দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যায় প্রতিদিন নতুন নতুন বিশ্ব রেকর্ড। দিল্লি-মুম্বাইয়ে হাসপাতালে ঠাঁই নাই, অক্সিজেনের অভাবে চারদিকে হাহাকার। মাত্র দুই মাসের মধ্যে ভারতের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি এতটা খারাপ হল কী করে?
দেশটিতে অস্বাভাবিক দ্রুততায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান করছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বোঝার চেষ্টা করছেন, এ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনটিই দায়ী কিনা। করোনাভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্ট বা ধরনটির আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয়েছে বি.১.৬১৭। ভারতে প্রথম এ মিউট্যান্টটি শনাক্ত হয়েছিল বলে একে ভারতীয় ধরন বলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মোট ১৭টি দেশে করোনাভাইরাসের এ ধরনটি পৌঁছে গেছে, তাতে বিশ্বজুড়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। নতুন এ ধরনটি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা যা জানতে পেরেছেন, তা তুলে ধরা হয়েছে রয়টার্স ও বিবিসির দুটি প্রতিবেদনে। করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন আসলে কি : বিশ্বজুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করা নতুন করোনাভাইরাসের বাইরের দিকে রয়েছে কাঁটার মত অংশ, যাকে বলা হয় স্পাইক প্রোটিন। মানব কোষকে আক্রমণের সময় এ ভাইরাস ওই স্পাইক প্রোটিন কাজে লাগায়। ওই স্পাইক প্রোটিনের কারণেই এ করোনাভাইরাস অনেক বেশি সংক্রামক হয়ে উঠতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। ভারতের একজন জ্যেষ্ঠ ভাইরোলজিস্ট শহিদ জামিল বলেছেন, করোনাভাইরাসের বি.১.৬১৭ ধরনটির ওই স্পাইক প্রোটিনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন বা মিউটেশন হয়েছ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, ভারতে করোনাভাইরাসের বি.১.৬১৭ ধরনটি প্রথম শনাক্ত হয় গত বছর ডিসেম্বরে। কাছাকাছি আরেকটি ধরন অক্টোবরেই শনাক্ত হয়েছিল।
ডব্লিউএইচও ভারতীয় ওই ধরনটিকে বর্ণনা করেছে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ হিসেবে। গবেষণকদের ধারণা, এ ধরনটির জিন বিন্যাসে এমন কোনো পরিবর্তন হয়েছে, যা হয়ত এ ভাইরাসকে আরও সংক্রামক করে তুলতে পারে, অসুস্থতার মাত্রা আরও গুরুতর করে তুলতে পারে, কিংবা টিকার সুরক্ষাও অকার্যকর করে দিতে পারে। এর আগে যুক্তরাজ্য, সাউথ আফ্রিকা ও ব্রাজিলে শনাক্ত নতুন ধরনগুলোর ক্ষেত্রেও একইরকম ঝুঁকি থাকার কথা বলা হচ্ছিল। এর সবগুলো ধরনকেই ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ বা উদ্বেগজনক ধরন হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
এ ধরনটি বেশি বিপজ্জনক : করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনটি বেশি বিপজ্জনক বা বেশি সংক্রামক কিনা, অথবা টিকার প্রতিরোধ ভেঙে ফেলতে পারে কি না- বিজ্ঞানীরা এখনও সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলতে পারছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির ভায়রোলজিস্ট ড. জেরেমি কামিল বলেন, ভারতীয় ধরনটির একটি মিউটেশন বা পরিবর্তনের সঙ্গে সাউথ আফ্রিকা ও ব্রাজিলে চিহ্নিত ধরনের মিউটেশনের মিল রয়েছে। এই পরিবর্তন ভারইরাসকে আমাদের দেহকে সুরক্ষা দেওয়া অ্যান্টিবডিকে পরাস্ত করতে সহায়তা করতে পারে। আগের সংক্রমণ বা টিকার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এমনটি ধারণা করা যায়। তবে যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়া ধরনটি এরই মধ্যে ৫০টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমার সন্দেহ, করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনটির চেয়ে বরং যুক্তরাজ্যের ধরনটি বেশি সংক্রামক এবং আমাদের অবশ্যই আতঙ্কিত হলে চলবে না।
ভারতীয় ধরনটি সম্পর্কে তথ্যে ঘাটতি কেন : বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন সম্পর্কিত অনেক তথ্যউপাত্তই অসম্পূর্ণ এবং খুবই কম সংখ্যক নমুনার বিশ্লেষণ হয়েছে। ভারতে ২৯৮টি এবং বিশ্বে ৬৫৬টি নমুনার জেনেটিক সিকোয়েন্স করা হয়েছে, যেখানে যুক্তরাজ্যের ধরনটির ৩ লাখ ৮৪ হাজার সিকোয়েন্স করা হয়েছে এরই মধ্যে। ফলে নতুন এ ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য এখনও বিজ্ঞানীদের হাতে নেই।
সংক্রমণ বাড়ার জন্য নতুন ধরনটিই দায়ী : ডব্লিউএইচও বলছে, এটা বোঝার জন্য জরুরি ভিত্তিতে আরও গবেষণা দরকার। কারণ পরীক্ষাগার-নির্ভর সীমিত নমুনার ওপর পরিচালিত গবেষণায় সংক্রমণ বাড়াতে এ নতুন ভ্যারিয়েন্টের ভূমিকা থাকার ইংগিত মিলেছে। ভারতের ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোলের পরিচালক সুজিত কুমার সিংহ বলেন, সংক্রমণ ছড়িয়ে পরার চিত্রটি একটু জটিল, কারণ যুক্তরাজ্যে প্রথম শনাক্ত হওয়া বি.১১৭ ধরনটি ভারতের কিছু অঞ্চলে সংক্রমণ বাড়ার জন্য দায়ী। মার্চের দ্বিতীয় ভাগ থেকে নয়া দিল্লিতে যুক্তরাজ্যের ধরনটির সংক্রমণ দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু ভারতে মহামারীতে সবচেয়ে নাকাল রাজ্য মহারাষ্ট্রে ভারতীয় ধরনটির ব্যাপক মাত্রায় বিস্তার পেয়েছে।
টিকা একে থামাতে পারে : এ প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা আশার কথা শুনিয়েছেন হোয়াইট হাউজের মুখ্য চিকিৎসা উপদেষ্টা অ্যান্থনি ফাউচি। এ সপ্তাহের শুরুতে এক ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল বলছে, ভারতে উৎপাদিত টিকা কোভ্যাক্সিন করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনটিকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম। ইংল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে এ বিষয়ে কাজ করছে এবং এখন পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি যে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনটি কিংবা আরও দুটি ধরন বর্তমানে ব্যবহৃত টিকাগুলোর কার্যকরিতা কমিয়ে দিতে পারে।