কেনিয়ায় জীববৈচিত্র্যের বিতর্ককে পুনঃবৃক্ষায়ন করার মাধ্যমে বৃহত্তর কার্যকরী একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে ওয়াঞ্জিরি মাথাই এক অবিস্মরণীয় নাম। পরিবেশকর্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক, নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত ওয়াঞ্জিরি মাথাই কেনিয়ায় পরিবেশ আন্দোলন এবং নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত। তাঁর নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সবুজ বেষ্টনী আন্দোলন’। ১ এপ্রিল ১৯৪৪ সালে এই মহিয়সী কেনিয়ার নাইয়েরিতে জন্মগ্রহণ করেন।
ওয়াঞ্জিরি মাথাই কেনিয়ার সংখ্যা বহুল জাতিগোষ্ঠী কিকিয়ু জাতিভুক্ত ছিলেন। ক্যাথলিক চার্চের মিশনারি স্কুলে পড়াশোনার জন্য ওয়াঞ্জিরি মাথাই ইংলিশে খুব ভালো ছিলেন। কেনেডি এয়ারলিফট বৃত্তি নিয়ে তিনি যখন ‘এনভায়রনমেন্টাল রেস্টোরেশন’ এর উপর পড়াশোনা করতে ১৯৬০ সালে আমেরিকা যান ঠিক সে সময়ে কেনিয়ায় বায়ু দূষণের হাত থেকে শহরকে মুক্ত করতে স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা আন্দোলন করছিলেন। জীববিজ্ঞানের উপর পড়াশোনা করা মাথাই দেশে ফিরেই মুখোমুখি হন বৈষম্যের, যার প্রতিবাদস্বরূপ পারিবারিক উপাধি ত্যাগ করে গ্রহণ করেন শুধুমাত্র জন্মনাম। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর চাকুরির কথা ছিল সেখানে গিয়ে দেখেন সেটা অন্য কাউকে দেয়া হয়েছে। এ-ঘটনায় লিঙ্গ এবং জাতিগত বৈষম্য ছিল স্পষ্ট। যদিও এ-ঘটনার পরেই জার্মানির এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রফেসর রেইনহল্ড হফম্যান তাঁকে ‘ভেটেনারি এনাটমি’র উপর কাজ করার জন্য গবেষণা সহকারি হিসেবে আমন্ত্রণ জানান যা পরবর্তিতে তাঁর পিএইচডি ডিগ্রীর পথ সুগম করে। জার্মানির গিসেন এবং মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের পর তিনি নাইরোবিতে ফিরে নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী লেকচারারের পদে যুক্ত হন। এই সময়েই ময়াঙ্গি মাথাইয়ের সাথে তাঁর বিবাহ হয়।
স্বামী ময়াঙ্গি মাথাইয়ের হাত ধরেই ওয়াঞ্জিরি মাথাইয়ের রাজনীতিতে প্রবেশ। যদিও পরিবেশ সমস্যা, লিঙ্গ এবং জাতিগত বৈষম্য নিয়ে ওয়াঞ্জিরি মাথাইয়ের কন্ঠস্বর সর্বদাই ছিল প্রতিবাদী। তিনি ছিলেন পূর্ব আফ্রিকার প্রথম নারী যিনি ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা চলাকালীন সময়ে ওয়াঞ্জিরি প্রথমে সিনিয়র লেকচারার, এরপর ভেটেরিনারি অ্যানাটমির বিভাগের চেয়ার এবং পরবর্তীত এসোসিয়েট প্রফেসার পদে উন্নিত হন যা ছিল কেনিয়ার ইতিহাসে কোন নারীর পক্ষে প্রথম। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরীরত অবস্থায় থাকাকালীন সময়ে তিনি নারীদের সম অধিকার নিয়ে সোচ্চার হন।
রেডক্রস সোসাইটি, কেনিয়া এসোসিয়েশন অফ ইউনিভার্সিটি উইম্যান, এনভাইরোনমেন্টাল লিয়াজো সেন্টারসহ বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন ওয়াঞ্জিরি মাথাই। ইউ এন ই পি বিভিন্ন পরিবেশ সংক্রান্ত বেসরকারি সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় সংযোগ ছিল পরিবেশ সংযোগ সেন্টারের কাজ। নারীদের নিয়ে কাজ করে এমন বিভিন্ন সংগঠনের সাথে মাথাই যুক্ত ছিলেন। এভাবে বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে কাজ করতে গিয়ে মাথাই দেখতে পান পরিবেশগত অবনতিই মূলত অনেক সমস্যার মূল কারণ। স্বামীর রাজনৈতিক প্রচারণার প্রতিশ্রুতি অংশ কর্মহীনদের কাজের ব্যবস্থা করা যা পূরণ করতে ওয়াঞ্জিরি মাথাই তাঁর পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ধারণাকে যুক্ত করেন। নিম্নবিত্ত কর্মহীনদের বৃক্ষ রোপণ করে জীবিকা অর্জনের পথ সৃষ্টি করেন। এনভিরোকেয়ার লিমিটেড নামে একটি সংস্থা যুক্ত হয় এই পরিকল্পনার সাথে। ফান্ডিংসহ বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয় অয়াঞ্জিরি এবং এনভিরোকেয়ার এবং তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। কিন্তু ওয়াঞ্জিরি এবং এনভিরোকেয়ারের পরিবেশ সংরক্ষণ এবং এর পুনঃস্থাপনের প্রচেষ্টায় উৎসাহ দেখে এগিয়ে আসে ইউ এন ই পি। জাতিসংঘের বসতি সংক্রান্ত সম্মেলন ‘হ্যাবিটেট ১’ এ পাঠানো হয় মাথাইকে।
