বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অর্থাৎ ৫০ বছর পূর্তি! ভাবা যায়, অনেক কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতা কি করে ৫০টি বছর পেরিয়ে গেল! আর এই স্বাধীনতা অর্জনের প্রতিটি ধাপে রয়েছে অসংখ্য মানুষের নীরব আত্মত্যাগের গল্প, যাদের মাঝে অল্প কিছু মানুষ তাদের অসাধারণ অবদানের কারণে বিশ্ব ইতিহাসে চিরজাগরুক হয়ে রইবে। তেমনি একজন মহীয়সী কিশোরী সিলেটের কমলা ভট্টাচার্য, মাতৃভাষা বাংলার জন্য যার ভাগ্য ললাটে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের প্রথম নারী ভাষা শহীদের মর্যাদা।
দু‘টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ অবিভক্ত বাংলার সিলেটে ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন আত্মপ্রত্যয়ী কমলা। বাবা রামরমন ভট্টাচার্য ও মা সুপ্রবাসিনী দেবীর সাত সন্তানের পঞ্চম রত্ন ছিলেন কমলা। দেশভাগের সে করুণ পরিণতি, কমলার পরিবার পাকিস্তানে থেকে গেলেও ১৯৫০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে উদ্বাস্তু কার্যক্রম শুরু হলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে কমলার পরিবার। এরই মাঝে আকস্মিক বাবার মূত্যুতে পুরো পরিবারটির উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। এ অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করা নিরাপদ মনে না করায় বিধবা সুপ্রবাসিনী ৭ সন্তান নিয়ে সিলেট ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমান। আশ্রয় মেলে একসময়ের অবিভক্ত বৃহত্তর সিলেটের অংশ শিলচরে। সেখানে যাওয়ার সময় কমলার বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর। একে তো উদ্বাস্তু, তার উপর ছিল পরিবারের চরম আর্থিক অনটন।
শিলচরে যাওয়ার পর কমলার বড় বোন বেনু ভট্টাচার্য নার্সিংয়ের চাকরি নিয়ে শিলিগুড়িতে আবাস গড়েন। কমলার মেজ বোন প্রতিভা ভট্টাচার্য মনোনিবেশ করেন স্কুলের শিক্ষকতায়। তিনিই পরিবারটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পরের বছর কমলা ভর্তি হন স্থানীয় ‘ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউট-এ’। তার বই -খাতা কেনার পয়সা পর্যন্ত ছিল না! সহপাঠীদের সহযোগিতায় অদম্য কমলা তার অধ্যয়ন চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
টানাপোড়েনের সংসার, উদ্যমী কমলা স্বপ্ন দেখছিলেন স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়ালেখা শেষ করে একটি সম্মানজনক জীবিকার মাধ্যমে পরিবারের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেবেন। অলক্ষ্যে নিয়তি হয়তবা করুণ হাসি হেসেছিল; ১৯৬১ সালে দশম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন কমলা সামনেই মাধ্যমিক পরীক্ষা। সেসময় বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠে বরাক উপত্যকা।
১৯৬১ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে কাছাড়ে গঠিত হয় ‘কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ’। সে অনুষ্ঠানে পরিষদে নেতাদের বক্তৃতা শুনে ভাষা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হন। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন কিশোরীটি। ১৯৬১ সালের ১৪ই এপ্রিল, বাংলা নববর্ষ কিশোরীটির জীবনে ছিল এক বিশেষ দিন। মাতৃভাষা বাংলার জন্য আন্দোলনকারীদের সংকল্প দিবসে কমলাও অংশগ্রহণ করেন এবং সবার সঙ্গে শপথ নেন মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার। ১৯৬১ সালের ১৯শে মে এক উদীয়মান ভোরে মেঝ বোন প্রতিভার শাড়ি আর ব্লাউজ পরে কিশোরী হতে মানসিক ভাবে তরুণীতে পরিণত হওয়া কমলা হরতাল সফল করতে বের হয়ে যান নিতান্ত খালি পেটে। সাথে ছিল ১১ বছর বয়সি ছোট বোন মঙ্গলা ভট্টাচার্য। আন্দোলনের তীব্রতা বেগবান হলে রাজ্য সরকারের কবলে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। সরকার এ আন্দোলন কঠোর ভাবে দমন করার উদ্দেশ্যে পুলিশ বাহিনীর সাথে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে পাঠায় আসাম রাইফেল বাহিনীকে। ২টা ৪৫ নাগাদ শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে ছাত্র জনতাকে উদ্দেশ্য করে ১৭ রাউন্ড গুলি করে পুলিশ-রাইফেল বাহিনী। এতে প্রাণ হারান, কমলাসহ ১১ ভাষা সৈনিক। রাজ্য সরকার কমলাসহ সেই ১১ জন শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাকে আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
বর্তমানে ভারতের আসামে অবস্থিত শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে কমলাসহ ১১ জন শহীদের আবক্ষ মূর্তি ও একটি ব্রোঞ্জ ফলক রয়েছে। এছাড়া শিলচর রেলওয়ে স্টেশনকে ‘ভাষা শহীদ স্টেশন’ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। যদিও ১৮৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ স্টেশনটি সরকারি হস্তক্ষেপে ২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তথাপি ইতিহাস অনুরাগী পর্যটকদের কাছে এটি অন্যতম দর্শনীয় স্থানে পরিণত।
বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১১ সালে কমলার স্কুল ‘ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউট’ এ কমলার আবক্ষ ব্রোঞ্জ মূর্তি স্থাপন করা হয় এবং শিলচরের পাবলিক স্কুলের পাশের সড়কটির নামকরণ করা হয় ‘কমলা ভট্টাচার্য সড়ক’। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভাষা আন্দোলনের পথ পরিক্রমায় যে অর্জন সে অর্জনের মাহেন্দ্রক্ষণে জন্ম নিক সহস্র কমলা এ আশাবাদ সকলের। (সূত্র: সাপ্তাহিক জনমত)
লেখক : প্রাবন্ধিক