজ, সংস্কৃতি, দেশ ও মানুষের কল্যাণের। কে আসেন না এই আড্ডায়? নাট্যকর্মীরাতো বটেই, আবৃত্তিশিল্পী, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অধ্যাপক, সাংবাদিক, রাজনৈতিককর্মী, আলোকচিত্রশিল্পী, তরুণ সংস্কৃতিকর্মী এবং শিক্ষার্থীরাও এখানে সমবেত হন। এ আড্ডাতে উঠে আসে রাজনীতি, অর্থনীতি, বিশ্ব প্রেক্ষাপট, খেলাধুলা এবং অবধারিতভাবে নাটক প্রসঙ্গ। তাঁদের কেউ হয়তো নিয়মিত, কেউ কেউ গরহাজির। কিন্তু জাহাঙ্গীর ভাইকে আপনি প্রতিনিয়ত পাবেনই। একদিন জাহাঙ্গীর ভাই অনুপস্থিত থাকলে সবাই যেন প্রাণহীন হয়ে যায়। তিনি শুধু আড্ডার প্রাণ নন, শিল্পকলার পরিবেশ রক্ষায়ও তিনি সচেষ্ট। কোন গোলমাল হলে সবার আগে তিনি ছুটে গিয়ে প্রতিবাদ করেন। শিল্পকলার পরিবেশ রক্ষার্থে তাঁকে মামলায় পর্যন্ত জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। নবীন অনেক সংস্কৃতিকর্মী বা আড্ডার অনেকেই হয়তো জানেন না তিনি জননেতা জহুর আহম্মদ চৌধুরীর রাজনীতিশিষ্য ছিলেন। বাগমনিরাম এলাকায় তাঁকে এক ডাকে বাবুল নামে চেনে।
১৯৭১-১৯৭৪ পর্যন্ত বাগমনিরাম ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন (বর্তমানে সহ সভাপতি) এই জাহাঙ্গীর ভাই। সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৮৩ সালে পৌর কর্পোরেশনের সদস্য নির্বাচিত হন। সেই সময় পৌর সদস্য হিসাবে আপামর জনগণের উপকার করার জন্য নানান পরিকল্পনা তিনি হাতে নিয়েছিলেন। সুবক্তা, সাহসী, দক্ষ সংগঠক এই জাহাঙ্গীর ভাই ২০০৩ সাল পর্যন্ত ‘ফার্নিচার’ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সদস্য এবং সিআরবি পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের নির্বাহী সদস্য। কিসের টানে জীবনের অনেকটা সময় অতিবাহিত করে চলেছেন শিল্পকলার আঙ্গিনায়। কারো অসুবিধা, সুখে-দুঃখে সবার আগে তিনি ছুটে চলেন। কারও রক্তের দরকার জাহাঙ্গীর ভাই, কারো জানাজায় যেতে হবে তাঁর নেতৃত্বে ছুটছে আড্ডার দল। পিকনিক, খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনে জাহাঙ্গীর ভাই। শিল্পকলা একডেমীর মুক্ত মঞ্চ ও মহড়া কক্ষ নির্মাণে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আড্ডার প্রাণপ্রিয় মানুষটির জন্ম ১০ অক্টোবর ১৯৫২ ইংরেজি। একটি বনেদি পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতৃ-মাতৃভক্ত এই মানুষটি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ‘মল্লিকা ভবন’ এর সত্তাধিকারী মৃত হাজী আবদুস সাত্তারের এবং মা মৃত হাজী লায়লা খাতুনের পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠপুত্র। তিন কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক তিনি। জাহাঙ্গীর কবির স্ত্রী রিজিয়া বেগম ও তিন নাতি, এক নাতনী নিয়ে বেশ সুখেই আছেন। নির্লোভ, নি-অহঙ্কারি এই মানুষটি এখনও ভাবে ‘সোনার বাংলা’র কথা, সাধারণ আপামর জনগণের কথা। এখনও তাঁর আদর্শিক নেতা বঙ্গবন্ধু।
সংস্কৃতি কর্মী ও নাট্যকর্মীদের কোন অনুষ্ঠান হলে তাঁকে সবাই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। পাশাপাশি নাটকের এই অন্তপ্রাণ মানুষটি আজন্ম চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠিত নাট্যদল তীর্যক নাট্যগোষ্ঠীর অগ্রজ নাট্যযোদ্ধা। এই পর্যন্ত মঞ্চে অভিনীত নাটকের সংখ্যা ২০টির বেশি। তার মধ্যে শেক্সপীয়রের ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’, বের্টোল্ট ‘সমাধান’, সেলিম আল দীনের ‘আততায়ী’, মুনির চৌধুরীর ‘কবর’ ইত্যাদি স্মরণীয় প্রযোজনা।
তিনি রেডিও, টেলিভিশনেও নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। তবে তাঁর ভালো লাগে মঞ্চে অভিনয় এবং নেপথ্য শিল্পী হিসাবে কাজ করতে। ইতোমধ্যে তাঁকে সম্মাননা জানিয়েছে ‘মঞ্চ মুকুট নাট্যসম্প্রদায়’ ও ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যকলা বিভাগসহ বিভিন্ন সংগঠন।
এ দুঃসময়ে যখন একে একে সব প্রিয়জন আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তখন জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ৭০তম জন্মদিনের পালনের খবরটি আমাদের কাছে আনন্দেরই বটে। যাঁদের আমরা হারিয়েছি তাঁদের পরিবারের খোঁজ কি আমরা নিই? ৭০তম জন্ম বার্ষিকীতে জাহাঙ্গীর ভাইকে সুস্থ ও সবল দেখতে পাচ্ছি বলে ভালোই লাগছে।
তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু জীবন কামনা করি। আবার ভয় হচ্ছে যাঁকে নিয়ে লিখলাম, শ্রদ্ধা জানালাম, তিনি অসুস্থ বা বার্ধক্যের কাছে পরাস্থ হয়ে শিল্পকলায় না আসলে বর্তমানের ব্যস্ত সময়ের চাদর সরিয়ে তাঁকে কি আমরা দেখতে যাবো? ভয় হয়, সঙ্কোচ হয়, লজ্জা লাগে যদি দেখতে যেতে না পারি!
ক্ষমা করো হে প্রবীণ, প্রবীণতম এই প্রিয় সুহৃদরা আমরা বড় অক্ষম, নির্মম, অস্থির বর্তমান সময়ের কাছে। আমরা মানুষরা বর্তমানকে বড্ড বেশি ভালবাসি। তাই অতীত গৌরবকথা ভুলে যাই, মনে রাখি না। আপনাদের স্মরণীয় সৃষ্টিগুলোর কথা।
ধিক্! বর্তমান সময়ের কাছে পরাজিত আমরা মানুষরা। আপনি সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকুন এই কামনা করি। কথা দিতে পারছি না, যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন আমি বা আমরা দেখতে যাবো কিনা?
অধ্যাপক ও নাট্যনির্দেশক