বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফিরে পাক হারানো ঐতিহ্য

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ১৮ মে, ২০২১ at ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ববিদ্যালয় এক্ট ১৯৭৩ অনুযায়ী দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পূর্ণ স্বাধীন। এই এক্টটা করা হয়েছে যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন প্রতিবন্ধকতা ছাড়া জ্ঞান চর্চা করা যায়। শিক্ষক ও ছাত্র ছাত্রীরা যেন অবাধে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হচ্ছেন এদেশের সবচেয়ে মেধাবী মানুষ। যারা নিজ বিচার বুদ্ধি, আচার আচরণ, মানবিকতা ও জ্ঞান গর্বে জাতি সমাজ ও দেশকে সঠিক পথে চালিত করার ক্ষমতা রাখেন। প্রত্যেক সম্মানিত শিক্ষক মেধা মননে নিজেকে নিজে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হবেন-এটাই জাতির প্রত্যাশা। তাঁদের প্রধান কাজ সঠিক পাঠদান, উত্তম গুণাবলীর মানুষ তৈরী করা ও মৌলিক গবেষণা করা। কিন্তু গত কয়েক দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তাঁদের মূল কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়েছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কার্যক্রম কিছুটা হলেও ব্যাহত হচ্ছে। এর প্রতিফলন হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাসহ সার্বিক কার্য্যক্রমে। কথাগুলো বলার পিছনে কারণ হলো, কয়েকদিন আগে স্পেনের সিমাগো ইনস্টিটিউশনস ২০২১ ইং সালের বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো র‌্যাঙ্কিংয়ে তালিকা প্রকাশ করেছে। ২০০৯ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং এর তালিকা নিয়মিত প্রকাশ করে আসছে।এতে এই বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৪১২৬টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। যাতে বাংলাদেশের ২৮টি সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। র‌্যাঙ্কিংয়ে এ বছরে সেরা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল, তৃতীয় চীনের সিঙ্গুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, চতুর্থ যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়,পঞ্চম ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)। এরপর আছে অঙফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়, মিসিগান বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন, ঝিজিয়ায়ং বিশ্ববিদ্যালয়।
গবেষণা, উদ্ভাবন এবং সামাজিক প্রভাবের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবছর এপ্রিল মাসে এই র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। স্কপাস ডেটাবেইসে কমপক্ষে ১০০টি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে-এমন সব প্রতিষ্ঠানকেই এই র‌্যাঙ্কিংয়ের জন্য বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। উক্ত র‌্যাঙ্কিংয়ে দেখা যায়, গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম, যা বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে ৫৪৮ নম্বরে, টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দেশে দ্বিতীয়- যা বিশ্বে ৫৫৪ নম্বরে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশে তৃতীয় যা বিশ্বে ৫৫৫ নম্বরে। বাংলাদেশের শীর্ষ দশে থাকা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (৪), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়(৫), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়(৬), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়(৭), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়(৮), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) (৯) ও যৌথভাবে ১০ম স্থানে আছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি,বাংলাদেশ (আইইউবি)। ২৮টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আরও আছে-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি এবং রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি,চট্টগ্রামের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি,নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি)। ইতিপূর্বে প্রকাশিত ২০২০ সালের র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের শীর্ষ তিন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।এই র‌্যংকিং বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানে তেমন কোন উন্নতি নেই। কিন্তু কেন এমনটি হচ্ছে? আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি? অথচ এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের শিক্ষার মান ছিলো আন্তর্জাতিক মানের।
আমাদের দেশে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা পড়ে বুয়েট ও মেডিক্যাল কলেজে। এরপরের মেধাবীরা পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাহলে সেই মেধার প্রতিফলন আমরা পাচ্ছি না কেন? এর কারণ হলো আমরা জ্ঞান অর্জন ও শিক্ষিত হওয়ার চেয়ে সার্টিফিকেট অর্জন ও দেওয়াকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। তাইতো বর্তমানে বাংলাদেশের ৮৫৫টি কলেজে অনার্স মাস্টার্স পড়ানো হয়। আগে কলেজে অনার্স পড়ানো হলেও মাস্টার্স বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ানো হতো। বর্তমানে শুধু জেলায় নয় উপজেলা এমনকি ইউনিয়নে পর্যন্ত অনার্স মাস্টার্স পড়ানো হয়। অথচ এসব কলেজে শিক্ষার মান কেমন বা শিক্ষকের মান কেমন বা পর্যাপ্ত শিক্ষক আছে কিনা তার কোন খবর রাখি না। ডিগ্রী ও সার্টিফিকেট পাচ্ছে এটাই আমাদের সন্তুষ্টি? গ্রামে গঞ্জে নিজের বাড়িতে থেকে এরকম অনার্স মাস্টার্স করতে পারার সুযোগ সম্ভবত বাংলাদেশেই আছে। পৃথিবীর সভ্য দেশগুলোতে এই সুযোগ নেই। কারণ তারা মানুষকে সার্টিফিকেটের সাথে শিক্ষাও দেয় যাতে তারা পরিপূর্ণ শিক্ষিত হতে পারে। আর আমরা শুধু সার্টিফিকেট দেই,শিক্ষা দেই না। সেজন্য কি প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর পাস করে বেকার বসে আছে! অনেকে পিয়ন দারোয়ানের মত চাকুরী করছে যা রীতিমত লজ্জাজনক। আবার অনেকে কাঙ্ক্ষিত চাকুরি না পেয়ে হতাশায় ভুগছে। প্রতি বছর লাখ লাখ স্নাতকোত্তর পাস করা মানুষকে উপযুক্ত কাজ দিতে না পারলে রাষ্ট্রের কি উপকার হবে। তাই তো সময় এসেছে এসব বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাবনার।
কয়েক দশক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক গর্ব করে বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বারান্দায় ঘুরে যা শিখে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সারা বছর ক্লাস করেও তা অর্জন করতে পারে না।
কারণ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অঙফোর্ড বলা হতো।এরপর আস্তে আস্তে এর মান কমতে থাকে। অথচ দেশের মানুষও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অঙফোর্ডের পর্যায়েই দেখতে চায়। আমরা চাই এই বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান বিজ্ঞান ও গবেষণা পর্যায়ে একদিন তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে এবং একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব তালিকায় প্রথম দিকে অবস্থান করবে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সাধারণ সম্পাদক, চবি গণিত অ্যালামনাই এসোসিয়েশন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরবীন্দ্রনাথের বাড়ি
পরবর্তী নিবন্ধগাহি তারুণ্যের জয়গান