কর্ণফুলী, কেউ কথা রাখেনি

দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত, হারিয়ে যাচ্ছে স্বাভাবিক নাব্যতা

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ২২ জুন, ২০২১ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

দেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ কর্ণফুলী নদী দখলে দূষণে বিপর্যস্ত। নানাভাবে দখল হয়েছে নদী, হচ্ছে। দূষণ থেমে নেই বহু বছর ধরে। অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে নদী উদ্ধারে বিভিন্ন সময় বহু আলোচনা হয়েছে। উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। শোনা গেছে, অনেক প্রতিশ্রুতি, আশ্বাস বাণী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ কথা রাখেনি। বিপর্যস্ত কর্ণফুলীর শেষরক্ষা আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন কর্ণফুলী গবেষক এবং বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষায়, ‘সংঘবদ্ধ কিছু মানুষের লোভ আমাদের এই নদীকে গলা টিপে হত্যা করছে। এই চক্রে যেমন ভূমিদস্যু রয়েছে। তেমনি রয়েছেন কিছু রাজনীতিবিদ। প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় তারা কর্ণফুলীকে হত্যা করছে।’
লুসাই পাহাড় থেকে আসা কর্ণফুলী নদী সীমানা পেরিয়ে নানা পথ মাড়িয়ে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় মিলিত হয়েছে। বাংলাদেশের সীমানায় এই নদীর দৈর্ঘ্য ১৮৭ কিলোমিটার। তবে কাপ্তাই লেকের পয়েন্ট থেকে মোহনা পর্যন্ত নদীর দৈর্ঘ ৮৫.৫ কিলোমিটার। রাঙামাটির বরকলের পর নদীর সবকিছু সেই আগেকার মতো থাকলেও যতই ভাটির দিকে এসেছে ততই নষ্ট হয়েছে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ। সংশ্লিষ্টদের মতে, কর্ণফুলীর সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে অবৈধ দখল। নদীর উভয় পাড়ে তিন হাজারেরও বেশি স্থাপনা নানাভাবে নদী দখল করেছে। এর পাশাপাশি নদীর পাড় জুড়ে গড়ে ওঠা ৩৯০টি ছোট বড় শিল্প কর্ণফুলীর গলা টিপে ধরছে। দূষণের পাশাপাশি কারখানাগুলো থেকে বিপুল পরিমাণে বর্জ্য নদী দূষণ করছে।
দখল দূষণের পাশাপাশি দিনে দিনে ভরাট হয়ে যাওয়াও কর্ণফুলীর অনেক বড় একটি বড় সমস্যা বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এই নদীর গভীরতা কমেছে। কমেছে প্রস্থও। এক সময় নদী অনেক প্রশস্ত ছিল। কিন্তু বর্তমানে নদীর উভয় পাড় অনেক বেশি ভরাট করে ফেলা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মালয়েশিয়ান একটি কোম্পানির মাধ্যমে নদী ড্রেজিং করতে গিয়েও নদী ভরাট করেছে। নদীর মাটি বিক্রি করার জন্য মালয়েশিয়ান ওই কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট নদীর উভয় পাড় এমনভাবে ভরাট করেছেন যাতে দেশের অর্থনীতির এই প্রাণপ্রবাহের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়েছে।
শহরের বর্জ্যও পড়ছে এই নদীতে। এতে নদীর তলদেশে ২০/২৫ ফুটের পলিথিনের স্তর জমেছে। সূত্র বলেছে, শহরের সব বর্জ্য নানা পথ ঘুরে কর্ণফুলীতে গিয়ে পড়ছে। কিন্তু ঠিকভাবে নদী ড্রেজিং হয়নি। প্রতি দশ বছর অন্তর কর্ণফুলী নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং পরিচালনার জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ থাকলেও তাও হয়নি। গত দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর নামে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে নানা ঝক্কিঝামেলা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বর্তমানে ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর একটি প্রকল্পের কাজ চললেও পলিথিন বিপত্তিতে পড়ে পুরো প্রকল্পটি হুমকির মুখে রয়েছে। কর্ণফুলীর তলদেশের পলিথিনের পাহাড় সরাতে গিয়ে চীনা ড্রেজারের স্বাভাবিক কার্যক্রম বহুবার ব্যাহত হয়েছে। নতুন করে গ্রেভ দিয়ে পলিথিন তোলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ার চর ড্রেজিং’ নামের এই প্রকল্পের আওতায় কর্ণফুলীর তলদেশ থেকে ৫১ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালি উত্তোলনের কাজ চলছে। কিন্তু পলিথিনের কারণে কাজটি পদে পদে এতভাবে ব্যাহত হয়েছে যে, একদিকে মাটি তোলা শুরু হলে অন্যদিকে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতে করে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ড্রেজিং এর শতভাগ সুফল মিলছে না বলেও সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।
কর্ণফুলীর পাড়ে ৩৯০টি ছোট বড় কারখানা থাকলেও এগুলোর অধিকাংশটিতে কোন ইটিপি নেই। কারখানাগুলোতে ইটিপি স্থাপনের একটি প্রস্তাবনা রয়েছে, কিন্তু তা কার্যকর করা হয়নি। ইটিপি স্থাপন নিয়ে নানাভাবে চাঁদাবাজি এবং দুর্নীতিরও অভিযোগ রয়েছে।
নদীর মোহনা থেকে উপরের দিকে প্রায় দশ কিলোমিটার এলাকায় উভয় তীরে রয়েছে অবৈধ দখলদার। উচ্চ আদালত থেকে নদীর সীমানা নির্ধারণ এবং অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের নির্দেশনা দেয়া হয়। আদালতের নির্দেশে জেলা প্রশাসন নদীর দুই তীরে ১০ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় আড়াই হাজার অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে। এরমধ্যে বড় বড় কারখানাও রয়েছে। কিন্তু অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ এবং দখলদারদের কবল থেকে নদী উদ্ধার সম্ভব হয়নি। অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছিল প্রশাসন। কিন্তু এই অভিযান নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় সূত্র এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, অভিযানকালে নদী যতটুক উদ্ধার করা হয়েছিল ইতোমধ্যে তার থেকে বেশি দখল হয়ে গেছে।
দখলে দূষণে বিপর্যস্ত কর্ণফুলী হারাচ্ছে স্বাভাবিক নাব্যতা। নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে যাওয়ায় জোয়ারের পানি নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত করছে। কর্ণফুলীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার উপর মারাত্মক রকমের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এভাবে চলতে থাকলে কর্ণফুলী স্বাভাবিক নাব্যতা হারিয়ে ফেলবে। দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে।
কর্ণফুলী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, কর্ণফুলীর অবস্থা খুবই নাজুক। অসাধু শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এবং ভূমিদস্যু মিলে চট্টগ্রামের প্রাণ এই কর্ণফুলী নদীকে হত্যা করে ফেলছে। মানুষের লোভের বলি হচ্ছে খরস্রোতা এই নদী। তিনি কর্ণফুলী রক্ষায় বড় ধরনের সমন্বিত উদ্যোগ নেয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসংক্রমণ ঠেকাতে অবরুদ্ধ ঢাকার চার পাশ
পরবর্তী নিবন্ধসংক্রমণ ফের মধ্য এপ্রিলের পর্যায়ে