ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড মসজিদ্দায় অবৈধ লুব অয়েল কারখানা থেকে প্রতিনিয়ত নির্গত কালো ধোঁয়া একদিকে যেমন পরিবেশকে বিপর্যস্ত করছে তেমনি অন্যদিকে ঝুঁকিতে ফেলছে ‘গ্রিন প্লান্ট’ হিসেবে পরিচিত জিপিএইচ ইস্পাতের অক্সিজেন প্লান্টকে। অভিযোগ রয়েছে, অদৃশ্য কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারি দপ্তরগুলোর যথাযথ নজরদারির অভাবে লুব অয়েল কারখানাটি বছরের পর বছর পরিবেশ দূষণ করে চলছে। ইতোমধ্যে অননুমোদিত প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশ দূষণের বিষয়ে সরকারি দপ্তরগুলোতে বেশ কয়েকটি অভিযোগ জমা পড়েছে।
জানা যায়, মসজিদ্দা এলাকায় জিপিএইচ ইস্পাতের অঙিজেন প্লান্টের সাথে লাগোয়া স্টান্ডার্ড লুব অয়েল কারখানাটি কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। রোববার দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, কারখানাটির চিমনি দিয়ে কালো ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। কারখানা থেকে নির্গত স্লাজ (জ্বালানি বর্জ্য) খোলাভাবে বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে। পাশাপাশি কারখানাটির কোনো সাইনবোর্ডও দেখা যায়নি।
এদিকে কারখানাটির কালো ধোঁয়া বন্ধের বিষয়ে জিপিএইচ ইস্পাতের পক্ষ থেকে সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, স্থানীয় সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে জিপিএইচ অঙিজেন প্লান্টের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার মো. নাজমুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘জিপিএইচ ইস্পাতের অঙিজেন প্লান্ট থেকে চলমান করোনা প্রাদুর্ভাবে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে অঙিজেন সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে দৈনিক ৩শ মেট্রিক টন অঙিজেন উৎপাদিত হয় প্লান্টটিতে। এই প্লান্টের মূল উপাদান হচ্ছে বাতাস। কিন্তু পাশের স্টান্ডার্ড লুব অয়েল কারখানা থেকে কালো ধোঁয়া পুরো আকাশ ছেয়ে যায়। এ ধোঁয়ার সাথে নির্গত কার্বনের কারণে আমাদের অক্সিজেন প্লান্টের ‘অয়েল ভেপার কোল্ড বক্সের রি-বয়লার কন্ডেসারে’ জমা হয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ছে। এতে স্থানীয় সাধারণ মানুষও এ ঝুঁকির বাইরে নেই।’
অন্যদিকে নিয়মমাফিক লুব রি-রিফাইনিং প্লান্ট করার পূর্বে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) সাথে চুক্তি করতে হয়। প্লান্টে উৎপাদিত প্রোডাক্টও হতে হয় আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক কিংবা বিপিসির কোনো অনুমোদন নেই বলেও অভিযোগ রয়েছে।
২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে গেজেট আকারে প্রকাশ হওয়া ‘ব্যবহৃত লুব্রিকেটিং অয়েল রি-রিফাইনিং প্লান্ট স্থাপন নীতিমালা, ২০১৯’ এর ৫.৮ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘প্লান্ট স্থাপনের পূর্বে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক অবস্থাগত ছাড়পত্র, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত অগ্নি-নির্বাপন প্ল্যান এবং স্থাপনাসমূহের বিস্ফোরক পরিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত নকশা (লে-আউট প্ল্যান), জেলা প্রশাসন, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সরকারের বিধিবদ্ধ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অথবা বিভাগ অথবা অধিদপ্তর হতে প্রয়োজনীয় অনুমোদন অথবা অনুমতি অথবা ছাড়পত্র অথবা অনাপত্তিপত্র থাকতে হবে।’ ৫.১৬ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ব্যবহৃত লুব্রিকেটিং অয়েল রি-রিফাইনিং প্লান্টের একই অঙ্গনে বেল্ডিং প্লান্ট স্থাপন কিংবা পরিচালনা করা যাবে না।’
এ বিষয়ে বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মোরশেদ হোসাইন আজাদ সোমবার দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ওই নামে (স্টান্ডার্ড লুব অয়েল) কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে বিপিসির কোনো চুক্তি নেই। বিপিসির সাথে চুক্তি ছাড়া লুব ব্লেন্ডিং কিংবা লুব রি-রিফাইনিং প্লান্ট স্থাপনের সুযোগ নেই। বিপিসির অনুমোদন ব্যতীত এ ধরনের প্লান্ট পরিচালনা সম্পূর্ণ অবৈধ।’
জানতে চাইলে স্টান্ডার্ড লুব অয়েল লিমিটেড নামে ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আখতারুজ্জামান সোমবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘২০১৬ সালে প্লান্টটি শুরু করার সময় পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের সাথে চুক্তির জন্য একটি আবেদন দিয়েছিলাম, চুক্তির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’ চুক্তি ব্যতিরেখে প্লান্ট পরিচালনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। তবে তাদের উৎপাদিত পণ্য (বেজ অয়েল) ট্রাক্টর, কারখানা, ছাপাখানা, নৌকা-স্টিমারে ব্যবহারের জন্য সরবরাহ দেওয়া হয় বলে জানান তিনি। পাশাপাশি তাদের পরিবেশগত ছাড়পত্র রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে স্টান্ডার্ড লুব অয়েল কোম্পানি নামের ওই প্রতিষ্ঠানটিতে কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ বিপর্যস্ত করার অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক জমির উদ্দিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘স্টান্ডার্ট লুব অয়েল লিমিটেড নামের কারখানাটির বিরুদ্ধে জিপিএইচের অভিযোগ ছিল। আমরা উভয়কে শুনানিতে ডেকেছিলাম। ওইসময়ে লুব কারখানাটিতে এটিপি সংযোজনের জন্য জিপিএইচ থেকে আর্থিকভাবে সহযোগিতাও করেছিল। যেকারণে ওই কারখানায় ইটিপি বসানোর জন্য আমরা সময় দিয়েছিলাম, তারা ইটিপি না বসালে আবার অ্যাকশন নেওয়া হবে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক (আঞ্চলিক কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত) মো. নূরুল্লাহ নূরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের অভিযোগ উঠা লুব কারখানার বিষয়ে জেলা কার্যালয় থেকে প্রতিবেদন চাওয়া হবে। এরপর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একবার জরিমানা হলে পরবর্তীতে একই ধরনের কার্যক্রমের জন্য দ্বিগুণ জরিমানার করা হবে। কোনো অবস্থাতেই কালো ধোঁয়া নির্গমন হতে পারবে না। তাছাড়া কারখানাটি যদি অননুমোদিত হয়ে থাকে, তাহলে সেটি বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন রায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘স্ট্যান্ডার্ড লুব অয়েল লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটিকে আমরা ডাকব। তাদের যথাযথ কাগজপত্র আছে কিনা, যাচাই করব। পরিবেশ দূষণের অভিযোগ থাকলে সে বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’












