বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম)। পরিচিতি পর্ব। উনি উঠে দাঁড়ালেন। চিত্ত পদভরে। হাস্যোজ্জ্বল। হাতটা উপরে উঠিয়ে ধরলেন। ডান হাত। মুষ্টি শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ হাতটা বুকের বা দিকে হৃদপিন্ডের উপরে শশব্দে স্থাপন করলেন। মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে বলে গেলেন বিরতিহীন। আমি শামসুন্নাহার রহমান পরান। আমি অনেকের পরানে পরান বেঁধেছি। অনেকে আমার পরানে পরান বেঁধেছে। আর তাইতো আমি সবার কাছে পরিচিত হয়েছি পরান আপা নামে। আমি ঘাসফুলের নির্বাহী পরিচালক। চট্টগ্রামে কাজ করি। এই প্রথম দিন পরান আপাকে আমার দেখা।
মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার কথা মনে পড়ে। আমার জন্মের কতো আগে কত কত জ্ঞানী, সাহসী, বিদূষী নারী বাংলাদেশের ভূ-খন্ডে জন্ম নিয়েছে। গর্বিত ও দৃঢ় পদভরে তাদের আদর্শ ও নীতি নিয়ে কর্মজজ্ঞ চালিয়েছে। আর তাই তাদের বোনা বীজ বপনের মাঠে আমরা সরিষার শস্যদানা হয়ে হলুদে সবুজে মাঠ ভরে রাখতে সাহস করি। আপসহীন আমার পথচলাও শুরু হয় বছর কয়েক আগে। সেই সময়ের বেসরকারী সংস্থাগুলো নিয়ে আমারও অনেক জিজ্ঞাসা ছিল। ছিল প্রশ্নবোধক চিহ্ন! আর তাই মাইক্রোক্রেডিট নিয়ে কিংবা ফ্যামিলি প্লানিং-এর প্রচার অভিযান ও কনডম বিতরণ আমাকে তাড়িত করেনি। আমার কাছে দুইটি বিষয় জরুরী মনে হয়েছিল। শ্রেণী বৈষম্য ও নারী পুরুষের বৈষম্য, ঐক্য, শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি। আমাদের শৈশবকে এইসব দীক্ষা বন্দি খাঁচার মধ্যে আঁখড়ে ধরে রেখেছিল। প্যালেস্টাইন, ভিয়েতনাম সব জনতার সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ করার দুর্বার অঙ্গীকার ও শপথ তাড়িয়ে বেড়াত অহর্নিশি। শৈশব, কৈশর, যৌবন- এর দোগোড়ায় অনেক অনেক দর্শন তাড়িত মানবাধিকার মহৎ প্রাণ কর্মীদের অনুসঙ্গ পেলে এক এক করে হৃদয়ে অলিঙ্গ নিলয়-এর দ্বার উন্মোচন হলো। ক্রমে ক্রমে শাণিত হলো মনন ও মেধা। আরো। আরো। যাদের পদাঙ্কন চিহ্নিত করলাম। যাদের পদাঙ্কন অনুসরণযোগ্য তাদের একজন আমাদের প্রিয় পরান আপা।
শিশু অধিকার ফোরামের এজিএম-এ সেদিন টিডিএই-সুইজারল্যান্ডকে প্রতিনিধিত্ব করছিলাম। চেয়ারম্যান আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় ডঃ আহমেদ উল্লাহ মিয়া। আর সমন্বয়কারী ছিলেন মারইয়াম। চেয়ারম্যানকে পরবর্তীতে এবং এখনও মিয়াভাই বলেই আমি সম্বোধন করি। এজিএম শেষে পরান আপা আমাকে আবিষ্কার করলেন। আমার নাম, পরিচয়, সংস্থার নাম। আমিও ছোট্ট স্কুল ছাত্রীর মতো অবলীলায় উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম। পরান আপা বললেন ‘‘বিএসএএফ-এর কনস্টিটিউশনের নিয়ে তুমি যে ইস্যুটা উত্থাপন করেছ আমি তোমার জ্ঞান ও মেধার প্রশংসা করি। আমিও তোমার সাথে এক মত’’। দেখি ফ্লোর কি বলে। এবারে যদি এই ফ্লোজটির পরিবর্তন না আনে পরবর্তীতে আমরা সুসংগঠিত হবো এবং এর পরিবর্তন আনবো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওয়াহিদা তুমি পরবর্তী এজিএম-এ এই ইস্যুটার উপর গুরুত্ব দেবে। ফ্লোরে ছুঁড়ে দেবে। যাতে সবাই বিষয়টি নিয়ে জানে কথা বলে। আর ক্লোজটাতে পরিবর্তন আনে। আমি বললাম ‘‘পরান আপা! আপনারা অনেক অভিজ্ঞ। আমাদের মুরুব্বী। আপনাদের উপস্থিতিতে আমরা যারা অর্ধেক উন্নয়ন কর্মী সবেমাত্র হয়েছি তারা কি এসব উত্থাপন করতে পারবো! পরান আপা বললেন ‘‘ করবে- এবং তুমি পারবে! কারণ আমরা দীর্ঘদিন এই ফিল্ডে কাজ করি। কথা শুনে বা প্রশ্ন করা শুনেই বুঝে ফেলি কারা কি বলতে চাচ্ছে।’’ উনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে পরবর্তী এজিএম-এ আমি বিএসএএফ-এর কনস্টিটিউশনের যে ক্লোজটির উপর মন্তব্য করেছি সেটি বিএসএএফ-এর জাতীয় অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্যই। এরই মধ্য দিয়ে কোথায় যেন এক অদৃশ্য দাবির সম্পর্ক আমাদের মাঝে তৈরী হলো।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও যা সত্যি তা হলো পরবর্তী এজিএম-এ আমি উপস্থিত হতে পারি নি। তখন আর টিডিএইচ-এ কাজ করি না। আমরা তখন কেবল ‘‘অপরাজেয়-বাংলাদেশ’’ নামের জাতীয় বেসরকারী সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছি মাত্র। আমাদের একজন পুরুষ সহকর্মী সেবারের এজিএম-এ প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি একটু রগচটা স্বভাবের মানুষ ছিলেন। পরবর্তীতে আমার সেই পুরুষ সহকর্মী আমাকে তার এজিএম-এর অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা বিনিময় করছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল পরান আপা আমাকে সত্যিকার অর্থেই খুঁজছিলেন। আর আমার অনুপস্থিতিটাকে উনি যেন মেনে নিতে পারছিলেন না। পরান আপা মন্তব্য করেছিলেন ঃ ওয়াহিদার এই এজিএম-এ আসার কথা ছিল। আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু উত্থাপন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম না। আমার কিন্তুওয়াহিদার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে।’’
আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে অনাবিল একটা আনন্দ সমস্ত শরীরময় বয়ে গেল। আমার মুখাবয়ব বোধ করি আরো উজ্জ্বল থেকে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আমার সেই পুরুষ সহকর্মী আমাকে জানালেন ‘‘আপা আপনি হাসছেন? আমি কিন্তু পরান আপার কথায় খুবই ছোট আর অপমানিত বোধ করেছি। সত্যি বলছি’’।
আমি হেসেই আকুল। পরে ওনাকে বুঝিয়ে বললাম রাগ করার মতোন কি কথা হলো যে আপনি পরান আপার কথায় এতোটাই ক্ষুব্ধ হয়েছেন? উনিতো আমাদের মুরুব্বী। মায়ের সমান। উনি যাই বলবেন তার কোন সৎ উদ্দেশ্য থাকবে। ওনারা এতোদিন এই উন্নয়ন জগতে মাঠে ঘাস ফলাতে আসেননি। তাদের কাছেই আমাদের অনেক অনেক শিখতে হবে!
তার বেশ পরের কথা। আমি পর পর দুই টার্মে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হই (২০০৬-২০১১) এবং এসটিআই এইডস নেটওয়ার্ক অব বাংলাদেশের (২০০৫-২০১১)। যেদিন নির্বাচিত হয়েছি তার পরদিনই পরান আপার ফোন পেয়েছি অকৃপণভাবে। মনে হয়েছিল পরান আপারা আমাদের শিক্ষক। আমরা ছাত্র/ছাত্রী সমতুল্য। ইতিমধ্যে ২০০৬ সালে জাফরী ভাইয়ের সাথে সহযোদ্ধা/ সহকর্মীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। কী অপূর্ব সম্মিলন। তার সুযোগ্য পুত্র/ সন্তানদের সহচার্য পেয়ে আমি আবারও পরান আপার প্রতি বিনম্র ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় সিক্ত হই।
২০০৮ সালের আগস্ট কী সেপ্টেম্বর মাসের এক সন্ধ্যায় পরান আপার চট্টগ্রামের বাড়ীতে দাওয়াত পেলাম। চট্টগ্রামে তখন জাকীর হোসেন রোডে অপরাজেয়-বাংলাদেশের অফিস কাম গেস্ট হাউস ছিল। অফিসের কাজে গেলে সেখানে রাত্রি যাপন হতো। সন্ধায় বাড়ীতে গেলাম। পরান আপার সেই খুশীভরা মুখাবয়ব -এর বর্ণনা আমি দীর্ঘ দীর্ঘ বাক্যে করতে পারবো। কিন্তু আমার দু’চোখ ভরে আমি যতোটুকু আদর-ভালোবাসা তার কাছে পেয়েছি তা বোধ করি কাউকেই অনুভব করাতে পারবোনা। যা আমার দুই দৃষ্টির মধ্যে মনের গহীনে গচ্ছিত সম্পদ।
অনেকগুলো বছর পেরোলাম। দেখা না হলেও জানা ছিলো পরান আপার খবর। কেমন আছেন কোথায় আছেন। যখন তার পূর্ণাঙ্গ জীবন- এর সমাপ্তি টেনে দিলেন মহান সৃষ্টিকর্তা, সেই সময়ে পরান আপাকে দেখতে যাবার সুযোগ হয়নি তবে ইচ্ছার ঘাটতি ছিল না মোটেও।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, অপরাজেয়-বাংলাদেশ