মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরিবার : ইতিহাসে লেখা আছে যার নাম

জোবায়দা আক্তার চৌধুরী | বুধবার , ৩১ মার্চ, ২০২১ at ৫:০০ পূর্বাহ্ণ

অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা দেশমাতৃকাকে বাঁচানোর জন্য জীবন বাজি রেখে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আবার অনেকে আছেন খুব অল্প বয়সে পাক হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ নিজ চোখে দেখেছেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই ভয়াবহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের একজন আমার বড় ভাই কফিল উদ্দিন মাহমুদ চৌধুরী (সোহাগ)। এমন অনেক পরিবার আছে যুদ্ধের সময় আপনজনের প্রাণ বাঁচাতে এবং তাদের পরিবারকে গ্রামের পর গ্রাম পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে পায়ে হেটে, কখনো রিঙায় কখনো জমিনের আইল ধরে। এমনই এক পরিবারের যুদ্ধকালীন ইতিহাস তুলে ধরতে চাই। সেই পরিবার আমাদের পরিবার। আমার বাবা মরহুম এডভোকেট ওয়াহিদুর রহমান চৌধুরী। ১৯২৬ সালে তাঁর জন্ম। তিনি সরকারি চাকরি করতেন। পশ্চিম পাকিস্তানীদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার উদ্দেশ্যে সরকারি চাকরি ছেড়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালের আইউব বিরোধী আন্দোলনে উনি সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ১০নং গোপাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। সেজন্য তিনি হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকারদের দ্বারা নির্যাতিত হন। তিনি চল্লিশ বৎসরের অধিক সময় আইন ব্যবসা করেন। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। আমার বাবা অল বেঙ্গল ছাত্রলীগের জয়েন্ট সেক্রেটারী থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সাথে সুসম্পর্ক তৈরী হয়। তিনি ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ছিলেন। বাবার লেখা বেশ কয়েকটি বই স্কুলের পাঠ্য ছিল। তাঁর লেখা অনেক বই বাংলা ও ইংরেজিতেও প্রকাশিত হয়েছে। তিনি শিল্প উদ্যোক্তাও ছিলেন। কিন্তু রাজনীতি করার কারণে ব্যবসায় ঠিক মনোনিবেশ করতে পারেন নি।
আমাদের গ্রাম ছাগলনাইয়া নিজকুঞ্জরা গ্রামে। গ্রাম থেকে ভারতের শ্রীনগর গ্রাম তিন মাইলের বেশী দূরত্ব হবে না। ট্রেনিং এর জন্য ভারতে গমনেচ্ছু আগ্রহী মুক্তিযোদ্ধাদের যাতায়াতের সহজতর জল ও স্থল রাস্তা নিয়ে। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখাশুনা এবং পথ প্রদর্শনে আমার আব্বাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। আমার বাবা বাড়ি বাড়ি যেয়ে অল্প বয়সীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করতেন এবং তাদের সংগঠিত করে নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে তাদের ট্রেনিং এ পাঠিয়েছেন। এ সংবাদ পাক হানাদার বাহিনীর নজরে যাওয়া মাত্রই আমাদের এলাকায় পাক হানাদার বাহিনীর আগমন, খুনখারাপী, লুটতরাজ, জ্বালানি পোড়ানি শুরু হয়। গ্রামবাসী তখন জীবন, সম্ভ্রম ও সম্পদ রক্ষার্থে তারা দেশান্তরে গমন করে।
