সাবেক কর্মকর্তা হিসেবে রেলওয়ের এই সিদ্ধান্তে আমি খুবই ক্ষুব্ধ
মোঃ শফিকুল আলম খান
চারদিকে গাছগাছালি, পাহাড় আর সবুজে ভরা চট্টগ্রাম নগরীর অন্যতম প্রাণকেন্দ্র সিআরবি এলাকা। স্বাস্থ্যকর স্থান হিসেবে যুগ যুগ ধরে ভ্রমণ পিপাসুদের বিনোদনের স্থান, এই সিআরবি এলাকায় প্রতিদিন ধর্ম,বর্ণ, শ্রেণী ও পেশা নির্বিশেষে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ ঘুরে বেড়ায়। উপভোগ করে প্রকৃতির শান্ত স্নিগ্ধ অপার সৌন্দর্য। আর এখানেই দৃষ্টি পড়েছে অতি লোভী ব্যবসায়িক হায়েনাদের। রেলওয়ের সাথে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজের সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য যে চুক্তি হয়েছে তাতে রেলওয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে আমি খুবই ক্ষুব্ধ। আমি রেল কর্তৃপক্ষের এই অদূরদর্শী সিদ্ধান্তে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছি। আমি মনে করি চুক্তি অনুযায়ী এখানে কথিত হাসপাতাল ও কলেজ স্থাপন করা হলে এই এলাকার শান্ত, সুন্দর নির্মল পরিবেশ বিঘ্নিত হয়ে এখানে সৃষ্টি হবে কোলাহলময় সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ। অন্যদিকে হাসপাতালের বর্জ্য সমস্ত পরিবেশকে মারাত্মক হুমকির দিকে নিয়ে যাবে।
গত বুধবার দৈনিক আজাদী পত্রিকায় ছাপানো এক বিজ্ঞপ্তিতে রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন পঞ্চাশ বছর পর সম্পূর্ণ হাসপাতাল রেলওয়ের নিকট হস্তান্তর করা হবে। যা সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য। আরো বলা হয়েছে রেলওয়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারবেন। আমি মনে করি এই শর্ত শুধু কাগজে কলমে থাকে। কোন সময় তা বাস্তবায়ন হয় না।
অনুরূপভাবে উনিশশ পঁচাশি সালে পাহাড়তলীতে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের জন্য একশ টাকা প্রতীকি মূল্যে ইউএসটিসিকে রেলওয়ের বিশাল জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। তখন অনেক শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল প্রতিবছর রেলওয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সন্তানদের মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য কিছু আসন সংরক্ষিত থাকবে এবং হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ পাবে। আমার জানা মতে শর্তের বেড়া জালে রেলওয়ের কোন পোষ্য উক্ত কলেজে ভর্তি বা হাসপাতালে সেবা নেয়ার সুযোগ পায় নি। চাকুরীকালীন অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে তাদের সন্তানদের যোগ্যতা থাকা সত্বেও উক্ত মেডিকেল কলেজে ভর্তি করতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখেছি। আর বতর্মান প্রজম্মের চাকুরীজীবীরা জানেন না যে তাদের জন্য এই সুবিধা এখনো বিদ্যমান। একইভাবে ফয়’স লেক, ইঞ্জিনির্য়াস ইনস্টিটিউট, লেডিস ক্লাবসহ অনেক প্রতিষ্ঠানকে প্রতীকী মূল্যে রেলওয়ের জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্ত ঐ সমস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে রেলওয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ কোন সুযোগ সুবিধা পায় না।
আমরা জানি বর্তমানে সিআর বি এলাকায় অবস্থিত রেলওয়ে হাসপাতালে চিকিৎসার সমস্ত সুযোগ সুবিধা বিদ্যমান। একসময় চিকিৎসা সেবায় এই হাসপাতালের বেশ সুনাম ছিল। কিন্ত কালক্রমে তা হারিয়ে গেছে। আমি মনে করি এই হাসপাতাল আধুনিকতার ছোঁয়া পেলে রেলওয়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে।
