চট্টগ্রাম মা-শিশু হাসপাতালের কাযনির্বাহী কমিটির সদস্য, নগর পরিকল্পনাবিদ ও সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ইঞ্জিনিয়ার আলী আশরাফ ৭ই মার্চ রাত ২ টায় ঢাকার এভার কেয়ার হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। তবে তাঁর শারীরিক অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে, তাকে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল। পরে লাইফ সাপোর্ট থেকে ওনাকে কেবলমাত্র অক্সিজেন থেরাপি দেয়া হচ্ছিল। আমরা আশাবাদী ছিলাম যে, হয়তোবা মহান রাব্বুল আলামিন ইঞ্জিনিয়ার আলী আশরাফ ভাইকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিবেন। কিন্তু সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তিনি চলে গেলেন। কিছুদিন আগে স্ত্রীসহ করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি প্রথমে চট্টগ্রাম মা-শিশু হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি ছিলেন। তখন আমাদের আই.সি.ইউ ইউনিটের অধ্যাপক ডা: অলক নন্দী তাঁর একটা হাস্যউজ্জ্বল ছবি পাঠিয়ে নিচে লিখেছিলেন “ভালো আছেন”। পরবর্তীতে তার শ্বাস কষ্ট হয় এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এভার কেয়ার হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ইঞ্জিনিয়ার আলী আশরাফ চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের একজন করোনা যোদ্ধা। করোনা রোগের মহামারীর প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে একটি করোনা ইউনিট খোলার লক্ষ্যে তিনি চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট এস এম মোর্শেদ হোসেন ও ট্রেজারার রেজাউল করিম আজাদসহ অন্যান্যদের নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে থাকেন। তখন মহামারীর ব্যাপকতার কারণে সবকিছু বন্ধ ছিল, এর মধ্যেই হাসপাতালের অর্থায়নে এবং অন্যান্য দাতা ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ যোগার করে কিছুদিনের মধ্যেই একটি করোনা ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং তাতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যেমন হাইফ্লো নেজাল ক্যানোলা যোগ করা হয়। তিনিই প্রথম চট্টগ্রাম মা-শিশু ও জেনারেল হাসপাতালে বেসরকারি পর্যায়ে করোনা ভাইরাস নির্ণয়ের জন্য আর.টি.পি.সি.আর মেশিন কেনার উদ্যোগ নেন এবং পরবর্তীতে নুরউদ্দিন সাহেবের আর্থিক সাহায্যে এই হাসপাতালে একটি অত্যাধুনিক করোনা ভাইরাস নির্ণয়ে একটি ল্যাবরেটরী প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনি করোনাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের জন্য আর্থিক বা যন্ত্রপাতি অনুদানের জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এমনকি হাসপাতালের প্রতিটি মিটিং এ গঠনমূলক পরামর্শ দিতেন। ফলশ্রুতিতে হাসপাতালে একটি সুন্দর করোনা ইউনিট ও করোনা রোগ নির্ণয়ে ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইঞ্জিনিয়ার আলী আশরাফ ভাই এর সাথে আমার পরিচয় শৈশবকাল থেকে। আমি যখন আন্দরকিল্লাস্থ মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি স্কুলের ১ম শ্রেণীর ছাত্র। তখন তিনি নবম/দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। তিনি আমার মেঝভাই আবু কামাল চৌধুরীর ক্লাস মেট ছিলেন। আমার মরহুম পিতা বাদশাহ মিয়া চৌধুরী ও আলী আশরাফ ভাই এর মরহুম পিতা এডভোকেট নুরুল হুদা সাহেব মুসলিম এডুকেশন সোসাইটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। দু’জনই সোসাইটির সাধারণ সম্পাদকের পদ অলংকৃত করেছিলেন। এরপর অনেক বছর তাঁর সাথে যোগাযোগ ছিল না। ২০০২ সালে যখন রোটারী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হলাম। উনিও রোটারী করতেন। তিনি অবশ্য রোটারী ক্লাব অব ইসলামাবাদ এর সদস্য ছিলেন আর আমি রোটারী ক্লাব অব চিটাগাং এর সদস্য ছিলাম। রোটারী ক্লাব এর বিভিন্ন কনফারেন্সে তিনি নগর উন্নয়নের অনেক তথ্য ও গবেষণামূলক বক্তব্য দিতেন। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে তিনি পরামর্শ দিতেন। নগর উন্নয়নে তাঁর অনেক বইও প্রকাশিত হয়েছে। তিনি আবার চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউট এর চেয়ারম্যানও ছিলেন। আলী আশরাফ ভাই ছিলেন একজন সু-বক্তা। তাই তিনি যখন কোন বিষয় নিয়ে বক্তব্য রাখতেন তখন অনেক লোকের সমাগম হত। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের নতুন প্রজেক্টের ব্যাপারে তাঁর অবদান স্মরণীয়। হাসপাতালের নতুন বিল্ডিং তৈরি, ক্যান্সার ইনস্টিটিউটসহ অন্যান্য সকল প্রজেক্টের তিনিই ছিলেন অনারারি প্রজেক্ট ডাইরেক্টর। হাসপাতালের প্রতিটি প্রজেক্ট এর কাগজ পত্র তিনি সুক্ষভাবে দেখতেন এবং মতামত দিতেন। তার এই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় হাসপাতালের সমস্ত প্রজেক্ট প্রায়ই শেষের দিকে। অচিরেই চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল হয়ে উঠবে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের একটি আদর্শ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধের শেষের দিকে ১৫ই এপ্রিল ১৮৬৫ ইং সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন আততায়ীর হাতে নিহত হবার পরে কবি Walt Whitman তার O Captain! My Captain! কবিতার এক পর্যায়ে লিখেছিলেন- Rise up- for you the flag is flung. ঠিক এমনিভাবে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের সমস্ত প্রজেক্ট এক সময়ে বাস্তবে রূপান্তরিত হবে। লোকে লোকারণ্য হবে, কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার আলী আশরাফ ভাই আর আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। হয়তো বা না ফেরার দেশে তিনি মা ও শিশু হাসপাতালের বিজয় ঝান্ডা নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন। মহান আল্লাহ আশরাফ ভাইকে বেহেস্ত নছিব করুন।
লেখক : পরিচালক, অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র,
চট্টগ্রাম মা শিশু ও জেনারেল হাসপতাল