বাঙালি জাতি স্বাধীনচেতা ও বড় আবেগী জাতি। পরাধীনতায় মাঝে মাঝে আবিষ্ট থাকলেও বার বার জাগ্রত হয়ে স্বাধীন জাতির মহিমা গাথায় বহমান রয়েছে বিশ্বজাতি সত্তার গৌরব ইতিহাসে। বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হচ্ছে। এই পথ সহজ ছিল না, ১৯৪৭ সালে দুইটি দেশের জন্ম হয় ধর্মের ভিত্তিতে একটা ভারত অন্যটা পাকিস্তান।পাকিস্তান আবার দুইটা প্রদেশে ভাগ হয় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান।
কালেরস্রোতধারায় ইতিহাসের দিকে তাকালে একটু অবাক হই, ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের বিভক্তিকরণ কতোটা যুক্তিগত ছিল তাও আবার দুই হাজার মাইল ব্যবধানে দুইটি প্রদেশের অবস্থান থাকা সত্ত্বেও। ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, জীবনযাপন পদ্ধতি, খাওয়া দাওয়া ও পোশাক পরিচ্ছেদের কোন মিল ছিল না। শুধু একমাত্র মিল ধর্ম। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন রাষ্ট্রের উদ্ভব ও আর ভুক্তভোগী একমাত্র আমরাই বাঙালি জাতি। “ওরা আমাদের মুখের ভাষাও কেড়ে নিতে চেয়েছিল ” তারজন্যও পৃথিবীর ইতিহাসে অদ্বিতীয় ঘটনা আমাদের মেধাবী ছাত্রদের প্রাণ দিয়ে রক্ত ঝরিয়ে মায়ের ভাষাকে রক্ষা করতে হয়েছিলো। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মূলত বাংলার জনগণের মধ্যে স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার অভিপ্রায় জন্মেছিল। শোষণ আর বঞ্চনায় দীর্ঘ ২৪ বৎসর (১৯৪৭-১৯৭১) বাঙালিরা নীরবে সহ্য করলেও ভিতরে ভিতরে সবার মধ্যে ক্ষোভ আর আক্রোশে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়েছিল। তখনিই ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রবল গণজোয়ার সৃষ্টি করেছিলো।
পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও জনসংখ্যা অধিক থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রথম সংঘাতে দুইদেশের অসঙ্গতি ও মনোমালিন্য পুরোদমে শুরু হয়। অর্থনৈতিক বৈষম্যের মধ্যে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ, উন্নয়ন কর্ম পরিকল্পনা, রাজনৈতিক অসমতা, সামরিক বৈষম্য, কেন্দ্রীয় সরকার সুযোগ সুবিধা এমন কি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দামে পর্যন্ত বৈষম্যনীতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হারিকেন থেকে ৫ লক্ষ মানুষের প্রাণহানির পরও তাদের মনে মানবিকতা ছিটেফোঁটাও তৈরি হয়নি। ত্রাণকার্যে এগিয়ে না আসায় ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তীতে খাদ্য ও পানির অভাবে আরো প্রাণঘাতী ঘটে। এমন নিষ্ঠুর ও পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণে পূর্ব বাংলার নিরীহ ও সাধারণ জনতার আস্থার জায়গাটা শূন্যের কোটায় গিয়ে দাঁড়ায়। জনতা ক্ষুব্ধ আর প্রতিবাদমুখর হয়ে পরে। এমতাবস্থায় কবি নির্মলেন্দু গুণের সৃষ্টি দিয়ে বলি, শত বছরের শত সংগ্রামে শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন, গণ সূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শুনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
কোন আগাম ইঙ্গিত ছাড়া ঘুমন্ত মানুষের উপর ২৫ শে মার্চের গভীর রাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী “অপারেশন সার্চলাইট” নামে নিরীহ বাঙালিদের নির্বিচারে গণহত্যা করে ইতিহাসে বর্বরতার পরিচয় দিয়েছিল। এই নারকীয় বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞে লক্ষ লক্ষ প্রাণহানি ঘটে। তাদের মূললক্ষ্য ছিল বাংলায় শিক্ষিত সমাজকে বিলুপ্ত করে দেওয়া অর্থাৎ সুধী সমাজ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক বিভিন্ন পেশাজীবী সমাজসহ হিন্দুদের বিলীন করে দেওয়া। একদিকে একটা জাতির বলিষ্ঠ গুণধর্ম শিক্ষাকে বিনষ্ট করে দেওয়া মানে জাতিকে পঙ্গু করে দেওয়া আর হিন্দু নিধন করে মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এ লক্ষ্যে তারা নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে ঘুমন্ত অবস্থার রাতের অন্ধকারে চোরা গুপ্তা হামলায় ধ্বংস করে দেওয়ার পাশবিক পরিকল্পনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ আর দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। বাঙালী জাতি সেই বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের বীরযোদ্ধা মাষ্টারদা সূর্য সেন আর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদের মতো সাহসী ও অকুতোভয় বীরের জাতি। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল জাতিগঠনের মূলভিত্তি। কোন রকম অস্ত্র ও ট্রেনিং ছাড়া কৃষক শ্রমিক কুলি মজুর নারী পুরুষ সকল বয়সের একটা জাতি গেরিলা ট্রেনিং করে সুসজ্জিত সেনাবাহিনীকে মাত্র নয় মাসে পরাস্ত করে স্বাধীন পতাকা সবুজের মাঝে লাল বৃত্ত খচিত অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় নদীমাতৃক ও কৃষিপ্রধান সোনার বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়। সেই থেকে স্বাধীনতার জয় চিনিয়ে আনলো বাঙালি জাতি। বিশ্বের বুকে নতুন একটি দেশ বুকের তাজা রক্তে লিখেছি স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলায় স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না” এই অসাধারণ গানটির ইতিকথা যদি বলি সেইদিন সেই ঐতিহাসিক ১৬ই ডিসেম্বর পাক বাহিনী আত্মসমর্পণের সেই সন্ধ্যায় সুর করেছেন প্রখ্যাত সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী আপেল মাহমুদ, মূল কণ্ঠ স্বপ্না রায় আর গীতিকার ছিলেন ভারতের গোবিন্দ হালদার। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে নিরস্ত্র অগণিত সাধারণ মানুষের হৃদয়ে দেশপ্রেমকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করতো অসাধারণ মর্মস্পর্শী কথা ও সুরের দেশমাতৃকাকে বাঁচানোর গণসংগীতের গণজোয়ারে।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলার সর্বস্তরের, সব ধর্ম ও বর্ণের জনমানুষ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও নীরব থাকেনি। কেউ মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন, কেউ কলমে জাতি গঠন করেছেন, সংগীত শিল্পীরা গানে গানে প্রাণের বন্ধনে মেতেছেন, কেউ বিশ্বের জনমত গঠনে সারাবিশ্বে চষে বেড়িয়েছেন, অনেকে মুক্তিবাহিনীকে নিয়ে নাটক, সিনেমা তৈরি করেছেন এবং অনেকে মুক্তি সংগ্রামে সরাসরি অংশগ্রহণ না করেও মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন খবরাখবর, খাদ্যদ্রব্যের যোগান দেওয়া এমনকি গোপন স্থানে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করে দেওয়াসহ চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। তাই দেশ সকলের কাছে সমান মাতৃভূমি। এ প্রসঙ্গে তুলে ধরতে চাই, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে মহান মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধ ভিক্ষুদের অবদানও অনস্বীকার্য। সংসারত্যাগী বুদ্ধপুত্র পণ্ডিত জ্যোতিপাল মহাথের মহামতি বুদ্ধের নির্দেশিত অহিংসার বাণী নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে আন্তজার্তিক জনমত গঠনে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। তাই স্বাধীনতা পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ অবদানে তিনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অর্জন করেন। তিনি ২০১০ সালে মরণোত্তর একুশে পদক এবং ২০১১ সালে স্বাধীনতা পদক লাভ করেছেন। অন্যদিকে মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধনন্দ মহাথের দেশের অভ্যন্তরে বৌদ্ধদের জানমাল রক্ষাসহ অভ্যন্তরীণ মিশনারি কাজ করে অসাধারণ দায়িত্ব পালন করে সকলের প্রশংসাসহ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি একুশে পদক প্রাপ্ত হন। বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ভিক্ষু সুনীথানন্দ রচিত “বাংলাদেশের বৌদ্ধ বিহার ও ভিক্ষু জীবন” গ্রন্থে বর্ণিত আছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রয়াত মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের মাধ্যমে বৌদ্ধ পরিচয় পত্র দিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখেছিলেন। অনেক হিন্দু, মুসলমানকে প্রাণে রক্ষা করেছেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মানব সেবা, ধর্মপ্রচার, শিক্ষাব্রতী এবং দেশ মাতৃকার জন্য নিবেদিত প্রাণ। উল্লেখ্য যে, ১৯৯৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের উদ্যেগে আয়োজিত সুধী সমাবেশে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরুদের অবদান শ্রদ্ধার সংগে স্মরণ করে তিনি বলেন, বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের প্রয়াত সভাপতি মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের ও সংঘরাজ পন্ডিত জ্যোতিপাল মহাথের, এদের মধ্যে একজন স্বদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন, আশ্রয় দিয়েছিলেন, “অন্যজন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের প্রতিনিধি হয়ে, বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে তাঁদের অবদান জাতি কোনদিন ভুলতে পারবে না”।
দেশ স্বাধীন হয়েছে চারটি মূলস্তম্ভের উপর জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। কারণ ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্রে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। স্বাধীনতার পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামোসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে বৈদেশিক সম্পর্ক তৈরি করা, জনসাধারণের মৌলিক অধিকার যোগান দেওয়া, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা, বিশেষ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংবিধান রচনা করা প্রভৃতিসহ আরো কত কত নানামুখী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু যখন তেজোদীপ্ত শক্তি, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর দূরদর্শি চিন্তা চেতনা নিয়ে দেশ গঠনে এগিয়ে যাচ্ছেন তখন যারা বাংলা ভাষা মনেপ্রাণে চাইনি এবং যুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলোতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে বন্ধু ভেবে আপন জ্ঞাতি স্বজনদের সাথে হিংসার্ত্মক আচরণে লিপ্ত ছিল তারাই আবার বাংলাদেশের আত্মাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে ও নানা কূটকৌশল ছালে ফায়দা লুটাইতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরে। এখানে বলতে হয়, দুই হাজার মাইল দূর থেকে কেউ এসে আমাদের ঘরের খবরাখবর নেওয়া কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। কথায় আছে,” ঘর শত্রু বিভীষণ”। সেই ঘাতকেরা বাংলার স্বাধীন সার্বভৌমত্বের বিপক্ষে অবস্থান করে বারবার গণতন্ত্রকে হত্যা করার মানসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলার আমজনতার দরদী বন্ধু, বাংলাদেশের স্থপতি, অবিসংবাদিত নেতা, মহান রাষ্ট্রনায়ক জাতিরপিতা মহানায়ক বঙ্গবন্ধুসহ সপরিবার ও আত্মীয় স্বজন সর্বমোট ২৬ জন সদস্যকে হত্যা করেছে ঠান্ডা মাথায়। বঙ্গবন্ধু এমন একজন বিশ্বনেতা যাঁকে এককথায় বলা যায়, “শোষিত মানুষের মুক্তির কণ্ঠস্বর”। যদিও আমরা যুদ্ধ করেছি পাকিস্তানীদের সাথে কিন্তু পাকিস্তানীদের হাতে তিনি মারা যাননি। আমরাই আমাদের বুকের ধন, প্রাণের অহংকারকে রক্ষা করতে পারিনি। বাঙালিদের হাতে তাঁর করুণ মৃত্যু হলো। দুঃখ করে বলতে হয়, বড় অকৃতজ্ঞ জাতি বাঙালি! আমরা লজ্জিত – আমাদের ক্ষমা করো পিতা।
বাংলাদেশ সরকার ব্যবস্থায় নানা পট পরিবর্তনে অস্থিতিশীল ও আস্থাহীন বহুদলীয় গণতন্ত্রের উত্থানে যে স্বকীয়তায় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম সে উদ্দেশ্য অনেকাংশ ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। আবারও ধর্মীয় রাজনীতির প্রভাব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে একমাত্র সাধারন ধর্মপ্রাণ জনগণের সহানুভূতি লাভ করার মানসে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উজ্জীবিত স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বপ্রথম সংবিধান রচনা হয় ১৯৭২ সালে। এ পর্যন্ত ১৭ বার সংশোধনী আনা হয়েছে। ১৯৮৮ সালে ৫ই জুন চতুর্থ সংসদে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে “রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম” করা হলেও বাঙালিয়ানার প্রভাব কখনোকখনো ছন্দপতন হলেও আবার ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে এক হয়ে উঠে। বাঙালি সংস্কৃতিতে রয়েছে বারো মাসে তের উৎসব। তাই বাঙালিরা সকল ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, পেশা, ছাত্র জনতা একচেতনার বাস করে ” আমরা বাঙালি”। সকল জাতীয় উৎসবে যেমন : অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, মহান বিজয় দিবসে