লাখো মানুষের উপস্থিতিতে জানাজা শেষে কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কবরস্থানে সমাহিত করা হয় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে।
আজ বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বিকালে তাকে দাফন করা হয়।
গতকাল বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ৮টার দিকে কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পে গুলি করে হত্যা করা হয় এই আলোচিত রোহিঙ্গা নেতাকে।
এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার ব্যাপারে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে(আরসা) দায়ী করেছে ভাই হাবিবুল্লাহ সহ তার স্বজনরা।
রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ নিহত হওয়ার পর কক্সবাজারের উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল জোরদার করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সন্ত্রাসীরা পাঁচ রাউন্ড গুলি করলে তিন রাউন্ড গুলি সরাসরি তার বুকে লাগে। এতে মুহিবুল্লাহর মৃত্যু হয়।
মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, “উখিয়া কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া ক্যাম্পে এশার নামাজ শেষ করে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ)-এর অফিসে অবস্থানকালে একটি বন্দুকধারী দল আমার ভাইয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওই অফিসে কর্মরত অন্যান্যদের মারধর করে ছেড়ে দিলেও ভাইয়ের বুকে গুলি চালায় মাস্টার আবদুর রহিম নামে এক সন্ত্রাসী।বন্দুকধারীদের এ দলে মাস্টার আব্দুর রহিম, মুর্শিদ, লালুসহ ২০ থেকে ২৫ জন ছিল। রোহিঙ্গাদের যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আমার ভাই এগিয়ে আসতেন। তাদের অধিকার আদায়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছিলেন।”
এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে ঘাতকদের শাস্তির দাবি জানান তিনি।
তবে আরসা প্রধান হাফেজ আতাউল্লাহ জুনুনীর বরাত দিয়ে সংগঠনটির মুখপাত্র সোয়াইব এক অডিও ক্লিপ সামাজিক মাধ্যমে ছেড়েছেন। এতে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দাবি করা হয় আরসার পক্ষ থেকে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইতোপূর্বে মুহিবুল্লাহ নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। তাছাড়া প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশ সরকারসহ এনজিও, আইএনজিও এবং বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে আসছিলেন এই নেতা। তার এই ভূমিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় রোহিঙ্গাভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আরসা সহ অন্যান্য গ্রুপগুলো। এর ধারাবাহিকতায় তাকে খুন করা হয়েছে বলে দাবি স্বজনদের।
এদিকে মুহিবুল্লাহকে হত্যার ঘটনায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন সমবেদনা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর আজ কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী নেতা মুহিবুল্লাহর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে গভীরভাবে মর্মাহত ও শোকাহত জানিয়ে এই হামলার তীব্র নিন্দা জানায়।
বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, আমরা মুহিবুল্লাহর পরিবার এবং বৃহত্তর রোহিঙ্গা শরণার্থী সম্প্রদায়ের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি যারা তার ক্ষতিতে শোকাহত। আমরা অবিলম্বে তদন্তের জন্য এবং দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
ইউএনএইচসিআর ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার দায়িত্বে থাকা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছে।
অবিলম্বে শীর্ষ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত মন্তব্য করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেছেন, মুহিবুল্লাহর মৃত্যুতে তারা একজন প্রকৃত বন্ধুকে হারিয়েছেন।
রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য মুহিবুল্লাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর ছিলেন, তার হত্যাকাণ্ড স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে স্বাধীনতার পক্ষে ও সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডসহ ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের উপর হামলার তদন্ত দাবি করেন।
মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, মুহিবুল্লাহ সবসময় রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন, তাদের অধিকার, জীবনমান ও ভবিষ্যত করণীয় বিষয়ে তাদের মত প্রকাশের অধিকার রক্ষা করেছেন। তার মৃত্যু শুধু শরণার্থী শিবিরে অধিকার ও সুরক্ষা বিষয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংগ্রামকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না বরং মিয়ানমারে নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের প্রচেষ্টাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ইন্টার সেক্টর কোঅর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) বা রোহিঙ্গা রেসপন্স ইন বাংলাদেশের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা শরণার্থী নেতা মুহিবুল্লাহর মর্মান্তিক মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। রোহিঙ্গা জনগণের পক্ষে তার অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্যই সারাবিশ্ব থেকে তাকে সমবেদনা জানানো হচ্ছে। তার পরিবার এবং এআরএসপিএইচ সহকর্মীদের প্রতি আমাদের সমবেদনা।