কিছুদিন পূর্বেও দেখেছি রেলওয়ের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন সিআরবি এলাকায় বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মানে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল। এখন মনে হয় তাদের আন্দোলনে কিছুটা ভাটা পড়েছে। আমি তাদেরকে আরো প্রতিবাদমুখর হওয়ার আহবান জানাচ্ছি। সাথে সাথে আশা করি রেলওয়ে সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী চট্টলবাসীর প্রাণের দাবী সিআরবি এলাকা রক্ষার্থে মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন। উল্লেখ্য যে তারই নির্দেশনা ও তত্বাবধানে এই এলাকাকে নান্দনিকরূপে সাজানো হয়েছে। যার সুফল ভ্রমণপিপাসুরা প্রতিনিয়ত ভোগ করছেন।
প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র রুখতে হবে
মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী
নিজের উপরেই ঘেন্না লাগছে। এত অধ:পতন কেন আমাদের। এই একটিমাত্র স্থান আছে যেখানে বাচ্চারা দম নিতে পারে ওখানেই চোখ গিয়ে পড়লো। যারা উদ্যোগটা নিচ্ছেন ওরা কেমন মানুষ খুব জানতে ইচ্ছে করে। প্রতিরোধ চাই।
বাংলাদেশ রেলওয়ে যে ব্যাখাটা দিয়েছে তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। চট্টগ্রামে রেলওয়ের জায়গার কি অভাব হয়েছে। সিআরবিতেই কেন হাসপাতালটা করতে হবে? চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশী বেদখল জায়গা রেলওয়ের। সেখানে ইচ্ছা করে সুন্দর একটা প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র।
হোক প্রতিবাদ, রক্ষা পাক সিআরবি
শিরিন আফরোজ
পাহাড়-পর্বত ঘেরা প্রাকৃতিক সুন্দরে ভরপুর প্রাণের শহর চট্টগ্রাম।এ প্রিয় শহরটির ফুসফুস নানান গাছগাছালিতে ভরা সকলের ভালোলাগার স্থান সিআরবি। খেলাধুলা, নানান সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং মানুষের অবসর সময়ে খোলা আকাশের নীচে প্রাণভরে নি:শ্বাস নেওয়ার শান্তিময় স্থান সিআরবি। শতবর্ষী বৃক্ষ সাথে আরও সব বৃক্ষরাজগুলো বেঁচে থাকুক, কোন আঘাতে আহত না হউক চট্টগ্রামের ফুসফুস তুল্য সিআরবি। রক্ষা পাক সিআরবি, আহত না হোক চট্টগ্রামের ফুসফুস, আহত না হোক চট্টগ্রামবাসীর চাওয়া ।
রুখে দাঁড়াও প্রিয় চট্টলবাসী
জোবায়দা আক্তার চৌধুরী
সিআরবি ‘র শিরীষতলা আমাদের ভালোবাসা এবং আবেগের একটি জায়গা। চট্টগ্রামবাসীর এমন কেউ নেই যে যার মধুর কোনও স্মৃতি জড়িত নেই এই সিআরবিতে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই শুধু শতবর্ষী বৃক্ষরাজির জন্যেই নয় শিল্প সংস্কৃতি আর ইতিহাসের কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাত রাস্তার মোড় চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সিআরবি।
আজ সেই ফুসফুসকে আক্রমণ করতে একদল সুবিধালোভীদের কোলো ছায়া পড়েছে। আজ পুরো চট্টগ্রামবাসীকে এক হয়ে সেই কালো ছায়াকে রুখতে হবে। বাংলাদেশের এমন অন্যতম একটি ঐতিহ্যবাহী সিআরবিকে ধ্বংস করে হাসপাতাল নির্মাণ করার সিদ্ধান্তটা অত্যন্ত আত্মঘাতী এবং হঠকারী সিদ্ধান্ত। এর তীব্র নিন্দা জানাই। তাই বলে হাসপাতাল নির্মাণে বিরোধিতা করছি না। তবে হাসপাতাল নির্মাণের সদিচ্ছা থাকলে চট্টগ্রামে অনেক পরিত্যাক্ত জায়গা পরে আছে, সেখানে করা যায়। তার জন্য সুন্দর কে খুন করে হাসপাতাল? কক্ষনো সেটা মেনে নেয়া যায় না। তিলোত্তমা চট্টগ্রাম শহর কে এভাবে আর নষ্ট হতে দেয়া যাবে না।
সিআরবি থেকে বের হয়ে চট্টগ্রাম রেল স্টেশনের দিকে যাওয়ার রাস্তাটা আগে প্রশস্ত ছিল। পুরো সিআরবি ঘুরে ঐ পথ দিয়ে যেতে বুক ভরে নি:শ্বাস নেয়া যেতো। মাথার উপর সীমাহীন আকাশের দিকে তাকালেই বুকটা ভরে যেতো। বর্তমানে এখন আর আকাশ দেখি না। আকাশটাও যেন কংক্রিটের দখলে। চট্টগ্রামে কী বুক ভরে আর নি:শ্বাসও নিতে পারবো না? সব কী তাহলে কংক্রিটের দখলে চলে যাবে?
কালো একটি চক্র খেলার মাঠগুলোকেও গিলে খেয়েছে। তাহলে ছেলেপেলেরা খেলাধুলা করবে কোথায়? আমরা তো এই প্রজন্মকে অথর্ব করে ফেলছি একরকম। এ কোন প্রজন্ম আমরা গড়ে তুলছি? এর জন্য কারা দায়ী? তাই বলছি শুধু শতবর্ষী গাছ রক্ষার আন্দোলন করলেই হবে না। সবাই কে এক জোট হয়ে পুরো সিআরবিকে অক্ষত রেখে গোটা চট্টগ্রামকে রক্ষা করতে হবে। সুরক্ষিত থাকুক আমার প্রাণের সিআরবি, সবুজ সুন্দরে ভরে থাক আমারও আমাদের চট্টগ্রাম ।
শিরীষতলা রক্ষায় শুভবোধের জয় হোক
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
চট্টগ্রামের ক্রমশ অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠা নাগরিক পরিবেশকে যে কয়টি স্বাস্থ্যকর স্থান আশার আলো দেখিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে, তারমধ্যে ঐতিহাসিক সিআরবি সংলগ্ন শিরীষতলা অন্যতম। বলা যায় এটি নগরীর ‘ফুসফুস’। যান্ত্রিক জীবনের যন্ত্রণাকে পাশ কাটিয়ে পরিবার নিয়ে মানুষজন এখানেই আসে প্রকৃতির কাছে বুক ভরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে। বর্ষবরণের মতো বর্ণিল অনুষ্ঠানে শেকড়ের টানে এখানে মানুষের উৎসব মুখরতায় ঢল নামে। যখন সবুজের সংকটে জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবেলায় বাংলাদেশ হিমশিম খাচ্ছে তখন নগরীর সুস্থতাকে হত্যা করে এখানে হাসপাতালের নামে পরিবেশ বিরোধী কর্মকাণ্ড চলতে দেয়া যায় না। চট্টগ্রামের মতো বন্দরনগরীতে হাসপাতাল নির্মাণের জন্যে রেলের পর্যাপ্ত বিকল্প জায়গা আছে যা অহরহ দৃশ্যমান।
এইসব বিকল্পকে পাশ কাটিয়ে নগরবাসীর বেঁচে থাকার প্রেরণায় হাত দিয়ে তা নষ্ট করা মানেই হলো জনগণকে তিলে তিলে হত্যার শামিল। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই এবং রেল কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি। প্রয়োজনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করছি। আশাকরি শুভবোধের জয় হবে।
সিআরবিতে নতুন কোনো হাসপাতাল নয়
রুনা তাসমিনা
সিআরবিতে কোনো হাসপাতাল হোক তা চাই না। এমনিতেই বড় বড় দালানের মধ্যে চাপা পড়ে নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গা নেই চট্টগ্রামে। তার মধ্যে সিআরবি একটি স্বস্তির জায়গা। এক টুকরো প্রশান্তি চট্টগ্রামবাসীদের কাছে। যে অক্সিজেনের জন্য আজ লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যু বরণ করছে, সেই অক্সিজেনদাতা সবুজকেই ধ্বংস করার পাঁয়তারা চলছে। এর বিরুদ্ধে আমরা কঠোর প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’- এই শ্লোগানের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে আমরা যখন নতুন গাছ লাগিয়ে আমাদের শহর সবুজ করার চেষ্টা করছি, তখন নেয়া হচ্ছে সিআরবির সবুজ নিধন করে হাসপাতাল বানানোর উদ্যোগ। শহরের সবুজ, সৌন্দর্য ধ্বংস করার এই উদ্যোগ যারা নিয়েছে তদন্ত হোক তাদের বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম শহরের আশপাশে বহু জায়গা আছে। হাসপাতাল করলে ওরা সেখানে করুক। চট্টগ্রাম শহরে ভিআইপি হাসপাতাল অনেক আছে। যেখানে চিকিৎসা করার সাধ্য সাধারণ মানুষের নেই। হাসপাতাল একটি সেবা প্রতিষ্ঠান। তারা যদি মানুষের সেবাই করতে চাই, চট্টগ্রাম শহরের বাইরে করুন। মান ঠিক রেখে সেবা করুন সাধারণ মানুষের। কতটুকু জায়গা আছে চট্টগ্রাম শহরের বুকে! দালানকোঠায় গিজগিজ করা এই শহরের প্রাণ সিআরবি। এই গাছগুলোর নিচে যেমন শীতল ছায়া, দূর থেকে তেমনি অপূর্ব সুন্দর। ইট-পাথরের বদ্ধ জীবনে সিআরবির সবুজ শহুরে জীবনের প্রশান্তি। স্বাস্থ্য সুস্থ রাখার জন্য প্রাতঃভ্রমণ, বিকেলে হাঁটার জন্য শহরের বাসিন্দাদের অন্যতম একটি জায়গা সিআরবি। এই ছোট্ট জায়গায়ও লোভের হিংস্র থাবা। তাছাড়া রেলওয়ের একটি হাসপাতাল ওখানে আছে। ওই হাসপাতালটাকে আরো সংস্কার করে চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হোক। ইতিহাস নিধন করে নতুন আর কোনো হাসপাতাল চাই না এখানে। এই উদ্যোগ যারাই নিয়ে থাকুক, আমরা সমস্ত চট্টগ্রামবাসী এর বিরুদ্ধে।
শিরীষতলা না গোয়ালপাড়া!
নাজমুল হক ডিউক
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও চট্টগ্রামের বহুল পঠিত ঐতিহ্যবাহী দৈনিক আজাদী পত্রিকার বড় অংশ জুড়ে গত দুদিন চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পোস্ট এবং প্রতিক্রিয়া আমার মনে কিছু প্রশ্নের উদ্বেগ ঘটিয়েছে তারই একটি ‘শিরীষতলা না গোয়াল পাড়া’।
দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় ‘নাগরিক মতামত” চেয়ে যে ছবিটি দেওয়া হয়েছে সেটি শিরীষতলার এবং বিভিন্ন বিদগ্ধজনের ফেসবুক পেইজ থেকে হাসপাতালের জন্য নির্ধারিত স্থানকে দেখানো হয়েছে শিরীষতলাকে। অন্যদিকে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দৈনিক আজাদীর শেষ পৃষ্ঠায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপন দিয়ে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য সিআরবি রেলওয়ের নিজস্ব হাসপাতালের পাশে গোয়ালপাড়া এলাকাকে নির্ধারণ করা হয়েছে। গতকাল হিউমান রাইটস ফাউন্ডেশন নামক একটি সংস্থা ও আজ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃবৃন্দ যে স্থানটিতে নতুন করে বৃক্ষরোপণ করেছে এবং যে স্থানটিতে পরিবেশ সংকটাপন্ন বা রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণার দাবি করেছে সে স্থানটি শিরীষতলা নয়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের বক্তব্যে উল্লেখ করেছে, ‘প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত স্থানে বর্তমানে রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অতি পুরাতন ও জরাজীর্ণ বাসাবাড়ি বিদ্যমান। সেখানে শতবর্ষী কোন গাছ বিদ্যমান নাই। উক্ত স্থানে বিদ্যমান গাছ ও ভূমিরূপ এর অবয়ব ঠিক রেখেই হাসপাতালটি নির্মাণ করা হবে।’ আমরা সকলেই জানি ‘ফুসফুস’, শ্বসনতন্ত্রের প্রধান অঙ্গ যার মাধ্যমে মানবদেহ প্রতিনিয়ত শ্বাসকার্য চালায়। ১৭০ বর্গমাইলের প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের এই জনপদ- চট্টগ্রামের ফুসফুস যদি মাত্র ৬ একর জায়গা হয় তবে তা এই চট্টগ্রামকে হেয় করারই নামান্তর। একটি সংগঠন তাদের বিবৃতির শেষাংশে বলেছে, ‘হাসপাতাল নির্মাণের নামে রেলওয়ে সিআরবি কে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে চট্টগ্রাম বিদ্বেষী একটি দুষ্টচক্র। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার ছিল এই সিআরবি। সিআরবি’র এই ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা চট্টগ্রামবাসী কখনো মেনে নেবে না।’আমার কৌতূহল, আমরা কি ঐতিহ্য রক্ষার জন্য আবার ‘আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে’ নামকরণে ফিরে যাবো? এমনতর অসংখ্য বক্তব্য, বিবৃতি ও স্ট্যাটাস দিয়ে বর্তমানের এই অতিমারীর সময়কালে যখন চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য সেবার মান নিয়ে, ব্যাপ্তি ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে-একই মানুষদের সীমাহীন ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, ট্রোল ও সরকারের সমালোচনা তখন একটি আধুনিক উন্নতমানের ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা যা ২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল কেবিনেট কমিটি অফ ইকনোমিক (সিসিইএ) কর্তৃক অনুমোদিত তাকে চটকদার কথামালায় বিধৃত না করে আসুন টেকসই উন্নয়ন ও সত্যিকারের মানবিকতা বোধের মাধ্যমে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সহায়তা করি।
শিরিষতলায় হাসপাতাল নয়, হোক অন্য কোথাও
আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলী
চট্টগ্রামের শিল্প সাহিত্য সংংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ এবং সাধারণ জনগণ একটি হাসপাতাল নির্মাণের স্থানের বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং সেই জায়গায় হাসপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধে উচ্চকিত, সরব এবং একাত্ম। এর যথেষ্ট কারণ আছে। প্রথমত যুগের ও বেশি সময় ধরে এলাকাটি চট্টগ্রামের শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষের চারণভূমি হয়ে দাড়িয়েছে। সুপরিসর এই শিরিষতলায় আছে আলো আছে বায়ু আছে প্রাণ। ইট কাঠের নগরীর মানুষ একটু বিশুদ্ধ অক্সিজেন একটু প্রাণ, একটু সবুজের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য শিরিষতলাকেই বেছে নেয়। শিরিষতলা নামটিও সংস্কৃতিসেবীদের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়ে প্রাণের নামে পরিণত হয়েছে। এখানে উদযাপন হয় পয়লা বৈশাখের মতো বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। উদযাপন করা হয় বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশেসৃজনশীল অনুসঠান। এই স্থানেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর বিশাল আয়োজনের একটি অংশ পালন করা হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী কোভিড ১৯ এর অতিমারি আঘাত না করলে বিভিন্ন সংগঠনের মুজিব বর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনেক অনুসঠান করার পরিকল্পনা ছিল এই শিরিষ তলায়। স্বাধীনতার পর থেকেই চট্টগ্রাম শহরের পরিসর ধীরে ধীরে বেড়েছে। সবুজ এই নগরীর খেলার মাঠ উন্মুক্ত স্থানগুলো আজ ইটকাঠের দালানের দখলে। শিরিষ তলার এই জায়গায় বিকেলে সাধারণ মানুষ হাটে, আমাদের সন্তানেরা ফুটবল ক্রিকেট খেলে। নগরের মূল উপকন্ঠে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা নয়নাভিরাম এই স্থান। প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপ এর আওতায় সরকার এই জায়গায় একটি হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন যা কোভিড ১৯ এর ক্রান্তিকালে আশাজাগানিয়া হলেও শিরিষতলা তথা চট্টগ্রামের শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষের জন্য দুঃসংবাদ। আর দ্বিতীয়ত যে হাসপাতালটি নির্মাণ করা হবে সেটিতে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা নেয়ার সামর্থ্য থাকবে কি? আমরা চাই না চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্রের এই প্রাকৃতিক অক্সিজেন সেন্টার ও শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশের এই স্থানে কোন হাসপাতাল হোক।
সিআরবিতে হাসপাতাল নয়
মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ
বিভিন্ন জায়গা থেকে গিয়ে বটবৃক্ষের তলায় একটু বিশ্রাম নেন মানুষ। বিনোদনের জায়গা সিআরবি। পর্যটকেরা দূর দূরান্ত থেকে এসে স্মৃতিগুলো উপভোগ করেন। রেলওয়ের অনেক জায়গা আছে। হাসপাতাল অন্য জায়গায় করা যেতে পারে।চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় বড় হাসপাতাল নেই। কোরিয়ান ফ্রি জোন দেওয়ান পাহাড়ে হাসপাতাল করা যেতে পারে। চট্টগ্রাম শহরকে তার স্মৃতি দিয়ে ধরা রাখুন। পাহাড় কেটে শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করা হচ্ছে। নদী ও পাহাড় বেষ্টিত চট্টগ্রাম শহর। গাছ পালা কাটা হচ্ছে। কর্ণফুলীর তীরে বাসস্থান নির্মাণ করে নদী ভরাট করে জলবদ্ধতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। পুরানো স্মৃতি কিছু না থাকলে চট্টগ্রামের ইতিহাস মুছে যাবে। স্মৃতির জন্য ভারতে বাদশাহ শাহজাহান “মমতাজ মহল” তৈরী করেছেন। যা পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম। সিআরবির অনেক জায়গা খালি পরে আছে। ওখানে বড় হাসপাতাল করা যেতে পারে। আওয়ামীলীগ সরকারের বর্তমানে অনেক অর্জন। নেত্রীর সুনাম নষ্ট করার জন্য ষড়যন্ত্রকারীরা হাসপাতালের নামে সরকারের বিরুদ্ধে একটা ইস্যু তৈরি করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে। সিআরবিতে শত বৎসরের পুরাতন বটবৃক্ষ কেটে হাসপাতাল নয়। শীঘ্রই বন্ধ করুন।
বিশাল স্থাপনার চাপে মৃত্যু হবে সিআরবির সৌন্দর্যের
মুহাম্মদ মুসা খান
মনে রাখা দরকার যে, চট্টগ্রামের মানুষ হাসপাতালের বিরোধিতা করছেন না, মানুষ চায় হাসপাতালটা অন্যত্র করা হোক।
বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী সেখানে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল, ১০০ সীটের মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউট হবে। এই আয়োজনকে ঘিরে প্রয়োজন হবে, চিকিৎসক-নার্সদের জন্য ডরমিটরি, ক্যান্টিন, সিকিউরিটিদের জন্য ব্যারাক, খাবার হোটেল, অফিস, ক্লাব, পার্কিং এরিয়া আরও অনেক কিছু। এতগুলো স্থাপনা যেখানে হবে, সেখানে কি পরিমাণ গাড়ির আনাগোনা হবে-তা কল্পনা করতেই গা শিউরে উঠে। আমাদের মনে হয়, ‘হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ কমপ্লেঙ নির্মাণকালীন সময়েই রড-সিমেন্ট-বালি ও ট্রাকের ধুলোবালির বন্যায় সিআরবি’র সৌন্দর্য মৃত্যুবরণ করবে’।
হাসপাতাল চালু হওয়ার পরবর্তী সময়ের চিত্রটা একটু কল্পনা করা যেতে পারে। হাসপাতাল চালু হওয়ার পর এই এলাকাতে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ যানজট আর ধুলোর রাজ্যে গদ্যময় চিত্র ধারণ করবে সিআরবি। তখন প্রাতঃ বা সান্ধ্য ভ্রমণকারিরা পালিয়ে কুল পাবে না। এর সাথে চমেক হাসপাতালের সামনের বর্তমান চিত্র মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। চমেক হাসপাতালের সামনে দিয়ে মানুষ যানজটের কারনে এখন পারত পক্ষে গাড়ি নিয়ে যান না। সিআরবি’র চিত্রও একই দাঁড়াবে, যাতে কোন সন্দেহ নেই।
সিআরবি’তে প্রাইভেট হাসপাতালের বিরোধিতার এই আন্দোলন শুধুমাত্র শতবর্ষী গাছ রক্ষার আন্দোলন নয়। গাছের প্রসংগটি একটা মাত্র বিষয়। মূলত সিআরবি এলাকাটি আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের চিহ্ন এই সিআরবি, প্রাকৃতিক কারণে এটাকে চট্টগ্রামের ফুসফুস বলা হয়, যা অস্বীকার করার উপায় নাই। আর, চট্টগ্রামের মানুষদের এটুকু জায়গা মাত্র একটু নিঃশ্বাস নেয়ার। সব মিলিয়ে এই সিআরবিকে অক্ষত রাখা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা আউটার স্টেডিয়াম খেয়েছি, সার্কিট হাউজের সামনের মাঠ খেয়েছি, ফয়েজ লেক খেয়েছি, টাইগারপাসের সৌন্দর্য খাবো খাবো করছি, সিআরবিকে অন্তত রেহাই দিই। আমরা আশা করবো, রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। ইউনাইটেড গ্রুপের সাথে সম্পাদিত চুক্তির প্রস্তাবিত ‘হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ’ রেলওয়ে শ্রমিকলীগের প্রস্তাব অনুযায়ী ফৌজদারহাটে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের ওখানে স্থানান্তর করা হবে।
