পাথরঘাটার ‘মটকা বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা বাড়িটি সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাড়িটিতে আর কোনো ধরনের ভাঙাভাঙি না করার জন্যও নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। যেভাবে আছে ঠিক ওভাবেই মটকাসহ বাড়িটি প্রত্নসম্পদ হিসেবে সংরক্ষণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। গতকাল বিভাগীয় কমিশনার, সিডিএ চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক দুইশ’ বছরেরও বেশি পুরোনো বাড়িটি পরিদর্শন করেন এবং সব ধরনের ভাঙাভাঙি বন্ধ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। দৈনিক আজাদী গত ৮ জুলাই ‘ভবনের নিচে সারি সারি মটকা, গুপ্তধন না অন্যকিছু টান টান উত্তেজনা, পাথরঘাটার নজুমিয়া লেন’ শীর্ষক এক্সক্লুসিভ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রধানমন্ত্রী দৈনিক আজাদীতে খবরটির বিস্তারিত দেখার পর চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার, সিডিএ চেয়ারম্যান এবং জেলা প্রশাসককে বাড়িটি সংরক্ষণের নির্দেশনা প্রদান করেন।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রেক্ষিতে গতকাল চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার কামরুল হাসান, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ এবং চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোমিনুর রহমান বাড়িটি পরিদর্শন করতে যান। দুইশ’ বছরেরও বেশি সময়ের পুরোনো বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন চট্টগ্রামের বনেদি ব্যবসায়ী হাজী শরিয়ত উল্ল্যাহ। ওই সময়ে পঁচিশ হাজার টাকা ব্যয় করে তিনি ভবনটি নির্মাণ করেন। রেঙ্গুনের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতেন ব্যবসায়ী হাজী শরিয়ত উল্ল্যাহ। নিজস্ব দুইটি জাহাজ ছিল তাঁর। তিনি জাহাজে করে বিপুল পরিমাণ মাটির মটকা রেঙ্গুন থেকে নিয়ে এসেছিলেন। ভবন নির্মাণের সময় ভিটির তলায় উপুড় করে মটকাগুলো স্থাপন করার পর ইট সুরকির ঢালাই দেয়া হয়েছিল। ৪০ ইঞ্চি পুরো দেয়ালের ‘জমিদার বাড়ি’ স্টাইলের বাড়িটির বেইজে কোনো মটকা না থাকলেও ঘরের ফ্লোর স্পেসের পুরোটার নিচে ‘মাটির মটকা’।
দীর্ঘদিনের পুরোনো ঘরটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়লে হাজী শরিয়ত উল্ল্যাহ’র তৃতীয় প্রজন্ম সেটি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেন। সম্প্রতি পুরো ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভিটির ইট সুরকি বের করতে গেলেই গত বুধবার ‘মাটির মটকা’ বেরুতে শুরু করে। প্রথমে একটি মটকা পাওয়ার পর ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। ধারণা করা হয়- বিপুল পরিমান ‘গুপ্তধন’ ভবনটির নিচের মটকাগুলোতে রয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে মাটি খুঁড়ে অগুনতি মটকার হদিশ মিলে। সবগুলো মটকা’ই খালি এবং উপুড় করে স্থাপন করা। প্রথম দিন ভিটির তলা থেকে ১৮টি মটকা বের করে আনা হয়। মাটি খোঁড়াখুড়ি করার সময় দুয়েকটি মটকা ফুটো হলেও বাকি মটকাগুলো একেবারে অক্ষত। দুইশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে কি করে মাটির মটকাগুলো অক্ষত থাকলো, কি করে এই মটকা হাজার হাজার টন ওজনের ভিটির ভর সহ্য করে এতদিন টিকে থাকলো তা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন চুয়েটের সাবেক ভিসি অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট স্থপতি আশিক ইমরান এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাসান বিন শামস বলেন, প্রকৌশল বিদ্যায় এই ধরনের মটকার কোনো ভূমিকার স্বীকৃতি নেই। ভবনের তলায় এতগুলো মটকা কেন দেয়া হয়েছিল সেই রহস্যের কোনো কুলকিনারা হয়নি। বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরাও বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি। তবে মনে করা হয় যে, ভিটি দেবে না যাওয়া কিংবা ভূমিকম্পের জন্য এই ধরনের কোনো প্রযুক্তি ওই সময় ব্যবহৃত হতো কিনা তা নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন বলেও অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম মন্তব্য করেন।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, প্রধানমন্ত্রী দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত মাটির মটকা এবং ভবনটির ব্যাপারে বিস্তারিত প্রতিবেদন পড়ার পরই ভবনটি সংরক্ষণের নির্দেশনা প্রদান করেন। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার কামরুল হাসান, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ এবং জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোমিনুর রহমানকে ভূমিসহ বাড়িটি যেভাবে আছে ওভাবেই প্রত্নসম্পদ হিসেবে সংরক্ষণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়ার পরই উক্ত তিন শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল বাড়িটি পরিদর্শন করে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রদান করেছেন।
চট্টগ্রাম জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের সহকারী পরিচালক ড. আহমেদ আব্দুল্লাহ বাড়িটি পরিদর্শন করেছেন। তিনি পুরো বিষয়টি জেলা প্রশাসককে অবহিত করেছেন। তিনি বলেন, বাড়িটি মোগল আমলের শেষ দিকের হতে পারে। এটির বয়স দুই থেকে তিনশ’ বছরের হতে পারে। মাটির মটকার উপর এর আগে চট্টগ্রামে আর কোনো ভবন আবিষ্কৃত হয়নি। এটিই এই ধরনের প্রথম আবিষ্কার। তাই এ ধরনের একটি ঐতিহাসিক স্থাপনাকে প্রত্নসম্পদ হিসেবে সংরক্ষণ করা খুবই জরুরি বলেও তিনি মতামত ব্যক্ত করেন।
পাথরঘাটা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক এবং হাজী শরিয়ত উল্ল্যাহের পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্টজন আশফাক আহমেদ জানান, দৈনিক আজাদীর প্রতিবেদনটি পড়ার পরই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভবনটি সংরক্ষণের নির্দেশনা প্রদান করেছেন। তিনি মাটির মটকাগুলো যেভাবে আছে ওভাবেই রাখতে বলেছেন। ভবনটির ভিতসহ ভিটি এবং মাটির মটকাগুলো যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেদিকেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলেছেন। ওখানে থাকা দুইশ’ বছরেরও বেশি সময়কার পানির কুয়াটিও সংরক্ষণের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
তিন গণ্ডা জায়গার উপর গড়ে তোলা ওই ভবন এবং মাটির কুয়া প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিকট হস্তান্তরের প্রক্রিয়া অচিরেই শুরু হবে বলেও জেলা প্রশাসনের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে।
গতরাতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোমিনুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমরা বাড়িটি পরিদর্শন করেছি। মাটির মটকা কিংবা ভবনের ভগ্নাংশ আমরা সংরক্ষণ করবো। এটিকে প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ হিসেবে সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেয়া হবে। ভবনসহ জায়গাটি অধিগ্রহণের প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোমিনুর রহমান বলেন, নিয়মানুযায়ী ভূমি মালিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে।