সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশে নতুন করে দেড় কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছেন। আর চাকরি বা কাজ হারিয়েছেন দেশের মোট শ্রমশক্তির তিন শতাংশেরও বেশি মানুষ। গত ১৭ এপ্রিল এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরেছে সিপিডি। প্রতিবেদনে বলা হয়, চাকরি হারানোদের মধ্যে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ শহরাঞ্চলে অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। ২০২১ সাল শেষ হতে এখনও প্রায় আট মাস বাকি। এ সময়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ কর্মহীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগে করোনার প্রথম ঢেউয়ে ২০২০ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাসে চার লাখ অভিবাসী শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে সিপিডি। গত ১২ এপ্রিল বিশ্ব ব্যাংকও এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানিয়েছে। ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট- মুভিং ফরওয়ার্ড : কানেক্টিভিটি অ্যান্ড লজিস্টিকস টু স্ট্রেন্থেন কম্পিটিটিভনেস’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে বিশ্ব ব্যাংক উল্লেখ করেছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হার কমেছে এবং দুই দশকের মধ্যে এই প্রথম দেশে দরিদ্র কমার প্রবণতা বিপরীতমুখী। করোনায় কর্মহীন জনগোষ্ঠী নিয়ে অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের গবেষণায়ও উঠে এসেছে এরকম তথ্য। এতে বলা হয়েছে, সারা দেশে (প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের) ১ কোটি ৪৪ লাখ কর্মী কাজ হারিয়েছেন অর্থাৎ এখনও কাজে ফিরতে পারেননি। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে ৮ দিনের দ্বিতীয় দফার ‘কঠোর লকডাউন’। ফলে অনেকে নতুন করে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। এতে বেকারের তালিকা আরও দীর্ঘ হবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের গবেষণায় দেখানো হয়- দেশে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে ৬ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার মানুষ কর্মে নিয়োজিত ছিলেন।
শুধু লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়েছেন ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন। অর্থাৎ মোট কর্মগোষ্ঠীর ৫৯ শতাংশ মানুষই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকার হয়েছে সেবা খাতে। এ প্রসঙ্গে ড. আবুল বারকাত পত্রিকান্তরে জানান, কাজ হারানো মানুষের মধ্যে ৪০ শতাংশ সামনে কোনো কাজ ফিরে পাবে না। তাদের জন্য তিনি সরকারের কাছে বেকারদের ভাতা চালুর সুপারিশ করেছেন। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে সাময়িক ভাতা দেওয়ার চেয়ে শ্রেয় হবে তাদের কাজ দেওয়া। এ ব্যাপারে সরকারকে ভাবতে হবে। এই অর্থনীতিবিদের মতে, করোনার প্রভাবে আগামীতে কর্মসংস্থানের প্যাটার্নও পালটে যাবে। যেখানে গুরুত্ব বাড়বে প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতাভিত্তিক কর্মসংস্থানের। সেদিকে সরকারকে নজর রাখতে হবে।
এবারও লকডাউন দীর্ঘ হলে সাধারণ মানুষ বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন আগামীতে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া হবে কর্মসংস্থানকে। এমন কিছু পদক্ষেপ থাকবে যেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকনির্দেশনা থাকবে। বেকার সমস্যা ও কর্মসংস্থান প্রধান চ্যালেঞ্জ এটি অর্থমন্ত্রীর একটি বক্তব্য থেকেও বেরিয়ে এসেছে। সমপ্রতি এডিবির প্রেসিডেন্টকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, অর্থনীতির অবস্থা ভালো ছিল। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। কিন্তু করোনার কারণে প্রবৃদ্ধি কমিয়ে আনা হয় ৫ দশমিক ২ শতাংশে। করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী চাহিদা কমেছে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানিতে নেতিবাচক অবস্থা তৈরি হয়েছে। এ মহামারি দেশের শিল্প ও সেবা খাতের সরবরাহ এবং উৎপাদন পরিস্থিতিকে আঘাত করেছে। পাশাপাশি রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। অনেকে কর্মচ্যুত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত দশকের তুলনায় এবার দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কোভিড-১৯ এর প্রভাবে কর্মহীন ও আয় বন্ধ হয়ে যাওয়া দরিদ্র মানুষদের জন্য নগদ টাকা প্রদান জরুরি হলেও তার বাস্তবায়ন সুদূরপ্রসারী ও কল্পনার বাইরে। কেননা পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ও বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিনের জরিপের কথা ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সেক্ষেত্রে আমাদের জরিপে উঠে এসেছে প্রতি মাসে দরিদ্র্য মানুষদের জন্য খরচ হবে পাঁচ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। এতো টাকা প্রদান রীতিমত দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই সংকট মোকাবেলা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।