নতুন পরিকল্পনা আছে, ধীরগতিতে এগোচ্ছি : আনাস মাদানী

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ৮ জুন, ২০২১ at ৫:১৪ পূর্বাহ্ণ

মাত্র এক মাস ১৩ দিন আগে পূর্বের কমিটি বিলুপ্ত করে হেফাজতে ইসলামের পাঁচ সদস্যের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়োছিল। সর্বশেষ ঘোষিত ওই কমিটি বিলুপ্ত করা হয়নি। ঘোষিত হয়নি পাল্টা কোনো কমিটিও। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল সোমবার রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা করা হয়েছে ৩৮ সদস্যের কমিটি। এতে জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমীর ও আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদীকে মহাসচিব করা হয়। পাঁচ সদস্যের কমিটিতেও তারা একই পদে ছিলেন। গতকাল ঘেষিত কমিটিতে বাদ দেয়া হয়েছে সংগঠনটির সাবেক যুগ্মমহাসচিব মামুনুল হক ও সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সমালোচিতদের। তবে সহকরী মহাসচিব করা হয় হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা শাহ আহমদ শফীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ মাদানীকে। এছাড়া শফীপন্থী হিসেবে পরিচিত আর কাউকে রাখা হয়নি। অর্থাৎ ঘুরেফিরে বাবুনগরীর অনুসারিদের হাতেই থেকেছে হেফাজত। অথচ কিছুদিন ধরে গুঞ্জন ছিল, নানামুখি চাপে থাকা বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন হেফাজত সংস্কার করা হচ্ছে। একইসঙ্গে শফীপন্থীদের সমন্বয়ে পুনর্গঠিত হবে সংগঠনটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেমন না হওয়ায় সরকারের সঙ্গে বাবুনগরীর সমঝোতা হয়েছে কিনা সেই প্রশ্ন ওঠেছে। এ অবস্থায় গতকাল ঘোষিত কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছে শফীপন্থীরা।
এছাড়া শফীপুত্র ইউসুফ মাদানী দাবি করেছেন, কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করতে তার অনুমতি নেয়া হয়নি। তিনি তার নাম প্রত্যাখ্যান করেছেন। হেফাজতের কোনো সাংগঠনটিক কমিটিতে তিনি থাকবেন না। আহমদ শফীর আরেক ছেলে ও সাবেক প্রচার সম্পাদক মাওলানা আনাস মাদানী বলছেন, যে আর্দশ নিয়ে হেফাজত গঠিত তা পূরণ হবে না সদ্য ঘোষিত কমিটি দিয়ে। এছাড়া শফীপন্থী হেফাজতের কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, সদ্য ঘোষিত কমিটি কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার শঙ্কা আছে। তারা বলছেন, শাহ আহমদ শফী বেঁচে থাকা অবস্থায় ২০১ সদস্যের একটি কমিটি চূড়ান্ত করা হয়েছিল। যেখানে শাহ আহমদ শফী ও জুনায়েদ বাবুনগরীর যৌথ স্বাক্ষর রয়েছে। শেষ মুহূর্তে হাটহাজারী মাদ্রাসাকেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকট হলে ওই কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অপ্রকাশিত সেই কমিটিকেই কার্যকর করা হবে। আগামী ১৭ জুন এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে। ওইদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর (র.) জীবন কর্ম’ শীর্ষক আলোচনা সভা হওয়ার কথা রয়েছে। ওই অনুষ্ঠান থেকেই শফীপন্থীদের অবস্থান স্পষ্ট করা হবে।
জানা গেছে, দেশের শতাধিক কওমী মাদরাসার শিক্ষকদের নিয়ে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে হেফাজতে ইসলাম। শাহ আহমদ শফী সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠা থেকে আমৃত্যু সংগঠনের সর্বোচ্চ আমীর পদে দায়িত্ব পালন করেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মারা যান তিনি। এরপর ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর কাউন্সিলের মাধ্যমে গঠন করা হয় সংগঠনটির ১৫৩ সদস্যের কমিটি। যেখানে প্রয়াত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফির ছেলেসহ তার অনুসারি ৪০ থেকে ৫০ জনকে বাদ দেয়া হয়। যারা আগের কমিটিতে শীর্ষ পদে ছিলেন। তবে ওই কমিটি মেনে না নিলেও পাল্টা কমিটি করেনি শফীপন্থীরা।
তবে নিজেদের কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত হয়ে সমালোচিত হয় বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন হেফাজত। চাপে পড়ে সরকারের। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত ২৫ এপ্রিল রাতে ১১ টার দিকে এক ভিডিও বার্তায় কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণা দেন সংগঠনটির আমীর আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। এর কয়েক ঘন্টা পর রাত তিনটার দিকে দুই ধাপে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়। সর্বশেষ গতকাল ৩৮ সদস্যের কমিটি করা হয়। অবশ্য গত কিছুদিন ধরেই হেফাজতের নতুন কমিটি ঘোষণার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এরপ্রেক্ষিতে গত ২ জুন রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলন করে ‘হেফাজতের নামে কমিটি হলে তা প্রত্যাখানের ঘোষণা দেয়া হয়’।
শফীপন্থীরা যা বললেন :
গতকাল ঘোষিত কমিটির সহকারী মহাসচিব ও শাহ আহমদ শফীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ মাদানী দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমার ৫৮ বছর বয়সে কোনো রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। ভবিষ্যতেও থাকবো না। আমার সাথে পরামর্শ না করে এবং অনুমতি ছাড়া কমিটিতে আমার নাম দেয়া হয়েছে। তা আমি প্রত্যাখান করছি। তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নাই। গত ১২ বছরেও হেফাজতের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে ছিলাম না। ভবিষ্যতেও হেফাজতের সংগঠনে থাকবো না। জীবনের শেষ প্রান্তে চলে আসছি। এখন সংগঠন করে কি হবে।
আহমদ শফীর আরেক ছেলে ও সাবেক প্রচার সম্পাদক মাওলানা আনাস মাদানী আজাদীকে বলেন, কমিটি গঠনের বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। তিনি বলেন, শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী যে চিন্তাধারা নিয়ে হেফাজত গঠন করেছিলেন তার প্রতিফলন ঘোষিত কমিটি দিয়ে পূরণ হবে না। যে কমিটি করেছে তার অনেক সদস্য বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত। কিছুদিন আগে জ্বালাও পোড়াও ঘটনায় যে মামলা হয়েছে তার আসামি। এররকম ব্যক্তিরা বাংলাদেশে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্বকারী হেফাজত ইসলামের নেতা হতে পারে না। এ কমিটিকে আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। কমিটিতে নাম আছে এমন অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম, তারা তাদের অনুমতি ছাড়া নাম দেয়ার কথা জানিয়েছে। তারাও প্রত্যাখান করেছে। শফীপন্থীদের নতুন কমিটি ঘোষণার পরিকল্পনা আছে কীনা জানতে চাইলে বলেন, আমাদের পরিকল্পনা আছে। তবে ধীরগতিতে এগুচ্ছি।
আহমদ শফীর অনুসারী হেফাজতে ইসলামের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মঈনুদ্দীন রুহী আজাদীকে বলেন, ঘোষিত কমিটি আমরা প্রত্যাখান করছি। যে কমিটি হয়েছে সেটা তো পুরাতন বউকে নতুন শাড়ি পরানোর মত। এ কমিটি দিয়ে জনগণের আশা-আকাঙ্খা ও ইসলামের হেফাজত হবে না। এটা ফটিকছড়ি সমিতির হেফাজত হবে। পুরাতন লোকদের দিয়ে যে কমিটি করছে, তা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা আবার বাস্তবায়িত করবে।
এ হেফাজত নেতা বলেন, গত এপ্রিল মাসে পাঁচ সদস্যের কমিটি করেছিল তারা। এখন আবার করেছে। তাদের বিষয়গুলোও ঠিক বুঝতে পারছি না। এছাড়া কমিটিতে রাখা হয়েছে তাদের মধ্যে হুজুরের ছেলেসহ অনেকের অনুমতি নেয়া হয়নি। পাল্টা কমিটি করা হবে কিনা জানতে চাইলে বলেন, পাল্টা কমিটি কেন করব। হুজুর থাকা অবস্থায় যে কমিটি করেছিলেন সেটা বহাল আছে। ওটাই মূল কমিটি। সেটাকে আমরা সংস্কার করব। আমাদের পরবর্তী বৈঠকে ওই কমিটির আমীর নির্ধারণ করব। আগামী ১৭ জুন ঢাকায় অনুষ্ঠান আছে।
কমিটির নেতারা যা বললেন :
সদ্য ঘোষিত কমিটির মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী সাংবাদিকদের বলেন, আগের কমিটির যারা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন, তাদের নাম ঘোষিত কমিটিতে নেই। ছোট পরিসরে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এই কমিটি পরবর্তীতে চিন্তা-ভাবনা করে দেখবে আর কে কে এই কমিটিতে যুক্ত হবেন। যারা কারাগারে আছেন তারা এখানে অন্তর্ভুক্ত হবেন কিনা, তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যারা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন তাদের মুক্তির দাবি জানিয়ে আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথেও দেখা করেছি। তাদের মুক্তির দাবিও আমরা অব্যাহত রাখব।
হেফাজত তাহলে দুই ভাগে বিভক্ত কি না জানতে চাইলে বলেন, এখানে বিভক্তির কিছু নেই। তারা (শফীর অনুসারী) আমাদের বলেছেন, এই কমিটিতে তারা আমাদের সাথে থাকবেন।
শফীপন্থীদের ২ জুনের সংবাদ সম্মেলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারা যে সংবাদ সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন, তা হেফাজতে ইসলামের কোনো ব্যানারে করেনি। তারা আল্লামা আহমদ শফীর ভক্তবৃনেরদ ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এখানে বিদ্রোহ ঘোষণার কোনো নিউজ আমরা পাইনি। ভবিষতে প্রত্যেক জেলায় যে কমিটি ঘোষণা করা হবে, সেসব কমিটির সভাপতি পদাধিকার বলে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে বিবেচিত হবে। জেলা কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারি অরাজনৈতিক ব্যক্তি হতে হবে।
ঢাকায় কেন প্রেস কনফারেন্স :
হেফাজতে ইসলামের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসাকেন্দ্রিক হলেও কমিটি ঘোষণার জন্য ঢাকাকে বেছে নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সংগঠনটির নেতারা বলছেন, কমিটিতে সারা দেশের হেফাজত নেতারা আছেন। তাদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ঢাকায় করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত,২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নগরের লালদীঘি মাঠে ‘ধর্মহীন শিক্ষানীতি প্রণয়ন, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল’সহ বিভিন্ন দাবিতে সমাবেশের ডাক দিয়ে আলোচনায় আসে সংগঠনটি। এরপর ২০১৩ সালের মে মাসে শাপলা চত্বর ঘটনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় আসে হেফাজত ইসলাম। সর্বশেষ গত মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ করে হেফাজত ইসলাম। এ সময় সহিংসতায় জড়িয়ে পরে সংগঠনটির কর্মীরা। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামে প্রাণহানিও ঘটে। এ ঘটনায় দায়ের হয় মামলা। পরবর্তীতে সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক মামুনুল হক এক নারীসহ আটকের পর সমালোচিত হয় দলটি। গত ১৮ এপ্রিল গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। এরপর সংগঠনটির আরো অন্তত ১৫ জন নেতাকে আটক করে পুলিশ। নাশকতায় জড়িত সংগঠনটির আরো একাধিক শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে পুলিশ জানায়। গ্রেপ্তার এড়াতে যারা আত্মগোপনে আছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহেফাজতের নতুন কমিটি শফীপন্থীদের প্রত্যাখ্যান
পরবর্তী নিবন্ধসামান্য বৃষ্টিতে নগরী ডুবে যাওয়া মানা যায় না : মেয়র