বসতি সম্মেলনে মাথাই পরিবেশ পুনঃ সংস্থাপনে বৃক্ষরোপনের গুরুত্ব তুলে ধরেন যে প্রস্তাব রাখেন কাউন্সিল তা সমর্থন করেন। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে বিশাল মিছিল হয় নাইরোবিতে যার সাথে শুরু হয় ‘গ্রিন বেল্ট মুভমেন্ট’ এর কার্যক্রম। ওয়াঞ্জিরি মাতাই দেশের সকল নারীকে বৃক্ষ রোপণে উৎসাহী করে তুলেন। যে-যেই এলাকায় বসতি সেখানকার বন হতে সেই এলাকার বৃক্ষের বীজ হতে চারা করতে এবং তা রোপণ করতে নারীদের বৃত্তির ব্যবস্থা করেন ওয়াঞ্জিরি।
‘রেপ্লিনিশিং দ্য আর্থ’ বইয়ে ওয়াঞ্জিরি মাথাই ‘গ্রিন বেল্ট মুভমেন্ট’ বা ‘সবুজ বেস্টনী’ আন্দোলনের গুরুত্ব বর্ণনা করে বলেন যে সাধারণ জনগোষ্ঠীর এবং পরিবেশ আন্দোলনের বিভিন্ন সেমিনারে যে জিনিশটার গুরুত্ব প্রকাশ পায় তা হলো বিভিন্ন কমিউনিটির পরিবেশ রক্ষায় দায়িত্ব গ্রহণ করা এবং তা প্রতিবেশী অঞ্চল, রাষ্ট্র, এমনকি সারা বিশ্বে তা ছড়িয়ে দেয়া। এর অর্থ হল কঠোর পরিশ্রম করা, পরস্পরকে সাহায্য করা এবং একটা পরিবর্তনে উৎকৃষ্ট প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করা।
ব্যক্তিগত জীবনে ঝড়ের সাথে সাথে ওয়াঞ্জিরি মাথাইকে মুখোমুখি হতে হয় তাঁর রাজনৈতিক এবং সামাজিক কর্মকান্ডে। কঠোর এবং দৃঢ় ব্যক্তিত্বের ওয়াঞ্জিরি সর্বক্ষেত্রে দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করেন পরিস্থিতি। বিভিন্ন নারী সংগঠনের সম্মিলিত সংগঠন ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ উইম্যান অফ কেনিয়ার চেয়ারম্যান পদে বারবার হেরে গেলেও সকল বাধা পেরিয়ে তিনি তাঁর লক্ষ্যে ঠিকই পৌঁছে যান। বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হয়ে সংগঠনটি ব্যাংকরাপ্ট হলে তিনি পরিবেশের কাজে ফোকাস করে এ-যাত্রায় সংগঠনটি বিপদ উৎরে যায়। এভাবে মাথাই বারবার বিরোধীদের চক্রান্তে পড়লেও প্রতিবার দৃঢ়তার সাথে সব মোকাবেলা করে পরিবেশ আন্দোলনে নারীদের সম্পৃক্ত করে এগিয়ে যান।
ওয়াঞ্জিরি মাথাই নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে গ্রিন বেল্ট মুভমেন্টের কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মহলের সামনে তুলে ধরেন যা তাঁকে এই আন্দোলনে ফান্ডিং সহ এর বিস্তৃতি আফ্রিকার অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। পনেরটি আফ্রিকান দেশ থেকে পঁয়তাল্লিশ জন প্রতিনিধি পরবর্তী তিন বছর ধরে কেনিয়া ভ্রমণ করে এই আন্দোলন কীভাবে নিজ নিজ দেশে গড়ে তোলা যায় তা পর্যবেক্ষণ করে। এর মাধ্যমে মরুকরণ, বৃক্ষ নিধন, পানি সমস্যা এবং গ্রাম এলাকায় ক্ষুধা সমস্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
পরিবেশ রক্ষার বিপরীতে সরকারের বিভিন্ন বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মাথাই কঠোর অবস্থান গ্রহণের জন্য বারবার সরকারের রোষানলে পড়েন, জেলে যান। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে তিনি বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে হয়ে উঠেন প্রতীক। পাশাপাশি নারী অধিকার রক্ষায়ও তিনি সারাবিশ্বে আলোচনায় উঠে আসেন। সরকার তাঁকে পাগল মহিলা বলে আখ্যায়িত করলেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তাঁকে করেন পুরস্কৃত। রাইট লাইভ্িলহুড পুরস্কার, গোল্ডম্যান এনভাইরোনমেন্টাল পুরস্কার, নোবেল শান্তি পুরস্কার, ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার সহ অসংখ্য সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত হন ওয়াঞ্জিরি মাথাই। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ সালে এই পরিবেশকর্মী মহাত্মা অভারিয়ন ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন।