বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে গত ২০২০-২০২১ অর্থবছর থেকে বন্ড লাইসেন্স ইস্যুর ক্ষেত্রে নতুন শর্তারোপ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ফলে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটে কমে যায় নতুন বন্ড লাইসেন্সের আবেদন। আগে যেখানে মাসে ৩-৪টি আবেদন জমা পড়তো; কড়াকড়ির পরে সেটি নেমে গেছে গড়ে মাত্র একটিতে। তাও সব শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় অনেকে লাইসেন্স পাচ্ছেন না। গত অর্থবছরে নতুন বন্ড লাইসেন্সের আবেদন জমা পড়েছে মাত্র ১৪টি। এছাড়া চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের গতকাল পর্যন্ত বন্ড লাইসেন্সের জন্য আবেদন জমা পড়েছে ৪টি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক সময় বন্ড লাইসেন্স পেতে ১৪টি শর্তপূরণ করতে হতো। তবে গত ২০২০-২০২১ অর্থবছর থেকে আরো ৯টি শর্ত বাড়িয়ে ২৩টি করা হয়েছে। নতুন শর্তগুলো অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে কাস্টমস বন্ড কর্মকর্তা বলছেন, বন্ড সুবধিার অপব্যবহার রোধ করার জন্যই মূলত বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালা সংশোধন করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অনেকে লাইসেন্স নিয়ে বন্ড সুবিধার অপব্যহার করে। তাই প্রকৃত ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করতেই লাইসেন্স ইস্যুর ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড সূত্রে জানা গেছে, নতুন ৯ শর্তের মধ্যে রয়েছে- বন্ড লাইসেন্স পেতে ইচ্ছুক কারখানার চারদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকবে হবে। একই ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার মধ্যে স্থাপিত গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বেষ্টনীর নকশা সার্টিফাইড ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে সত্যায়িত করে আবেদনের সঙ্গে জমা দিতে হবে। কারখানার ভেতরে অবস্থিত কাঁচামাল ও ফিনিশড গুডসের জন্য নির্ধারিত ওয়্যারহাউস আন্তর্জাতিকমানের হতে হবে। অর্থাৎ বন্ডের কাঁচামালের জন্য নির্ধারিত ওয়্যারহাউসের ভেতরে ইউটিলিটি সংযোগ বা ইলেকট্রিক্যাল ওয়্যার রাখা যাবে না এবং পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা রাখতে হবে। গুদামসহ প্রতিষ্ঠানের আয়তন পাঁচ হাজার বর্গফুট হতে হবে। ভাড়া জায়গায় কার্যক্রম পরিচালনারত প্রতিষ্ঠানের নূন্যতম পাঁচ বছরের ভাড়ার চুক্তি জমা দিতে হবে। পাশাপাশি এর আগে ওই জায়গায় বন্ডের প্রতিষ্ঠান ছিল কিনা তা ভাড়া প্রদানকারীর কাছ থেকে প্রত্যায়িত করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের নিজ নামে জ্বালানি সংযোগ থাকতে হবে, তবে একই হোল্ডিংয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠান থাকলে সাব-মিটার থাকতে হবে। আবেদনকারী যদি উৎপাদন কার্যক্রমের জন্য স্থানীয় উৎস থেকে আমদানিকৃত বা ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি কেনা হলে যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল বিষয়ক আন্তর্জাতিক সার্ভেয়ার প্রতিষ্ঠানের সনদ জমা দিতে হবে। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি বা যন্ত্রাংশ সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ভ্যাট পরিশোধের দলিলাদি, মেশিন আমদানির বিল অব এন্ট্রি, ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট জমা দিতে হবে এবং মেশিনের ন্যূনতম মূল্য ৪০ লাখ টাকা হতে হবে। এছাড়া আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের সহযোগী সব প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা হালনাগাদ থাকতে হবে। বিদেশি পরিচালক থাকলে (দেশে অবস্থান করুক বা না করুক) তাদের টিআইএন এবং বিনিয়োগকারী ভিসার কপি জমা দিতে হবে। লিমিটেড কোম্পানির মূলধন ন্যূনতম এক কোটি এবং একক/অংশীদারি মালিকানার ক্ষেত্রে ন্যূনতম টার্নওভার ৩০ লাখ টাকা হতে হবে।
উল্লেখ্য, এর আগে ১৪টি শর্তপূরণ করে বন্ড লাইসেন্স নিতে পারতেন উদ্যোক্তারা। এগুলো হচ্ছে- যথাযথ মূল্যমানের কোর্ট ফি সহ আবেদন। বিওআই/বিএসসিআইসি রেজিস্ট্রেশন সনদ, কোম্পানির টিআইএন সনদ, হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স, হালনাগাদ ফায়ার লাইসেন্স, ভ্যাট সনদপত্র, সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশনের সুপারিশপত্র, মালিক পরিচালকদের নাম, পদবি, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, স্বাক্ষর এবং ছবি নোটারি পাবলিক ও লিয়েন ব্যাংক কর্তৃক সত্যায়ন করে ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প দাখিল, বয়লার সনদ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), জয়েন্ট স্টক কোম্পানির মেমোরেন্ডাম অ্যান্ড আর্টিকেলস অব অ্যাসোসিয়েশন এবং সার্টিফিকেট অব ইনকর্পোরেশনের একটি করে মূল বই (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), মেশিনারি আমদানির ক্ষেত্রে ইনভয়েস ও বিল অব এন্ট্রি বা স্থানীয় ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রয় সংক্রান্ত সত্যায়িত ফটোকপি, প্রস্তাবিত বন্ডেড ওয়্যার হাউসের দুই কপি নকশা যা এ্যামোনিয়া প্রিন্ট পেপারে প্রস্তুতকৃত ও সার্টিফাইড ইঞ্জিনিয়ার কর্তৃক প্রতিস্বাক্ষরিত এবং কারখানার মালিকানা দলিল কিংবা ভাড়ার ক্ষেত্রে নোটারিকৃত চুক্তিপত্র ও ব্যবসা পরিচালনাকালে দেশের সব আইন-কানুন মেনে চলার অঙ্গীকারসহ ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে হলফনামা।
জানতে চাইলে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট চট্টগ্রামের কমিশনার একেএম মাহাবুবুর রহমান দৈনিক আজাদীকে বলেন, বন্ড লাইসেন্স ইস্যুতে নতুন শর্তারোপ করার কারণে এখন আর কেউ স্বল্প মূলধন নিয়ে ব্যবসা করতে পারছেন না। স্বল্প মূলধন নিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করে অনেক ব্যবসায়ী বন্ড সুবিধায় পণ্য এনে খোলা বাজারে পণ্য বিক্রি করে দেন। এতে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়। বর্তমান অবস্থায় বন্ড লাইসেন্স তারাই নিতে পারবেন, যারা প্রকৃতপক্ষে রপ্তানি বাণিজ্য করতে সক্ষম। ঢালাওভাবে আবেদন করার সক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে আবেদন কমে গেছে।