রেলওয়ের বক্তব্য শাক দিয়ে মাছ ঢাকার নামান্তর
শফিক সোহাগ
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকল্প পরিচালক ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আহসান জাবির ১৪ জুলাই তারিখে দৈনিক আজাদী পত্রিকায় বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন গাছ এবং ভূমির অবয়ব ঠিক রেখেই হাসপাতাল হবে, এতে পরিবেশ প্রকৃতি বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কোনো প্রতিবন্ধকতা ঘটবে না। ইতিমধ্যে অনেক প্রভাবশালীর বক্তব্যেও এই যুক্তিটি অস্পষ্ট ভাবে ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে। এক সময় হয়তো এই যুক্তির উপর ভিত্তি করেই চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও সাংস্কৃতিকপ্রেমী মানুষের প্রাণের দাবিকে তাচ্ছিল্য করে হাসপাতালের কাজ এগিয়ে যাবে। যুক্তিটি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার স্বরূপ। বলা হচ্ছে হাসপাতালের জন্য পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। ভেবে দেখুন তো সবুজে শ্যামলে ভরপুর নয়নাভিরাম পরিবেশে যদি রোগ জীবাণুতে ভরপুর হাসপাতাল স্থাপন হয় আমরা কি পারবো প্রাণ ভরে একটু বিশুদ্ধ নিঃশ্বাস নিতে? হাসপাতালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে দোকানপাট, বাড়বে মানুষের ভিড়। আমরা কি পারবো সারাদিনের কাজ শেষে বিকেল বেলায় ঐ পরিবেশে গিয়ে সমস্ত ক্লান্তি ঝেড়ে আসতে?
শিরিষতলা ভালোবাসার নাম, তাকে রক্ষা করতে হবে
হৈমন্তী তালুকদার
শহরে বসবাস করা একসময় আনন্দের ছিল আর এখন দমবন্ধ জীবন মনে হয়। করোনার চলমান দুই বছর ধরে বাচ্চাদের জন্য কোথাও কোন বিনোদনের জায়গা পছন্দ করা নিরাপদ নয়, আমরা বড়রা না হয় নিজেকে বুঝিয়ে নিই, কিন্তু কোমলমতি বাচ্চারা কোথায় একটু মুক্ত হাওয়ায় ঘুরবে সেই জায়াগা নেই বললেই চলে। ডিসি হিল আর সিআরবি শিরিষতলা নববর্ষের সময় পহেলা ফাগুনে এক আনন্দঘন আবহে থাকে। করোনার পর থেকে সব বন্ধ হলেও মানুষ শারীরিক চর্চা ও মানসিক বিনোদনের জন্য মুক্ত হাওয়ায় দমবন্ধ জীবন থেকে ক্লান্তি, হতাশা, একঘেয়ে থেকে মন ভরে সস্তির নিশ্বাস নিতে সিআরবিতে সবুজবীথিকে খুঁজে নেয়। বটবৃক্ষের ছায়ায় বসে নিত্যজীবনের একঘেয়ে গুলো পরিবারের সাথে, বন্ধুদের সাথে ভাগাভাগি করে নেয় মনের উচ্ছলতায়। সংস্কৃতির চর্চার প্রাণবন্ত জায়াগা সিআরবিতে ৫০০শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল ও ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ নির্মাণের জন্য সিআরবি জায়গা নির্বাচন করা হয়, এই চুক্তি রেলওয়ে কতৃপক্ষের সাথে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষের সাথে হতেই পারে। কিন্তু হওয়ার পক্ষে ক’জন মানুষ আর বিপক্ষে ক’জন মানুষ জনসাধারণের মতামত জরিপে হয়তো এই হাসপাতাল নির্মাণের বিপক্ষের মানুষই বেশী হবে।
হাসপাতাল নির্মানের বিপক্ষে কেউ নন, মনেরও মাঝেমধ্যে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, আর তার জন্য দরকার খোলা আকাশের নিচে সবুজের নির্মল ভালোবাসা। সিআরবির শিরিষতলা সেই ভালোবাসার নাম। ইউনাইটেড হাসপাতাল নির্মাণের জায়গা থেকে সিআরবি মুক্ত থাকুক। সবুজবীথি রক্ষা হোক। সাধারণ জনগণের পক্ষে কলমেই প্রতিবাদ জানাই।