একদিনে গ্রামের নিরীহ ১২০ জনকে চেয়ারম্যান আহমদ হোসেন চৌধুরী সহ পাক বাহিনী হত্যা করেছে। অন্যান্য বাড়ির মত আমাদের ঘর বাড়ি যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঐ কারণে আমার বাবাকে সপরিবারে ফেনীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে, বিরলি এবং চট্টগ্রামের মীরশ্বরাই থানার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে থাকতে হয়েছে।
দেখা যেতো প্রতিদিনই পাক আর্মিরা বাড়িতে হানা দিত। আগুন দিত বাড়ি ঘরে। নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাতো। আবার ইন্ডিয়া থেকে পাক আর্মিদের উপর গুলি ছুঁড়লে সেটাও আমাদের বাড়ির উপর এসে পড়তো। যুদ্ধ চলাকালীন সময় পাক আর্মির তান্ডব প্রতিদিনই চলতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাগলনাইয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অপরিসীম।
ছাগলনাইয়ার যুদ্ধের কথা এবং বিলোনিয়া তথা পুরো ফেনী জেলার যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা নিশ্চয়ই অনেক বিজ্ঞ জনেরই জানা। ইতিহাসের পাতাতেও এই এলাকার যুদ্ধের বর্ণনা লেখা আছে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যখন স্বাধীনতার ডাক আসে তখন আমার বাবা ছিলেন ১০নং গোপাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। মার্চের শেষের দিকে হঠাৎ করেই আমাদের গ্রামের বাড়ি এট্যাক করে পাক আর্মিরা। চারদিক থেকে গুলির বিকট শব্দে সবাই ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। চারদিক থেকে আর্তচিৎকার আহাজারী বাঁচাও বাঁচাও শোনা যাচ্ছিলো। কী হচ্ছে বোঝার আগেই আশেপাশের গ্রাম গুলোতে আগুনের শিখা দেখা যায়। মানুষের ঘর বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় পাক আর্মিরা। দূরের গ্রাম গুলো থেকে তখন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুনের লেলিহান শিখা যখন খুব কাছের বাড়িগুলোতে দেখতে পেল তখন সবাই বুঝতে পারলো পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ নিয়েছে। বাড়ির মানুষ তখন দিকবিদিক শূন্য হয়ে যে যেদিক পেরেছে ছুটে পালিয়ে যায়। আমার মা সাহিদা আক্তার চৌধুরী ছিলেন তখন গর্ভবতী। এক সন্তান গর্ভে ও পাঁচ সন্তানকে সাথে নিয়ে আমার মা দূরের খালের ভেতর কাদামাটির ভেতর লুকিয়ে ছিল। অনেক সময় পুকুরে কচুরীপানার ভেতর ডুবে থাকতো। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার কারণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর, রাজাকারদের রোষানলে পড়েন আমার বাবা। প্রতিদিনই বাবাকে ধরার জন্য তারা বাড়িতে এসে হানা দেয়। বাড়ির নারী পুরুষরা তখন জলে জঙলায় পালিয়ে বেড়াতো। আমার বাবা তখন সারাদিন মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রমে ব্যস্ত থাকতেন আর রাত গভীর হলে আবার বাড়ি ফিরে আসতেন। আমার বাবারা ছিলেন দুই ভাই। আমার জ্যাঠা ছিলেন মরহুম মফিজুর রহমান। দুই ভাইয়ের ভেতর আমার বাবা ছোট। একদিন আমাদের বাড়ির উপর ধ্বংসযজ্ঞ চলাকালীন আমার জ্যাঠা বাড়ির সকলকে নিয়ে অর্থাৎ বাবা জ্যাঠার দুই পরিবারের সকল কে নিয়ে আরেকটি গ্রামে লাঙ্গোলমোড়ায় একটা খালের ভেতর একেবারে কাদার ভেতরে যেয়ে আশ্রয় নেন।
