১০ তলার অনুমোদন নিয়ে ১৩ তলা

পার্কিং এলাকায় নির্মিত দোকান, ডুপ্লেক্স ঘর ও তিন ফ্লোরের ছাদ ভেঙে দিল সিডিএ

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ৮ জুন, ২০২১ at ৫:১২ পূর্বাহ্ণ

নিজের এবং প্রতিবেশীর জায়গা নিয়ে ১০ তলা ভবনের অনুমোদন নেয়া হয়। বহুতল ভবন নির্মাণ করে বিক্রি করা হয় কয়েক কোটি টাকার ফ্ল্যাট। কিন্তু ক্রেতাদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দিয়ে নকশা জালিয়াতির মাধ্যমে আরো তিনটি ফ্লোর নির্মাণ করে ভবনটিকে করা হয় ১৩ তলা। বিষয়টি নিয়ে থানা থেকে শুরু করে উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়াগড়ির পর অবশেষে গতকাল সিডিএ উচ্ছেদ শুরু করেছে। গতকাল ত্রিশ জনের বেশি শ্রমিক দিয়ে সিডিএ ভবনটির পার্কিং এলাকায় নির্মিত দোকান এবং ডুপ্লেঙ ঘর এবং তিনটি ফ্লোরের ছাদ ভাঙতে শুরু করেছে। মোগলটুলি রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে সিডিএ এই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছে।
সিডিএর দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সাতকানিয়ার রূপনগর গ্রামের হাজী আবদুল করিমের পুত্র মোহাম্মদ জানে আলম দীর্ঘদিন ধরে নগরীর মোগলটুলি কাটা বটগাছ এলাকায় বসবাস করেন। নিজের কিছু জায়গার সাথে প্রতিবেশী নুর আলী গং, মোহাম্মদ ফিরোজ গং এবং মোহাম্মদ নওশাদ গং থেকে জায়গা নিয়ে চারজনের মোট সাড়ে আঠার গন্ডা জায়গার উপর ১০ তলা একটি ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বিক্রির উদ্যোগ নেন। তিনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে দশ তলা একটি আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের জন্য নকশা জমা দেন। বিসি কেইস নম্বর ৫৩৪/২/১৫-১৬। সিডিএ ১০ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন প্রদান করেন। মোহাম্মদ জানে আলম ২০১৬ সালের ৩১ মে এই নকশা গ্রহন করেন। নকশা নেয়ার পর তিনি ভবন নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করেন। মোহাম্মদ জানে আলম নিজেকে সামার হোল্ডিং লিমিটেড নামের একটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচয় দিয়ে নানাজনের কাছে ফ্ল্যাট বিক্রি করেন। অন্তত চল্লিশ জনের কাছে ফ্ল্যাট বিক্রি করা হলেও মাত্র কয়েকজনকে তিনি ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিয়েছেন। বাকিরা কবে ফ্ল্যাট পাবে তার কোন সুনির্দিষ্ট নিশ্চয়তা তিনি দিতে পারেন নি। ১০ তলা পর্যন্ত নির্মাণের পর তিনি ভবনটিকে উপরের দিকে বর্ধিত করতে থাকেন। ফ্ল্যাট ক্রেতারা বাধা দিলে তিনি ১২ তলা পর্যন্ত অনুমোদন নেয়ার কথা জানান। ১২ তলা নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি আবারো উপরের দিকে নির্মাণ কাজ চালাতে শুরু করলে ফ্ল্যাট ক্রেতারা ব্যাপার কি জানতে চান। তখন তিনি ১৪ তলার অনুমোদন নিয়েছেন বলে জানান। এই সময় ফ্ল্যাট ক্রেতারা কাগজপত্র দেখতে চাইলে তিনি ১০ তলার অনুমোদন হিসেবে যেই কাগজটি ক্রেতাদের দিয়েছিলেন সেই একই কাগজ প্রদান করেন। শুধু ১০ তলার স্থলে ১৪ তলা লেখা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ফ্ল্যাট ক্রেতারা চ্যালেঞ্জ করলে তিনি ৯৯৯ এ ফোন করে পুলিশ আনিয়ে ফ্ল্যাট ক্রেতাসহ স্থানীয়দের চাঁদাবাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পরবর্তীতে ডবলমুরিং থানা পুলিশ সিডিএর কাগজপত্রসহ বিষয়টি মীমাংসা করতে বলেন।
বিষয়টি নিয়ে ফ্ল্যাট ক্রেতাদের পক্ষ থেকে সিডিএতে অভিযোগ করা হয়। সিডিএ পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখে নকশা জালিয়াতির ব্যাপারটি নিশ্চিত হয় এবং অনুমোদিত নকশার বাইরের অংশ ভেঙ্গে ফেলার জন্য নোটিশ প্রদান করে। এই নোটিশ প্রাপ্তির পর মোহাম্মদ জানে আলম হাইকোর্টে গিয়ে সিডিএর নোটিশের বিরুদ্ধে একটি রিট পিটিশন (নম্বর ৯০৩১/২০১৯) দালিখ করেন। সিডিএর বিরুদ্ধে জারিকৃত এই পিটিশনে ফ্ল্যাট ক্রেতাদের পক্ষ থেকে আয়কর আইনজীবী মোহাম্মদ আবু তালেব, মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম এবং আবদুল গফুর পক্ষভুক্ত হন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে হাইকোর্ট সিডিএ থেকে নথি তলব করে। নথি পরীক্ষা করে হাইকোর্ট জালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে পিটিশনটি খারিজ করে দেন এবং মোহাম্মদ জানে আলমকে দশ লাখ টাকা জরিমানা করেন। একই সাথে জানে আলমের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগে একটি মামলা করার জন্য হাইকোর্টের কোর্টকিপারকে নির্দেশ প্রদান করেন। কোর্ট কিপার ৩২৮/২০ মুলে একটি মামলা দায়ের করলে মোহাম্মদ জানে আলম চলতি বছরের পহেলা ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হন এবং মাস দেড়েক কারাভোগ করে জামিনে বের হয়ে আসেন।
হাইকোর্ট থেকে ভবনটির অননুমোদিত অংশের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু লকডাউন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে কয়েক মাস অভিযান বন্ধ থাকার পর গতকাল (সোমবার) সকালেই সিডিএ অভিযান শুরু করে। সিডিএর স্পেশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে ইমারত নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যান আবু ইসা আনছারী, অথরাইজড অফিসার মো. হাসান, সহকারী অথরাইজড অফিসার মো. ওসমান ও পেশকার ফয়েজ আহমদ অংশ নেন। অভিযানকালে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোগলটুলি সড়ক দুইদিক থেকে বন্ধ করে দেয়। এতে পুরো রাস্তাটিতে যান চলাচল বন্ধ থাকে। ভবনটির পার্কিং এলাকায় থাকা তিনটি দোকান ও অফিস এবং মোহাম্মদ জানে আলমের ডুপ্লেঙ বাড়ির বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে দেয়। পার্কিং এরিয়ার সব অবৈধ স্থাপনা ভেঙ্গে দেয়া হবে। অপরদিকে ভবনটির ১১ তলা থেকে ১৩ তলা পর্যন্ত ছাদ ফুটো করে দেয়া হয়। এই তিনটি ফ্লোর পুরোপুরি গুড়িয়ে দেয়া হবে বলে জানালেন সিডিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বিশাল ভবনটির সামনের দিকে কিছু অংশ ১২ তলা এবং পেছনের দিকের অংশ ১৩ তলা। ১০ তলার উপরের পুরো অংশটিই অপসারণ করা হবে বলে জানিয়ে সিডিএর অথরাইজড অফিসার মোহাম্মদ হাসান জানান, ভবনটির চারদিকেই কোন জায়গা ছাড়া হয়নি। কোন নিয়ম কানুন মানা হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল মোহাম্মদ জানে আলমের সাথে যোগাযোগের জন্য চেষ্টা করা হয়। ঘটনাস্থলে গিয়ে তাঁর সাথে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার পুত্র গতকাল ঘটনাস্থলে জানান, আমার বাবার সারা জীবনের সব সঞ্চয় শেষ করে দেয়া হয়েছে। একটি চক্র আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। তারা সফল হলো। তিনি বিস্তারিত কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, আমার মাথা ঠিক নেই। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মাথা ঠিক হলে কথা বলবো।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে আরও ২ মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধহেফাজতের নতুন কমিটি শফীপন্থীদের প্রত্যাখ্যান