আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে সব ধরনের জ্বালানির দাম। এ কারণে নিজেদের আমদানি কমিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) দিকে ঝুঁকছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। হঠাৎ করে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিপত্তিতে পড়েছে রাষ্ট্রীয় জ্বালানি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানটি। নিয়মমাফিক দেশে ৪৫ দিনের জ্বালানির যোগান থাকার কথা থাকলেও ডিজেলের মজুদ নেমেছে অর্ধেকে। এতে দেশে জ্বালানির সংকটের আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সাময়িক সংকট হলেও জ্বালানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা সম্ভব বলে দাবি বিপিসির।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি মিলে দেশে বর্তমানে ফার্নেস অয়েল নির্ভর ৪৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। তন্মধ্যে ২৬টি হচ্ছে বেসরকারি আইপিপি (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্লান্ট), ২০টি সরকারি। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে মাসে ৬০ হাজার টন ফার্নেস অয়েলের চাহিদা রয়েছে।
সূত্র জানায়, বছরের বেশিরভাগ সময়ে উৎপাদন বন্ধ থাকে সরকারি প্লান্টগুলোর। কারণ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকলেও কমার্শিয়াল চার্জ পায় বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে। যে কারণে বেসরকারি প্লান্টগুলো বেশিরভাগ চালু থাকে। সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে ফার্নেস অয়েলের চাহিদা রয়েছে মাসে ১৫ হাজার টন। বেসরকারি আইপিপিগুলোতে (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্লান্ট) মাসে চাহিদা থাকে ৪৫ হাজার টন। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়ে ২০১৪ সাল থেকে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ফার্নেস অয়েল আমদানি শুরু করে। এরপর বেসরকারি আইপিপিগুলো বিপিসি থেকে ফার্নেস অয়েল নেয়া বন্ধ করে দেয়। বেসরকারি আইপিপিগুলোকে ফার্নেস অয়েল আমদানির সুযোগ দেয়া হলেও শর্ত ছিল ১০-১২ শতাংশ ফার্নেস অয়েল বিপিসি থেকে নিতে হবে।
বিপিসির সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কম থাকলে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিপিসিকে তোয়াক্কা করতো না। তারা চুক্তির শর্ত মোতাবেক চাহিদার ১০-২০ শতাংশ জ্বালানি বিপিসি থেকে নেয়ার কথা থাকলেও নিত না। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি আইপিপিগুলো সেই শর্তকে পুঁজি করে বিপিসি থেকে ফার্নেস অয়েল নেয়া বাড়িয়ে দেয়।
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে বিপিসিও ফার্নেস অয়েল সরবরাহ করে আসছিল। ফার্নেস অয়েলের মজুদ এক্কেবারে কমে যাওয়ায় পিডিবির (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড) চাহিদা মোতাবেক ফার্নেস অয়েলের পরিবর্তে ডিজেল দেয়া শুরু করে বিপিসি। এতে আশংকাজনকভাবে কমতে শুরু করেছে ডিজেলের মজুদ।
এদিকে গত ৭ সেপ্টেম্বর পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) মো. আশরাফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রত্যয়নপত্রে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত পিডিবির আওতাধীন এবং অন্যান্য বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অগ্রিম প্রদান করে বিপিসি হতে ফার্নেস অয়েল গ্রহণ করবে। অন্যদিকে একইদিন বিপিসির চেয়ারম্যানকে দেয়া পিডিবি সচিব সাইফুল ইসলাম আজাদ স্বাক্ষরিত পত্রে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য দুই লক্ষ ৪৯ হাজার টন ডিজেল ও ২ লক্ষ ৮৬ হাজার টন ফার্নেস অয়েল চাহিদা দেয়া হয়েছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মাসের শুরু থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে বিপিসি ডিজেল সরবরাহ করেছে এক লক্ষ ৯৭ হাজার টন। ১৩ দিনে গড়ে সরবরাহ হয়েছে ১৫ হাজার টনের বেশি। এতে পিডিবির চাহিদা অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি ৫১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৩৯ হাজার ৫০০ টন ডিজেল ও ১৭ হাজার ৭শ টন ফার্নেস অয়েল সরবরাহ করে বিপিসি। অথচ গত বছর একই সময়ে ডিজেল বিক্রি হয়েছে এক লক্ষ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে সারাদেশে পদ্মা, মেঘনা, যমুনার টার্মিনাল ও ডিপোগুলোতে ডিজেলের মজুদ রয়েছে তিন লক্ষ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। যা দিয়ে দেশের মাত্র ২২ দিনের চাহিদা মেটানো সম্ভব। স্বাভাবিকভাবে বিপিসি ৪৫ দিনের জ্বালানি মজুদ রাখে। অন্যদিকে ফার্নেস অয়েলের মজুদ রয়েছে ২২ হাজার টনের মতো। যা দিয়ে মাত্র ১৫ দিনের চাহিদা মেটানো সম্ভব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পাওয়ার প্লান্টগুলো চুক্তির সুযোগ নিয়ে এখন বিপিসি থেকে ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল নেয়া শুরু করেছে। অথচ যখন দাম কম থাকে, তখন তারা চুক্তির বিষয়ে কর্ণপাত করেন না।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপিসি ভর্তুকিমূল্যে সারাদেশে জ্বালানি বিক্রি করছে। গত মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে জ্বালানির দাম ব্রেক ইভেন পয়েন্ট পেরিয়ে গেছে।’ এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে পরিশোধিত ডিজেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৭২ ডলার হলে বাংলাদেশে আমদানির পর যাবতীয় ব্যয় সংযোজিত হয়ে বিক্রি মূল্যের সমান হয়ে যায়। যাকে ‘ব্রেক ইভেন পয়েন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।’
বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) মণি লাল দাশ দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম ৭৮ দশমিক ৫ ডলারের কিছু বেশি। এর সাথে আমদানি ব্যয় যুক্ত করে ডিজেলের দাম নির্ধারণ করা হয়।’
বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) সৈয়দ মেহদি হাসান দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘পাওয়ার প্লান্টগুলো আগে ডিজেল নিতো না। এখন এলএনজি সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ডিজেল নিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় সাপ্লাইয়াররা অতিরিক্ত সরবরাহ দিতে রাজি হচ্ছেন না। তারপরও দুটো কার্গো ডিজেল আনার চেষ্টা করছি।’
তিনি বলেন, ‘পিডিবি আগে থেকে চাহিদাপত্র দেয়নি। গত সপ্তাহে চাহিদা দিয়েছে। পিডিবির চাহিদা মতো ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল সরবরাহ দেয়া হচ্ছে। এতে বিপিসি জ্বালানির স্বাভাবিক যে মজুদ রাখে, তার চেয়ে একটু কমেছে। তবে সেপ্টেম্বর মাসে আরও কার্গো আসলে সংকট কেটে যাবে।’