এপ্রিলের শুরুর দিকে শুভপুর ব্রীজে পাকিস্তানি আর্মিদের উপর আক্রমণ চালায় বেঙ্গল রেজিমেন্ট।ব্রীজে আগুন দেয়াতে পাক সেনারা আটকা পড়ে যায়।সেখানে কয়েকজন পাক সেনারা মারা যায়। অপারেশন চালানো হয় ১ নাম্বার সেক্টরের অধীনে।যদিও তখন সেক্টর ভাগ হয়নি। যুদ্ধের ভেতর আমার বাবা বোর্ড অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দেন। বাবাকে তারা খুঁজে পেতো না। পাকিস্তানিরা চাইতো বাবা তাদের পক্ষে বক্তব্য দিক। কিন্তু আমার বাবা তার প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করছেন তখন। এদিকে ভেতরে ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা করতে থাকেন। তখন তাদের আক্রোশটা পুরোপুরি বাবার উপর এসে পড়ে। বাবাকে তারা পাগলের মতো খুঁজতে থাকে। দু’বার ধরেও নিয়ে গেছিলো। একবার ধরে নিয়ে অনেক অত্যাচার করে। পরে ভুল তথ্যের উপর ছেড়ে দেয়। যাকে ছাড়ার কথা তাকে না ছেড়ে আমার বাবাকে ছেড়ে দেয়। আরেকবার বাস থেকে আমার বাবা সহ অনেককে নামিয়ে একসাথে সবাইকে ব্রাশফায়ার করার জন্য দাঁড় করায়। আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে সেদিন আমাদেরই গ্রামের এক আর্মি অফিসার তাদের মধ্যে ছিল। আমাদের দেশের অনেক আর্মি অফিসার তাদের ভেতর থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। তাদেরই ভেতর একজন আমার বাবার পরিচয় গোপন করে বলে যাকে খুঁজছো ইনি সে না। সে যাত্রায় বাবা বেঁচে ফিরলেও অন্যরা বাঁচতে পারেনি। কাকতালীয় ভাবে দু’বারই প্রাণে বেঁচে ফিরেন। প্রতিদিনই বলতে গেলে ফেনী ছাগলনাইয়ায় যুদ্ধ চলতে থাকে।সবাই চিন্তা করলো বাড়ির ছেলেদের গ্রামে রাখা নিরাপদ না। এভাবে চলতে থাকলে এই বাড়ি পুরুষ শূন্য হয়ে পড়বে। রাতে বাড়ির সকল মুরুব্বিরা মিলে বাড়িতে একটা মিটিং করেন। সেখানে আলাপ আলোচনা করে বাড়ির ছেলেদের বলা হলো তোমরা পালিয়ে যাও। তাদের ভেতর ছিল আমার বড় জ্যাঠাতো ভাই আবুল কাশেম চৌধুরী। তিনি তখন ইনকামট্যাঙ অফিসে ইন্সপেক্টর পদে ঢাকায় চাকরি করতেন। যুদ্ধ লাগাতে তিনি গ্রামে এসে পড়েন। আর ছিল আমার আপন বড় ভাই কফিল উদ্দিন মাহমুদ চৌধুরী সোহাগ ও আমার মেজো ভাই মঈনুদ্দিন মাহমুদ চৌধুরী । ওদেরকে বলা হলো তোমরা পালাও। বড় ভাই তখন ক্লাস নাইনে কিংবা টেনে পড়তো আর মেজো ভাই তখন খুব ছোট মাত্র পাঁচ বছরের ছেলে।
বাবা জ্যাঠা থেকে শুরু করে বাড়ির সকলে ওদের বলল আমরা বাঁচি মরি আমাদের নিয়ে তোমরা চিন্তা করবে না। তোমরা বেঁচে থাকো এটাই আমাদের চাওয়া। যেখানে পারো পালিয়ে যাও। পারলে তোমরা ইন্ডিয়ায় চলে যাও। বড়দের কথা মতো ওরা তিনজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। সেদিন তারা বেরিয়ে পড়ে ঠিকই। কিন্তু জীবন নিয়ে নানা প্রান্তে ছুটোছুটি করতে হয়েছে তাদের। ভয়াবহ যুদ্ধের ভেতর পড়ে তারা। যখন যেখানে পেরেছে লুকিয়ে নিজেদের জীবন বাঁচিয়েছে।
দেশ স্বাধীন হবার পর আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট পেয়েও তার সুফল ভোগ করেন নি কখনো। আমরা যখনই প্রাপ্তির কথা বলেছি, জবাবে একটা কথাই উচ্চারিত হয়েছে ‘কিছু পাওয়ার আশায় তো যুদ্ধ করিনি’। আজ আমার বাবা নেই। ২০০৫ সালের নভেম্বরের ৮ তারিখ তিনি দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা শুধু গর্ব করে বলতে পারি আমার বাবার গৌরবগাথা ইতিহাস আছে, আমার বাবার যুদ্ধকথা আছে। লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদ সাবের
পরবর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধে দেশপ্রেম