আমরা হয়ে উঠি মিলেমিশে একাকার। আবার পহেলা বৈশাখে সকল বয়সের নারী পুরুষ নির্বিশেষে লাল-সাদা পোশাকে রঙিন হয়ে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি মঙ্গলশোভাযাত্রার মাধ্যমে। ঠিক সেরূপ প্রবারনায় ফানুস উৎসব, ঈদের দিন, দুর্গাপূজা, সরস্বতী পুজা, রথটানা উৎসব, বড়দিন, পহেলা ফাল্গুন, বর্ষায় প্রথমদিন, রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী, পিঠা উৎসব এবং প্রাণের বই মেলাসহ আরো নানা পুজা-পার্বনে আমরা বাঙালিরা মেতে উঠি প্রাণের আনন্দে অনন্য ভালোবাসায়। এইটার প্রমাণ করে বিশ্বে এখনো আমরা এক মহান জাতি অসামপ্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলাদেশে বাস করি। এ প্রসঙ্গে কবি দিজেন্দ্রলাল রায় কবিতার সাথে একাত্মা হয়ে বলি, “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে-আমার জন্মভূমি”।
কিছু ব্যর্থতার পরও স্বাধীনতার ৫০ বৎসর সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তান থেকেও এগিয়ে আছে। বিশ্বে রোল মডেল হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে আবার অনেকের মতে দক্ষিণ এশিয়ার “এমার্জিং টাইগার” বাংলাদেশ। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। ছোট্ট একটি ব-দ্বীপ খ্যাত মাত্র ৫৫,৫৯৮ বর্গমাইলে জনসংখ্যার আধিক্য থাকা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে পদ্মাসেতুর মত বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে বহুলাংশে, প্রাথমিক শিক্ষা সার্বজনীন ও সকলের জন্য নিশ্চিত, স্বাক্ষরতার হার, বিদ্যালয়ে ভর্তির হার, ছাত্রছাত্রীর সমতা, নারী শিক্ষার অগ্রগতি, নারীর ক্ষমতায়ন, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, টিকাদান কর্মসূচী, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি হয়ে ১৬১০ ডলার , নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হওয়া, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, পর্যটন শিল্পের বিকাশ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল তৈরী, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অনন্য ভূমিকা পালন, জনশক্তি রপ্তানি এবং সর্বোপরি প্রবাসীদের রেমিটেন্সে নতুন রেকর্ড বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশী। এ প্রসঙ্গে মনে করলাম, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের’। প্রবাসী জীবনে “মেইড ইন বাংলাদশ” এক অহংকারের নাম। বিশ্বের ৮০টি দেশে পোশাক রপ্তানি করে শীর্ষে অবস্থান করছে আমার সোনার বাংলা। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বলি, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে – এই বাংলায়’।
শেষান্তে বলি , ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে লাল-সবুজ অসামপ্রদায়িক স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি আর ২০২১ সালে তাঁরই সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভাষা শহীদ, ভাষা সৈনিক, বীর শহীদদের, বীর মক্তিযোদ্ধাদের, দেশের ক্রান্তিকালে জীবন আত্মদানকারী সাহসী শহীদের প্রত্যেকের প্রতি লাল সালাম ও কৃতজ্ঞতা জানাই। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুজ্জ্বল রেখে আগামী প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করতে পারলে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাবে আমাদের সকলের প্রিয় বাংলাদেশ। ২০২১ সালের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবমুখর আমেজে উদযাপন করবে বাঙালি জাতি। ইতিহাস ঐতিহ্য কৃষ্টি সংস্কৃতির অনন্য বাঙালি জীবন সমৃদ্ধময় ও স্বকীয়তাপূর্ণ হোক। দেশের সকল মানুষের মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থান নিশ্চিত হোক – এই প্রত্যাশা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে। বিশ্বনেতা ও প্রাণপ্রিয় নেতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদাত্ত আহবান, ” আসুন দলমত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি”। স্বাধীন সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সদাজাগ্রত থাকি এই হোক আমাদের সকলের প্রত্যয়। জয়তু সোনার বাংলাদেশ, জয়তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন এনজিও কর্মী