১৯৭১ সাল। পঁচিশে মার্চের পর বেশ কিছুদিন চট্টগ্রাম শহর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দখলমুক্ত থাকলেও এপ্রিলের মাঝামাঝিতে পাকিস্তানীদের দখলে চলে যায়। তখন আর শহরে থাকা নিরাপদ মনে করলাম না। চলে গেলাম গ্রামে। শহর ছেড়ে সবাই চলে যাচ্ছে গ্রামে। বাস-ট্রেন রাস্তায় নেই বললেই চলে। রাস্তায় টহল দিচ্ছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। যাকে খুশি তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বাস থেকে নামিয়ে লাইন করে গুলি করে মেরে ফেলে রাখছে। মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই তাদের কাছে। রাজপথে হাঁটা মানেই মৃত্যু নিশ্চিত। তাই সবাই হেঁটে গ্রামের অজানা- অচেনা পথ ধরে চলছে গ্রামের বাড়িতে। শহরে বসবাসকারী হাজার হাজার মানুষ শত শত মাইল হাঁটছে। এ যাত্রা স্বাভাবিক যাত্রা নয়। সঙ্গে টাকা পয়সা, মূল্যবান মালামাল, নিজস্ব সম্বল বহন করছে। কারণ কেউ জানে না কখন দেশ শত্রুমুক্ত হবে, ফিরে আসবে শহরের নিজ কর্মস্থলে। দিন গড়িয়ে রাত হচ্ছে, আবার দিন। এভাবে মাইলের পর মাইল গ্রামের মেঠো পথ ধরে কয়েক দিন হেঁটে যাচ্ছে তাদের গন্তব্যস্থলে। রাতে আশ্রয় নিয়েছে অজানা অচেনা গ্রামের কোনো বাড়িতে। গ্রামের তরুণ-তরুণী স্বেচ্ছায় সংঘবদ্ধভাবে এসব লোকের খাওয়া-থাকার সকল বন্দোবস্ত করছে। নিজের ঘর ছেড়ে দিয়ে তাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করছে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পানি খাওয়াচ্ছে। গ্রামে তখন বিদ্যুৎ ছিল না। অন্ধকার পথে চলছে শহুরে তরুণ- তরুণী, আবালবৃদ্ধবনিতা। কারো মনে কোনো ভয় নেই। কেউ তাদের ক্ষতি করছে না। গ্রামের সাধারণ মানুষ, যাদের যা আছে তাই নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে অসহায় পথযাত্রীদের প্রতি। কারো মনে লোভ- লালসা, হিংসা-দ্বেষ কিছু ছিল না। শুধু ছিল মানুষের প্রতি ভালোবাসা। এ দৃশ্য বর্তমান সময়ের জন্য অকল্পনীয়। মানুষের প্রতি মানুষের এই যে ভালোবাসা-সেটিই ছিল সত্যিকারের দেশপ্রেম।
গ্রামে কয়েক মাস কেটে গেল। স্কুল- কলেজ সব বন্ধ। শহরে বসবাসকারী লোকজন সবাই গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। সবার চিন্তা দেশকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করতে হবে। আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজের ডিগ্রির ছাত্র। ছাত্র ও তরুণ সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য। আমরা প্রায় ৭০ জনের একটি দল সংঘবদ্ধ হলাম। সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নেব। রাতের অন্ধকারে আমাদের সীমান্ত পাড়ি দিতে হবে। দিনক্ষণ ঠিক হলো। সবাইকে জানানো যাবে না। মাকে বললাম। মা তাঁর একটি সোনার আংটি আমাকে দিয়ে বললেন, এটি সম্বল হিসেবে নিয়ে যাও। এটি আমার খুব কাজে লেগেছিল ভারতের মাটিতে। একজন মা তাঁর সন্তানকে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পাঠাচ্ছে- এটি একজন মায়ের জন্য কতটুকু আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের পরিচয় তা আজকের সময়ে আমাদের পক্ষে অনুধাবন করা খুব কঠিন।
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। আমরা তখন আখাউড়া সীমান্তে । চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে চলছে তুমুল যুদ্ধ। আমাদের ক্যাম্প আগরতলা শালবাগানে। আমাদের একজন সহযোদ্ধা যুদ্ধে আহত। বয়স বারো অথবা তেরো বছর। রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তাকে ক্যাম্পে নিয়ে আসা হলো। আমরা বুঝতে পারছিলাম সে বাঁচবে না। তার বাড়ি আখাউড়া সীমান্ত থেকে কিছু দূরে একটি গ্রামে। তার মা ছাড়া পরিবারে আর কেউ নেই। আমরা তাকে বললাম, তোমাকে তোমার মায়ের কাছে পৌঁছে দিই? উত্তরে সে বলল, ‘আমার মৃতদেহ আমার মায়ের কাছে এখন পৌঁছাবেন না এবং কোনো সংবাদ ও দেবেন না। কারণ শোকে আমার মা মারা যাবেন। আমাদের দেশ অচিরেই স্বাধীন হয়ে যাবে। তখন আমার মাকে আমার মৃত্যুসংবাদ জানাবেন। স্বাধীনতার আনন্দের মাঝে আমার মা হয়তো সেদিন এ সংবাদ বরণ করে নেবেন।’ ১২-১৩ বছরের একটি অশিক্ষিত ছেলে যাকে এ দেশ কিছুই দিতে পারেনি, সে রেখে গেছে দেশপ্রেমের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সে শুধু দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেনি, সে জীবনের শেষ মুহূর্তে যে কথাগুলো উচ্চারণ করেছিল, সেরূপ চিন্তাশক্তি ও মনোবল আমাদের কয়জন শিক্ষিত লোকের মাঝে বিদ্যমান?
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। ১ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টারের অবস্থান তখন চট্টগ্রাম-ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের পাশে, বাড়বকুণ্ড আনোয়ারা জুট মিলে। কুমিরা ব্রিজের দক্ষিণ পাশে পাকিস্তানী বাহিনীর অবস্থান। আমাদের সঙ্গে যারা ছিল তারা অধিকাংশই অশিক্ষিত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। মিলের অফিসার্স কোয়ার্টারে আমরা থাকতাম। এই সকল কোয়ার্টারে অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র ছিল। যেমন- ক্যাসেট প্লেয়ার, ঘড়ি ইত্যাদি। তখনকার সময় এগুলো বেশ দামি ও আকর্ষণীয় বস্তু ছিল। আমরা চলে যাওয়ার সময় কেউ একটি সামান্য জিনিসও স্পর্শ করেনি। সেদিন কারো কোনো লোভ-লালসা ছিল না, কোনো চাহিদা ছিল না, ছিল শুধু দেশের জন্য ভালোবাসা। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর আমাদের সেক্টর সদরদপ্তর বাড়বকুণ্ডের আনোয়ারা জুট মিল থেকে চট্টগ্রামের নিয়াজ স্টেডিয়ামে (বর্তমান এম এ আজিজ স্টেডিয়াম ) স্থানান্তরিত হয়। দীর্ঘ নয় মাস পর শত্রুমুক্ত শহরে পদার্পণ করে সেদিন যে কী আনন্দ উপভোগ করেছিলাম, তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। অতি পরিচিত চট্টগ্রাম শহরে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে হলো। লোভ সামলাতে পারছিলাম না। বিকালবেলা বের হয়ে পড়লাম। কোথাও শহরের সেই কর্মব্যস্ততা নেই। লোকজন সব ভয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে পালিয়ে গেছে। দোকানপাট সব বন্ধ। এখানে- সেখানে অল্প কিছু লোক জয়োল্লাস করছে। মাঝে মাঝে দু-একটা দোকান খোলা আছে। লোকজনের মাঝে আতঙ্ক তখনো কাটেনি। রাস্তায় যানবাহনের কোনো ঝঞ্ঝাট নেই। আমি আমার দুজন মুক্তিযোদ্ধা সঙ্গীকে নিয়ে হাঁটছিলাম রেয়াজউদ্দিন বাজারের আমতলা দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেওয়া একজোড়া ভারতীয় জংলি বুট ছিল আমার পায়ে। এটি একটু ছিঁড়ে গিয়েছিল। রেয়াজউদ্দিন বাজারের আম-তলায় অনেক মুচিই বসে থাকে। সে সময় শুধু একজন মুচি সেখানে দেখতে পেলাম। ভাবলাম একটু জুতাটা সেলাই করে নিই। মুচি খুব আগ্রহ সহকারে আমার জুতাটা সেলাই করে দিল। আমি পারিশ্রমিক হিসাবে চারআনা পয়সা দিলাম। সে পয়সা না নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। চারআনা পয়সা তাঁর মজুরি হিসেবে কিন্তু তখন কম ছিল না। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বলল, স্যার আপনার থেকে আমি পয়সা নেব? আপনারা দেশের জন্য এত কিছু করলেন, আমাকে আপনাদের জন্য এই সামান্য কাজটুকু করার সুযোগ দেবেন না? আমাকে দেখে তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের সামান্য একজন মুচির মুখের এই কথাটি আমাকে সেদিন আবেগাপ্লুত করেছিল। আমি ভেবেছিলাম তখন দেশের জন্য তার মায়া এবং ভালোবাসা আমার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ গরিব হতে পারে, কিন্তু তারা দেশপ্রেমিক। দেশকে তারা ভালোবাসে।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের বেশ কয়েকদিন পর আমি ট্রেনে চট্টগ্রাম শহর থেকে গ্রামে যাচ্ছিলাম। ট্রেনে খুব ভিড়। বসার জায়গা ছিল না। যাত্রীদের টিকেট চেক করার জন্য কোনো টিটিই ছিল না। যাত্রীরাই যাত্রীদের চেক করছিলেন। একজন অপরজনকে বলছিলেন, ‘আমরা এখন স্বাধীন, এ দেশ আমাদের। টিকেট না করলে আমাদের দেশ ঠকবে।’ কথাটি আমার কানে বারবার বাজছিল। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের মাঝে দেশপ্রেমের যে চেতনা জাগ্রত করেছে, তা যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি তাহলে আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতার সত্যিকার সুফল আসবে।
একাত্তরের সেই দিনগুলোতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সামরিক শক্তির পাশে কে এসে দাঁড়ায়নি? ছাত্র, যুবক, কৃষক, ব্যবসায়ী এমনকি শিশু-কিশোর, মা-বোনেরা পর্যন্ত তাদের নিজ নিজ শক্তি নিয়ে যে যেভাবে পেরেছে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এই শক্তি উঠছে তাদের দেশের প্রতি ভালবাসা থেকে-এই শক্তি সারা দেশের মানুষকে মিলিত এক শক্তিতে-এক পরিচয়ে গুচ্ছীকৃত করেছিল। সে পরিচয়-মুক্তিযোদ্ধা। দেশপ্রেমের সেই আদর্শে যদি দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করা যায়, তাহলে আজকের অনেক সমস্যার খুব সহজ সমাধান হবে বলে আমার বিশ্বাস।
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজম্ম সত্যিকারভাবে দেশপ্রেমিক হবে। মনেপ্রাণে দেশ এবং দেশের মানুষকে ভালোবাসবে। মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের মানুষের দেশপ্রেম এবং আত্মত্যাগ তাদের হৃদয়কে নাড়া দেবে-এ বিশ্বাসেই আমার এ প্রচেষ্টা।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