আমার জীবনে সুযোগ হয়েছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলিকাতার বাড়িতে থাকার। বাড়িটি তখন গেস্ট হাউজ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছিল।একদিন দুপুরে কলিং বেল বাজতেই আমি দরজা খুলে দিলাম– দেখি দুইজন ভদ্রলোক হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। পরিচয় দিলেন– আমি শংকর। বললাম আপনি কি লেখক শংকর দা’? বললেন জ্বী। আমি বললাম দাদা, আপনার লেখা আমি খুব পছন্দ করি এমনকি আমাদের বাংলাদেশে আপনার অনেক পাঠক ভক্ত আছে, যারা আপনার লেখা খুব পছন্দ করে –শুনে আবারও হাত জোড় করে আমাকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। তাঁর সাথে অন্যজন ছিলেন ইংরেজ, তাঁর নাম জন মুর এশিয়ার বেস্ট ফটো গ্রাফার বলে শংকর দা পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার সাথে। তিনিও আমাকে নমস্কার দিলেন। আমি অবাক হয়ে তাঁদের দেখছি–কতো বিনয়ী তাঁরা। লেখক শংকরের কাছ থেকেই আমি জানতে পারি -এই বাড়িটা রবীন্দ্রনাথের দাদার বাড়ি। এই বাড়িতে বসেই রবীন্দ্রনাথ নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ কবিতাটি রচনা করেছিলেন। বর্তমানে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর গবেষণা করছেন আর জন মুর কবির স্মৃতিবিজড়িত জায়গার ফটোগ্রাফী করছেন। আমি লেখককে বললাম- রবীন্দ্রনাথতো কতো কবিতাই রচনা করেছেন কিন্তু এই কবিতাকে আপনিএতো গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন? জবাবে তিনি বললেন-এই কবিতার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের লেখার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে তাই। লেখক শংকরের কাছে আরও জানতে পারি- রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ২৪ বছরের মতো ছিলো যখন তিনি এ বাড়িতে থাকতেন। একদিন রবীন্দ্রনাথ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন-দেখেন ভোরের সূর্যের আলো বাগানের ফুলের ওপর পড়েছে- এই দৃশ্য তাঁর কবি মনে দারুণ রিফ্লেক্ট হয়েছে এবং তিনি বারান্দাতে বসে সাথে সাথে ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ রচনা করেন। লেখক শংকর আমার জানার আগ্রহ দেখে খুব খুশি প্রকাশ করলেন। আমি তাঁকে বললাম -কবি যে এই বাড়িতে বসে এটা রচনা করেছেন তার প্রমাণ কী? তখন শংকর আমাকে বললেন সিঁড়ির নীচে মার্বেল পাথরে খোদাই করে লেখা আছে। ‘আজি হতে প্রভাতে রবির কর / কেমন পশিল প্রাণের পর/ কেমনে পশিল গুহার আঁধারে/ প্রভাত পাখির গান’। পরে আমি অবাক হয়ে তাই দেখলাম।
আরো লেখা আছে –কতো সাল থেকে কতো সাল তিনি এ বাড়িতে অবস্থান করেছিলেন। আমি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করাতে তিনিও জানাতে আগ্রহী হলেন। লেখক শংকর বললেন -রবীন্দ্রনাথের বাল্যস্মৃতি বইতে আপনি প্রভাত সংগীতে ১০ নম্বর সদর স্ট্রীট, কলিকাতার এই বাড়ির কথা দেখবেন। আমি পরের দিনই শংকরের কথামতো কলেজ স্ট্রীট থেকে বইটি সংগ্রহ করে পড়ে দেখি-একবার রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরিবারের সবাইকে নিয়ে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলেন এবং আশা করেছিলেন অনেক সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখবেন যা তাকে বিমোহিত করবে এবং তাঁকে লিখতে সহায়তা করবে। কিন্তু তিনি অনেক ঘুরে ফিরে কিছুই দেখতে পাননি, মনটা খারাপ করেই ওখান থেকে ফিরে এসেছেন। এরমধ্যেই একদিন ভোরে বারান্দায় দাঁড়াতেই নীচে বাগানের দিকে চোখ পড়তেই তাঁর কবিমনে প্রতিফলন হয় এবং তিনি তখনই বিখ্যাত কবিতাটি রচনা করে ফেলেন। শুধু তাই নয় তাঁর লেখার মধ্যেও বিরাট পরিবর্তন আসে। রবীন্দ্রনাথ আরো লিখেছেন এ বিষয়ে— আসলে বিধাতা চাইলে গলির মধ্যেও সব সৌন্দর্য ঢেলে দিতে পারেন যেটা দার্জিলিং এ হাজারো চেষ্টা করে দেখতে পাননি।