কাউছার হোসেন। নোয়াখালী বেগমগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা তিনি। সিএনজি অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালান। চট্টগ্রাম মহানগরীতে গাড়ি চালানোর কারণে প্রায় ১০ বছর ধরে পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছেন। আগের ৯ বছরে স্বাচ্ছ্যন্দে পরিবারের ভরণপোষণ চালানো সম্ভব হলেও করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর থেকে গত এক বছর ধরে দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েছেন কাউছার। গত বছরের দেনা এখনো পরিশোধ করা সম্ভব না হলেও চলতি কঠোর লকডাউনে পরিবারের খরচ চালাতে নতুন করে এনজিও থেকে নিতে হচ্ছে চড়া সুদের ঋণ। আগের ঋণ শোধ করা সম্ভব না হলেও নতুন ঋণের এই বোঝা কখন শেষ হবে সেই চিন্তায় ভাঁজ পড়েছে কপালে।
কাউছার বলেন, ‘তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাদের পাঁচ জনের সংসার। মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বাসায় ভাড়া থাকি। মাসে ৯ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। দুই সন্তান স্কুলে যায়। সবমিলিয়ে মাসে কমপক্ষে ২০-২২ হাজার টাকা খরচ। স্বাভাবিক সময়ে কোনো রকমে চললেও করোনার কারণে এখন অসহায় হয়ে পড়েছি। না পারছি ভিক্ষা করতে। লকডাউনে অন্য কাজও নেই। গত বছরও লকডাউনের সময় রোজা ছিল। তখন ঈদের সময়েও গাড়ি চলাচল বন্ধ ছিল। পরিবারের খরচ সামলাতে একটি মাল্টিপারপাস প্রতিষ্ঠান থেকে ৫০ হাজার টাকার ঋণ নিয়েছিলাম। রোজগার বেশি না হওয়ার কারণে সেই ঋণ শোধ করতে নতুন করে অনেক ব্যক্তিগত দেনা হয়ে পড়েছে। এখন আবারও লকডাউন শুরু হয়েছে। বাধ্য হয়ে একটি এনজিও থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি।’
শুধু কাউছার নন; নগরীসহ চট্টগ্রামে সিএনজি অটোরিকশা চালক রয়েছে প্রায় ৬০ হাজারের মতো। যাত্রীবাহী বাস, মিনিবাস, হিউম্যান হলারের রয়েছে প্রায় ২০ হাজারের মতো চালক-হেলপার। এই পরিবহন শ্রমিকদের অনেকে লকডাউনে পেশা পাল্টিয়ে রিকশা চালাচ্ছেন। অন্য জেলার যারা চট্টগ্রামে বসবাস করতেন তাদের একটি বড় অংশও গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন।
চট্টগ্রাম অটোরিকশা-অটোটেম্পু শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘নগরীতে ১৩ হাজার নিবন্ধিত সিএনজি অটোরিকশা রয়েছে। প্রাইভেট অটোরিকশা, অটোটেম্পুসহ আরো দুই হাজার গাড়ি রয়েছে। এসব গাড়ির চালানোর সাথে প্রায় ২০ হাজার চালক রয়েছে। একেকজন শ্রমিক মানে একেকটি পরিবার। জেলাতেও ৪০ হাজারের অধিক সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও অটো টেম্পু শ্রমিক রয়েছে। গ্রামের পরিবহন শ্রমিকরা নিজেদের বাড়িতে থাকলেও নগরীর শ্রমিকদের বেশিরভাগই ভাড়া বাসায় থাকে। বিভিন্ন সময়ে এনজিও থেকেও অনেকে ঋণ নিয়ে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করেছেন। গত বছর লকডাউনের কারণে সকলেই দেনায় জর্জরিত। সেই দেনা পরিশোধ না করতেই এ বছর আবারও লকডাউন চলছে। এতে না খেয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে চট্টগ্রামের ৬০ হাজার সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিকের।’ তিনি বলেন, ‘গত বছর সিএমপির পক্ষ থেকে কিছু শ্রমিকদের জন্য ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। এবারে অটোরিকশা শ্রমিকরা তা থেকেও বঞ্চিত। সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিকদের জন্য সিএমপির পক্ষ থেকে খাদ্য সহায়তা দিলে চলতি রমজানে অন্তত কিছু শ্রমিকের পরিবারে আহারের সংস্থান হতো।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মো. মুসা বলেন, ‘কঠোর লকডাউন ঘোষণা দেওয়া হলেও অনেক পরিবহন চলছে। ছোট বাইক চলছে। কিন্তু গণপরিবহন বন্ধের নামে আঞ্চলিক ও দূরপাল্লার বাসগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। অথচ স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলাচল করলে করোনা ছড়ানোর কোনো আশংকা নেই।’ তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে বাস, মিনিবাস, হিউম্যান হলারের ২০ হাজার শ্রমিক রয়েছে। এখন অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটছে সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের। তাই আমরা তিনটি দাবি নিয়ে মানববন্ধন করেছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চালানোর সুযোগ দেওয়া, সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের নির্ধারিত কল্যাণ তহবিল থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের আর্থিক অনুদান প্রদান এবং সরকারি ওএমএসের ১০ টাকা কেজির চাল আইডি কার্ডের মাধ্যমে পরিবহন শ্রমিকদের সরবরাহ করার দাবি জানিয়েছি। আশা করছি, সরকার মানবিক আচরণ করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চালানোর অনুমতি দেবে এবং সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াবে।’