জন্ম থেকেই দৃষ্টি নেই সুমন পালের। তবে চোখে দেখতে না পেলেও সাধনায় সুরের জাদুকর হয়েছেন তিনি। চোখের দৃষ্টি কেড়ে নিয়ে প্রকৃতি যেন তার বিনিময়ে কণ্ঠে সুর দিয়েছে। তিনি আট-দশটি বাদ্যযন্ত্রও বাজাতে পারেন। সুরের সাথে তার সখ্যতা। সংগীতে চলে সংসার। কীর্তন, আধুনিক গান, পল্লীগীতি, রবীন্দ্র সংগীতসহ সব শাখায় তার সফল বিচরণ। জন্মান্ধ এই শিল্পীর কণ্ঠে গান শুনে মুগ্ধ হবেন যে কেউ। চোখে না দেখলেও ছোটবেলায় রপ্ত করেছেন হারমোনিয়াম, বাঁশি, মৃদঙ্গ, তবলা, পাখোয়াজ ও দোতারা। খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে পানছড়িতে সুমন পালের বাড়ি। গত বুধবার সুমন বাড়িতে যাওয়ার পর সুর নিয়ে সাধনার কথা বলতে থাকেন তিনি।
সুমনের জন্ম ১৯৮৩ সালে। নরেন্দ্র পাল ও নির্মলা পালের প্রথম সন্তান। একটু বড় হতেই বুঝতে পারেন চোখে দেখতে পান না। চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েও লাভ হয়নি। চিকিৎসক জানিয়েছেন, তিনি কোনোদিন দেখতে পাবেন না। চোখে অন্ধকার দেখলেও মনের আলোয় সুরের প্রতি মনোযোগী হন। দাদুর হাতে হাতেখড়ি। মাত্র ১২ দিনে হারমোনিয়াম বাজানো শিখে ফেলেন। এরপর গানই হয়ে ওঠে তার একমাত্র অবলম্বন। কৈশোরে অন্যদের মতো খেলাধুলা করতে না পারায় সেই সময়টুকু সংগীত নিয়ে সাধনা করতেন তিনি। কোনো একাডেমিতে সংগীত শেখার সুযোগ পাননি। রেডিও ও ক্যাসেটে গান শুনে ধীরে ধীরে বিভিন্ন সংগীত রপ্ত করেন। ১৯৯৯ সালে খাগড়াছড়ি টাউন হলে জনসম্মুখে প্রথম গান করেন সুমন পাল। তার গান ব্যাপক প্রশংসিত হয়। এরপর শুধু এগিয়ে যাওয়া। সংসারে আর্থিক কষ্ট থাকলেও সুর ও সংগীতকে সাথী করে তার পথ চলা শুরু হয়। ২০০০ সালে যোগ দেন কীর্তনের দলে। চট্টগ্রাম, সিলেট, ভোলা, চাঁদপুর, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কীর্তন পরিবেশন করেন তিনি।
প্রায় ২১ বছর ধরে গান করছেন। সম্প্রতি ‘ডাক আসিলে যেতে হবে’ শিরোনামে সুমন পালের কণ্ঠে একটি গান ভাইরাল হয়। সেই গান শুনে টেলিভিশনের নির্ধারিত শিল্পী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রস্তাব পান তিনি। বর্তমানে তিনি বিটিভির শিল্পী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত।
পানছড়ির গীতিকার বাবুল কায়সার বলেন, সুমন পালের মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস, গানের প্রতি ভালো লাগা রয়েছে, সেই আত্মবিশ্বাস থেকে তার প্রতিভা বিকশিত হচ্ছে। সুমনের এই পথ চলায় তার পরিবারের সহযোগিতা রয়েছে। অভাবের মধ্যেও তিনি সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তিনি অনেক দূর এগিয়ে যাবেন। তার একাধিক গান অত্যন্ত জনপ্রিয়।
সুমনের পিতা নরেদ্র পাল বলেন, ছোট থেকেই সুমন চোখে দেখে না। ছোট থেকেই সে সংগীত চর্চা শুরু করে। ছোটবেলায় তাকে হারমোনিয়াম ও তবলা কিনে দেয়া হয়। এখন সংগীতই তার সাধনা। কীর্তন ও গানেই সংসার চলে।
সুমনের ভাই রুমন পাল বলেন, দাদাকে ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন কালচারাল প্রোগ্রাম গান গাইতে নিয়ে যেত। পরে গানই তার বাঁচার অবলম্বন হয়ে ওঠে।
সুমন পাল বলেন, ছোটবেলা কেটেছে সংগীতচর্চায়। অন্ধ হওয়ায় খেলাধুলা করতে পারতাম না। সংগীত গুরু বরিশালের নিরঞ্জন দেবনাথ আমাকে ক্লাসিক্যাল গানের চর্চা করিয়েছেন। গান না থাকলে আমি পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে পারতাম কিনা জানি না। গানই এখন আমার বন্ধু। তিনি জানান, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গেয়ে তার সংসার চলে। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের শিল্পী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রতিবন্ধী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, সুমন পাল দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধী হিসেবে মাসিক ভাতা পান। তিনি একজন প্রতিভাবান সংগীতশিল্পী। সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রে তার দখল বিস্ময়কর। তার প্রতিভা বিকাশে সরকার ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত।