‘যদি তুমি সত্যিই একজন জাপানিজ হও, তবে তোমার মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোনা উচিত’, নিরাপত্তাকর্মীকে বলেছিল তরুণটি। ১৮৯০ সাল তখন। জাপানের টোকিওতে সংবিধান প্রণয়ন উপলক্ষে একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। প্রদর্শনীভর্তি দেশ-বিদেশের অত্যাধুনিক সব যন্ত্র। সেখানে প্রতিদিন হাজির হত তরুণটি। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকত প্রতিটি যন্ত্রের সামনে।
এত বেশি সময় ধরে দাঁড়াত যে, নিরাপত্তাকর্মীকে এগিয়ে আসতে হত তরুণটিকে সরাতে। তেমনই একদিন নিরাপত্তাকর্মীকে তরুণটি বলে উঠল, ‘এখানে যেসব অসামান্য মেশিনপত্র যোগাড় করা হয়েছে, এর সবই এসেছে বিদেশ থেকে। এটা জেনেও কি তোমার একটুও হতাশা জাগছে না? আমি কিন্তু খুবই হতাশ’।
পরক্ষণে নিজের উদ্দেশ্য জানান দেয় তরুণটি। বলে, ‘আমি একদিন এমন একটা মেশিন বানাতে চাই যা এইসব বিদেশি মেশিনের চেয়েও উন্নত হবে। এজন্যই আমি প্রতিদিন এখানে আসি, এগুলো নিয়ে গবেষণা করি। এটা কি ভুল?’ চারপাশে ততক্ষণে বেশ কিছু লোক জমে উঠেছে। তারা সমস্বরে তরুণটিকে সমর্থন জানাল। লজ্জা পেয়ে সরে গেল নিরাপত্তাকর্মীটি।
ওই প্রদর্শনী থেকে ফেরার পর সে বছরই তরুণটি আবিষ্কার করল প্রথম তাঁতযন্ত্র। জাপানি ভাষায় যন্ত্রটির নাম Jinriki-Shokki। এর আগে তাঁতে কাপড় বুনতে দুই হাত কাজে লাগাতে হত। তরুণটি একহাতে চালানো যায় এমন কাঠের যন্ত্র আবিষ্কার করল। সঙ্গে একটি সংকল্পও ছিল তার। ‘আমি একদিন এমন একটা তাঁত যন্ত্র আবিষ্কার করব, যা বিদেশি যে কোনো তাঁত যন্ত্রের চেয়েও উন্নত হবে। হাত ব্যবহার না করেও কাজ চালানো যাবে’।
এই ঘটনার এক শতকও পার হয়নি। ১৯৮৫ সাল। জাপানের ইতিহাসের সেরা দশ জন উদ্ভাবকের একজন হিসেবে ভূষিত করা হয় সেই তরুণটিকে। তিনি আর কেউ নন, সাকিচি টয়োডা। বিশ্বখ্যাত টয়োটা কোম্পানির স্বপ্নদ্রষ্টা। ১৮৬৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কোসাই শহরের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সাকিচি। জন্মের পর শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল ছিলেন তিনি। তার মা ছিলেন একজন তাঁতশিল্পী। মায়ের কাজকে একটু সহজতর করতে চেয়েছিলেন সাকিচি।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে কাঠমিস্ত্রি বাবার সাথে কাজে যেতেন সাকিচি। রোদের মধ্যে মাঠে কাজ করে শরীর ভাল হয়েছিল তার। কিন্তু সেখানেই তিনি থেমে থাকেননি। অধ্যবসায়, কঠোর পরিশ্রম এবং উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে অর্জন করেছিলেন চূড়ান্ত সফলতা। মায়ের কাপড় বোনার পরিশ্রম কমিয়ে এনেছিলেন সাকিচি। ভেবেছিলেন দেশের মানুষগুলোর জন্য।
ছোটবেলায় পশ্চিমা দেশের মানুষদের নিয়ে লেখা একটা বই (Saigoku-risshihen) পড়েন সাকিচি। পাশের গ্রামের এক শিক্ষক বইটি দিয়েছিলেন তাকে। জেমস ওয়াট কিভাবে যুক্তরাজ্যে বাষ্পীয় ইঞ্জিন উদ্ভাবন করলেন, প্যালিসির হাত ধরে কিভাবে ফ্রান্সে মৃৎশিল্প গড়ে উঠল, ওই বই পড়েই জানতে পারেন সাকিচি। কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না আসা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে, বই পড়ে সেই মন্ত্রটাই যেন পেয়েছিলেন সাকিচি। বদলে গিয়েছিল তার জীবন।
সাকিচির জীবনের বিস্ময়কর গল্প নিয়ে বই লিখেছেন জাপানি শিশুসাহিত্যিক মিনোরু নাসুদা। ১৯৩১ সালের ১০ এপ্রিল জন্ম নেয়া এই লেখকের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ষাটের বেশি। এর মধ্যে একটি Open your mind, and look at the great world outside বা ‘মনের দুয়ার খোল, বিশাল পৃথিবীটা দেখ’। জাপানে মোটিভেশনাল বই হিসেবে পাঠকের কাছে সমাদৃত সাকিচির জীবনের গল্প।
বাংলা ভাষায় বইটির সুখপাঠ্য অনুবাদ করেছেন আশিনুর রেজা ও মাসুদুর রহমান। বইটির প্রকাশক এসআইএসডি। প্রচ্ছদে রয়েছে কিইয়োকো ওয়াতানাবের নাম। আর বইয়ের ভেতরে প্রচুর ইলাসট্রেশন!