আমরা কি স্মৃতিভ্রষ্ট জেলিফিশ

মোস্তফা কামাল পাশা | শনিবার , ১৭ জুলাই, ২০২১ at ৭:০০ পূর্বাহ্ণ

অনুভূতিতে আঘাত নয়, ঘুমন্ত বিবেককে ঝাঁকি দিতেই এই লেখা। আমরা বড়রা হুজুগের সওয়ারী হলে ছোটদের কী হবে, কী হবে তরুণ প্রজন্মের? ওদের বড় অংশ আমাদের ভুলে এমনিতেই সাইবার আসক্তিতে ধুঁকছে। এমন চললে দেশপ্রেম শব্দের অর্থ খুঁজে নিতে তাদের সামনে অভিধান ঘাঁটাঘাঁটি করা ছাড়া বিকল্প থাকবেইনা। দায়টা নেবে কে? আমরা এমন সন্তান বা প্রজন্ম কি চাই? নিশ্চয়ই না। তাহলে ভয়াল দুঃসময়ে কোপা কাপ ফাইনাল নিয়ে এত হুজুগ কেন হলো দেশজুড়ে? বিপরীতে ইউরো কাপের খবর ক’জনইবা জানি?
ফিরে দেখা: টানা পাঁচবারের বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ডগড়া ব্রাজিলের ’৯৪ বিশ্বকাপ জয়ের সাথে নিজের অনেক মধুর স্মৃতি। বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ধামাক্কার সাথে-সাথেই পেয়ে যাই এক ব্রাজিল সুন্দরীকেও। তার সাক্ষাৎকারটি পুরো দেশের মানুষের পাতে ঘিয়ে ভাজা টাটকা ফুলকো লুচির সুবাস ছড়িয়েছিল। আজাদীর পর দেশের অনেকগুলো মিডিয়ায়ও। ব্রাজিল ফুটবলের সৌজন্যে ঘুরে আসার সুযোগও হয়, আমাজান রহস্যপুরি ভয়ঙ্কর সুন্দর ব্রাজিল। ব্রাজিল সুন্দরীটিই সব আয়োজন ও যোগাযোগ করে দেন। দুঃখ, ওর নামটাও ভুলে গেছি। মেয়েটাও স্মৃতির ধূসর ফসিল এখন। কোন অতিকায় মানুষের সাথে ছবি নেই, রাখিও না। এখনো ও’পথে হাঁটি না। আমি আমার মতই আছি-থেকেছি সবসময়! ভিভিআইপির লেজ ঝুলে প্রদর্শনীতে বড্ডো অরুচি। কিন্তু সুন্দরীর কিছু ছবি কীভাবে যেন থেকে গেছে, পারিবারিক অ্যালবামের খোপে! অথচ ’৮০ দশকের দুঃসহ দিনে প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার সাথে প্রচুর ছবি ছিল। সাংবাদিকতা ও রাজনীতি দু’সূত্রেই। ফটো সাংবাদিক দেবুদা ও তাপসের তোলাই বেশি। তাপস বড়ুয়া ছুটিতে থাকায় ব্রাজিল কন্যার সাথে সাক্ষাৎকারের ছবি নিতে স্পর্শকাতরতার কারণে ফটো সাংবাদিক মন্‌জুর কাদেরকে বেছে নিই [এটিএন বাংলার চট্টগ্রাম অফিসের উপ প্রধান ও প্রেসক্লাবের সহ সভাপতি এখন]। আজাদীর আইটেম প্রকাশের আগে মুখ না খোলার শর্তে। সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়, আওয়ামী লীগ নেতা, স্টিভেডরিং ও শিপিং ব্যবসায়ী বন্ধুবর আবু সাঈদের আগ্রাবাদস্থ সী-কোস্ট শিপিং অফিসের চেম্বারে। বিশ্বকাপ জয়ের একদিন পর মাঠ উত্তপ্ত থাকতেই দৈনিক আজাদীর শেষ পৃষ্ঠার টপ আইটেম হিসেবে আমাদের ছবিসহ গুরুত্ব দিয়ে তিন কলামজুড়ে আইটেমটি ছাপা হয় খুবই গোপন অ্যাসাইনমেন্ট ছিল এটা। আজাদীর পক্ষে আমি ছাড়া কাকপক্ষীও জানতো না যে, চট্টগ্রামে ব্রাজিলের এমন প্রিয়দর্শিনী মজুদ ছিলেন। আগে থেকেই ব্রাজিলের ছন্দময় নান্দনিক ফুটবলের ভক্ত-এখনো। কিন্তু এটাতো বিশ্বকাপও ছিল না! আবার নারায়নগঞ্জে হাসেম ফুডস-এর সিজান জুস কারখানায় আগুনে পুড়ে ৫২ নিরীহ শ্রমিকের পোড়া হাড়গোড় উদ্ধারের মত বুক ভাঙা বিভীষিকার পর পরই আমরা এ কী দেখলাম!
কেন এমন অমানবিক উল্লাস-হুল্লোড়! তাও পৃথিবীর অন্য প্রান্তে লাতিনের কোপা ফুটবল কাপ ফাইনাল নিয়ে! তুলনায় অনেক কাছে ইউরো কাপও চলেছে, ওটার খবরতো রাখিনি। দুঃসহ মৃত্যুগুহায় বসে দেশে কিছু মানুষের এত নাচানাচি-হুল্লোড় অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। কোপা নিয়েতো এত কোপাকুপি-চাপাতিবাজি আগে কখনো হয়নি! কতো তালেবর, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীও ফে’বুসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাঁপন তুলছেন। আমরা বিবেক- মানবতা ঝেড়ে ফেলে রোবট হয়ে গেছি? নাকি স্মৃতিভ্রষ্ট জেলিফিশ! নিজের ন্যূনতম আগ্রহ ছিল না- খেলাও দেখিনি। জাহান্নামের আগুনে বসে বাঁশিতে সূর তোলার কবিতা নজরুল লিখেছেন, সত্য। কিন্তু দিনে ২৫০ ছুঁই ছুঁই লাশ ও ৫২ শ্রমিকের পোড়া হাড়গোড় আগলাতে হয়নি তাঁর জমানায়। তাও করোনার মত অচ্ছুৎ ও অস্বাভাবিক এক অতিমারির কালোমেঘ জমাট বাঁধার সময়! যাঁরা মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হচ্ছেন, তাঁরা আমাদেরই ভাই বেরাদর। যেকোন সময় নিজের ডাকও আসতে পারে। তাহলে লাতিনের সুদূর আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল না চিনেও আমরা কী করেছি, এসব? আমাদের দেশপ্রেম কী মুছে গেছে? তাজা ফুসফুসের খোলসের উপর হাত রেখে আসুন প্রশ্নটা নিজকে করি। কেউ যদি ধরে নেন, ব্রাজিল কাপ জিতেনি বলে মনোকষ্টে এমন লেখা, একদম ভুল। তখনো একই কথা লিখতাম। কারণ এটাই দেশপ্রেম। ওই দু-দেশে খুব অল্প মানুষ ছাড়া কেউ বাংলাদেশ চিনেই না। অথচ ভোররাতে আমাদের চারপাশের অস্বাভাবিক শোরগোলে দুই বছরের শিশুটিও এখন আর্জেন্টিনা ব্রাজিলকে চিনে ফেলেছে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজলপিপি
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে