প্রতারণার অভিনব কৌশল

গায়েবি প্রেম, ২১ কোটি টাকার উপহার! জড়িত দেশি বিদেশি চক্র

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ৩ জুন, ২০২১ at ৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ

মো. নেজাম, একটি প্রতিষ্ঠানে আইটি সেক্টরে কাজ করেন। গত ৩০ মে তার সাথে ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ করেন এক তরুণী। পরিচয় দেন নিজেকে আমিনা হাসিনা হিসেবে, থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। ভালো চাকরি করেন। নেজাম কিছুটা অবাক। তার সাথে যোগাযোগের কারণ কী? তরুণী জানান, নেজামকে অনেকদিন ধরে তিনি ফলো করছেন, তাকে হাসিনার ভালো লেগে গেছে। হাসিনা বলেন, আমাকে জানতে চাইলে তুমি নক করো। নেজাম একটা মেইল পাঠান, সার্বিক বিষয় জানতে চেয়ে। হাসিনা জানান, চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি বাংলাদেশে আসবেন শুধু নেজামের টানে। তবে এখন নেজামের জন্য কিছু টাকা পাঠাতে চান। নেজামের একটু সন্দেহ হয়। তবু কথা চালিয়ে যান তিনি। হাসিনা আবারো যোগাযোগ করেন এবং বলেন, তোমার জন্য টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। বিমানবন্দরে আমার এজেন্ট আছে। তার থেকে নিয়ে নাও। পারলে তাকে কিছু বখশিস দিও। গত ১ মে এক ব্যক্তি নেজামকে ফোন দিয়ে বলেন, তিনি হাসিনার এজেন্ট। নেজামের জন্য হাসিনা ২.৫ মিলিয়ন ডলার(২১ কোটি টাকা) পাঠিয়েছেন। এ অর্থ সংগ্রহ করতে তাকে ৮৫০ ডলার দিতে হবে। নেজাম দিতে রাজি হন। বলেন, আমি বিমানবন্দরে এসে, সরাসরি দিচ্ছি। এজেন্ট রাজি হন না। তিনি বলেন, আমাদের সিস্টেম হচ্ছে এ্যাকাউন্টে লেনদেন। নেজাম জানান, এরপর আমি ওসি ডবলমুরিং মোহাম্মদ মহসীনের শরণাপন্ন হই। তিনি খোঁজ খবর নিয়ে দেখেন এর পুরোটাই প্রতারণা। ওসি মহসীন আজাদীকে বলেন, নেজাম বুদ্ধি করে পুলিশের পরামর্শ নিয়েছেন। কিন্তু অনেকেই আছেন, কোটি টাকার লোভে লাখ টাকা খরচ করতেও কার্পণ্য করেন না। এতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশি কিছু নাগরিক এবং আমাদের দেশীয় একটি চক্র জড়িত। ইতোমধ্যে দেশব্যাপি তাদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। নেজামের সাথে প্রতারণার চেষ্টাকারী চক্রটিকেও ধরতে আমরা অভিযান শুরু করেছি।
এমন ফাঁদে পড়েছিলেন আমিন পাটওয়ারী নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, এমন খপ্পরে পড়ে আমি গত নভেম্বরে এক লাখ ৪৫ হাজার টাকা হারিয়েছি। আমাকে বলেছে, সে আমেরিকার মেরিন আর্মি সার্জেন্ট অফিসার, তার মা-বাবা, ভাইবোন কেউ নেই। এক্সিডেন্টে মারা গেছেন তারা। তার এক চাচার কাছে সে বড় হয়েছে। চাচা তাকে খুব নির্যাতন করতো। আমাকে জীবনসঙ্গী করে সে আমেরিকা নিয়ে যাবে, প্রয়োজনে সে আমাকে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করবে। কিন্তু এসবই ছিল প্রতারণা। সে বিভিন্ন কৌশল করে আমার সব টাকা নিয়ে আমাকে ভিখারি করেছে। আমি সুদে টাকা ধার নিয়ে খরচ করেছিলাম। সেই সুদের টাকার জন্য আজ আমি পলাতক।
প্রতারণার কৌশলটি পুরনো। তবুও সচেতনতার অভাবে লোভে পড়ে অনেকেই খোয়াচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। ইংল্যান্ড-আমেরিকার নাগরিক পরিচয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা হয়।
এক পর্যায়ে বিদেশি বন্ধুটি দামি উপহার পাঠান বাংলাদেশি বন্ধুকে। বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায় সেই উপহারের পার্সেল। বিমানবন্দরে নির্দিষ্ট এজেন্টকে টাকা পরিশোধ করলেই উপহারগুলো কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পৌঁছে যাবে বাড়িতে। কিন্তু টাকা পরিশোধের পরও বিদেশি বন্ধুর উপহার পান না বাংলাদেশি বন্ধু।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে কমপক্ষে শতাধিক মানুষ এ ফাঁদে পা দিয়েছেন। দামি উপহারের লোভে অনেকেই লাখ লাখ টাকা খরচ করলেও কোথাও কোনও অভিযোগ দেননি।
ওসি মহসীন বলেন, যাদের কাছে এ ধরনের প্রস্তাব আসে, তাদের বুঝতে হবে বিদেশ থেকে বন্ধু উপহার পাঠালে আবার টাকা খরচ করতে হবে কেন? তিনি বলেন, যারা প্রতারিত হচ্ছেন তারা কেউই একেবারে অশিক্ষিত নন। কারণ, প্রতারকচক্র বিদেশি, তাদের সঙ্গে ইংরেজিতেই যোগাযোগ হয়।
পুলিশ সূত্র জানায়, এ ধরনের প্রতারণার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৯টি দেশের নাগরিক রয়েছেন। এসব দেশের ৮৬ জন এখন বিভিন্ন কারাগারে। এর মধ্যে নাইজেরিয়ার ৬৬ জন, ক্যামেরুনের ৬ জন, পেরু, তানজানিয়া, গিনি ও ঘানার ২ জন করে এবং আলজেরিয়া, মালি ও কেনিয়ার ১ জন করে নাগরিক রয়েছেন।
সূত্র জানায়, প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বেশির ভাগ ব্যবসায়িক বা ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন। তাঁদের একটি অংশ পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে বলে থানায় জিডি করে অবৈধভাবে অবস্থান করেন। তাদের বেশির ভাগই ঢাকার অভিজাত এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বা হোটেলে অবস্থান করেন। নিজেদের ফুটবলার বা বায়িং হাউসের ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকখনো ম্যাজিস্ট্রেট কখনো সাংবাদিক
পরবর্তী নিবন্ধসংক্রমণ বাড়ছে দৈনিক শনাক্ত এক মাসের সর্বোচ্চ