আগে রাস্তা ছিল। এখন অল্প করে মাটি ফেলে চলে গেছে। সরকার বাঁধ বাঁধছে। এজন্য আমরা কিছু বলিনি। বাঁধ কেন বাঁধছে? আগে যখন বাঁধ ছিল না, তখন ভালো ছিল। এখন মানুষ হাঁটতে পারছে না। রোগী নিয়ে বিপদে পড়তে হবে। একটি রিকশা কিংবা সিএনজি টেক্সিও চলাচল করতে পারছে না। কথাগুলো বলছিলেন আনোয়ারা উপজেলার শঙ্খ নদীপাড়ের জুঁইদণ্ডী গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব মহিলা ফেরদৌসের মা। পাশের বাড়ির গৃহিণী দিলোয়ারা আক্তার বলেন, এটি ছাগল হাঁটার মতো বাঁধও হয়নি। ঠিকাদার এসে বলেছিল আমাদের ঘরের কাছাকাছি পর্যন্ত বাঁধ হবে। দশ-পনের দিন আগে অল্প মাটি ফেলে চলে গেছে। বর্ষাকালে ঝড় বেশি হলে পানিতে তলিয়ে যাবে। স্থানীয় মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, এখানে যা মাটি ফেলেছে, তাতে উপরের প্রস্থ সাড়ে তিন ফুটের মতো হবে। অথচ এখানে ব্লকের উপর ৬৪ ফুটের প্রস্থের বাঁধ হওয়ার কথা। বাঁধ করার জন্য আমার লক্ষ টাকার গাছ কেটে ফেলেছে। এখন মাটি না পাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে তারা চলে গেছে। মানিচ্ছ্যার বাড়ি থেকে আবদুল বারী চৌধুরী বাজার পর্যন্ত ব্লকের কাজ হয়েছে। এখানকার সরকারি দলের মোজাম্মেল কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজটি করেছে।
নুরুল হক নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, বর্ষায় মূল সড়কে এক থেকে দেড় হাত পানি ওঠে। এখন যে বাঁধটি করা হয়েছে বর্ষায় জোয়ার আসার সাথে সাথে সেটি পানির সাথে মিশে যাবে।
সূত্রে জানা গেছে, শক্সখ নদীর জুঁইদণ্ডী অংশে প্রায় ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য ২০১৭ সালের মার্চে ঢাকার ইসরাত কন্সট্রাকশনকে কার্যাদেশ দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম ডিভিশন-১। প্রকল্পটিতে প্রায় এক বছর আগে ব্লকের কাজ শেষ হয়েছে। এখন ব্লকের উপর মাটি দিয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রকল্পের মূল ঠিকাদার থেকে মাটির কাজের জন্য উপ-ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছেন জুঁইদণ্ডী এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ মোজাম্মেল।
প্রকল্পের ডিজাইন ও কার্যাদেশ অনুযায়ী নির্মিতব্য বাঁধের ব্লক বসানোর পর উপরে মাটির বাঁধের কাজ হবে। ব্লকের উপরের অংশে মাটির কাজের ক্ষেত্রে আকৃতি তলানির প্রস্থ ৬৪ ফুট, উপরের প্রস্থ ১৪ ফুট। উপর থেকে নিচে স্লোব (বাঁধের বাইরের দিকে) ৩৩ ফুট, ভেতরের দিকে ২২ ফুট। উচ্চতা ধরা হয়েছে ১১ ফুট। কাজের ক্ষেত্রে প্রতি ১-১.৫ ফুট মাটি ফেলার পর যন্ত্রের মাধ্যমে চাপা দিয়ে লেভেল করার কথা ছিল। কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেছে, মাটির কাজের ক্ষেত্রে সাকুল্যে উচ্চতা ৩-৩.৫ ফুট, তলানির প্রস্থ ৬-৭ ফুট। উপরের অংশে প্রস্থ ৩-৩.৫ ফুট করে মাটি ফেলা হয়েছে। ব্লকের উপর ফেলা মাটি চাপা দেয়া হয়নি।
কাজের উপ-ঠিকাদার মোহাম্মদ মোজাম্মেল আজাদীকে বলেন, আমি কাজের ঠিকাদার নই। আমি ডাম্পার দিয়ে মাটি ফেলি। যতটুকু মাটি দেব ঠিকাদার থেকে ততটুকু বিল পাব। ঠিকাদার এসব মাটি কী করছে না করছে সে বিষয়ে বলতে পারব না।
প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইসরাত কন্সট্রাকশনের প্রতিনিধি উজ্জ্বল বলেন, জুঁইদণ্ডীতে আমাদের একটি কাজ চলছে। তবে কোন অবস্থায় আছে জানি না। জেনে বলতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা মনে করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পে অল্প কাজ করে পুরো বিলের টাকা তুলে নেওয়া যায়। যে কারণে শক্সখ নদীর বেড়িবাঁধের কাজ করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। উপজেলাগুলোতে ১৫-২০ জন নেতা ও জনপ্রতিনিধি মিলে সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। ইজিপির মাধ্যমে চট্টগ্রামের বাইরের ঠিকাদার কাজ পাওয়ার পর তাদের চাপে ফেলে কাজ নিয়ে নিচ্ছেন। মূল ঠিকাদারও ঝামেলা এড়াতে স্থানীয়দের কাজ দিচ্ছেন। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে স্থানীয় সাব-কন্ট্রাক্টররা যখন বুঝতে পারছেন কাজ না করে বিল নেওয়ার সুযোগ নেই, তখন তারা কাজ ফেলে রাখছেন। যে কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পগুলো সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। দুই বছরের কাজ চার বছরেও শেষ হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (ডিভিশন-১) তয়ন কুমার ত্রিপুরা আজাদীকে বলেন, কার্যাদেশ এবং ডিজাইন অনুযায়ী কাজ সমাপ্ত না করে বিল উত্তোলনের সুযোগ নেই। কারণ ঠিকাদার কাজ করে রিপোর্ট দেওয়ার পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের টাস্কফোর্স টিমের পরিদর্শন প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা হয়। তিনি বলেন, শক্সখ নদীর জুঁইদণ্ডীতে এখন যে মাটির কাজ চলছে, সেটি চলমান। কোনো অবস্থাতেই কাজ না করে বিল নেওয়ার সুযোগ নেই।