দৃশ্যপট ১ঃ পাঁচ বছরের শিশু ফাহিমা হাঁটুতে ক্যান্সারের কারণে হাঁটতে পারে না। রিকশাচালক বাবার কোলে চড়ে এসেছে ক্যান্সার বিভাগের বারান্দায়। অবুঝ শিশুর চোখে নেই কোন আলো,হতদরিদ্র পিতার সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
দৃশ্যপট ২ঃ জনাব সালাম বয়স ৭০, অবসর প্রাপ্ত স্কুলে শিক্ষক। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মরণঘাতী ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত। বেসরকারি চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ার এই স্কুল শিক্ষক সরকারি সাহায্যের প্রত্যাশায় ক্যান্সার হাসপাতালের বারান্দার ক্রমবর্ধমান ভীড়ে শামিল হয়েছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারে পুঁজি শেষ পর্যায়ে।
দৃশ্যপট ৩ঃ নাসিমা ২৫ বছরের গার্মেন্টস কর্মী, স্তন ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে সারা শরীরে , এই অসহায় রোগীর একমাত্র আশ্রয়স্থল নামমাত্র মূল্যে সরকারি চিকিৎসা, যা তার জীবন প্রদীপ এখনো জ্বালিয়ে রেখেছে।
দৃশ্যপট ৪ঃ নিকুঞ্জ মাঝি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধো, দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর এখন আরেক যুদ্ধের সম্মুখীন এই মুক্তিযোদ্ধো, ভুগছেন ফুসফুস ক্যান্সারে, এসেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেলের দোরগোড়ায়, পেয়েছেন বিনামূল্যে ক্যান্সারের সকল পরীক্ষা এবং ক্যান্সারের চিকিৎসা। তাছাড়াও পাচ্ছেন সরকারের কাছ থেকে চিকিৎসার জন্য আর্থিক অনুদান।
এই ছবিগুলো সমগ্র দৃশ্যপটের এক খন্ডাংশ মাত্র। হু- হু করে বেড়েই চলেছে ক্যান্সার। যেটা মনে করা হত, ক্যান্সার শুধুমাত্র উচ্চবিত্তের হয়, কিন্তুু বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের ক্যান্সার প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এইসব পরিবারের পক্ষে ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করা অসম্ভব। এইসব পরিবারের একমাত্র আশ্রয়স্থল সরকারি হাসপাতালের কার্যকরী চিকিৎসা ব্যবস্থা। যা সরকারের নামমাত্র দিয়ে থাকে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা একের পর এক নতুন মাইল ফলক অর্জন করে চলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উৎসাহে সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশের ক্যান্সার চিকিৎসা বহুমাত্রিক রূপ লাভ করতে চলেছে। ৮টি বিভাগীয় শহরে সমন্বিত ক্যান্সার হাসপাতাল গুলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্যান্সার চিকিৎসায় আপন ভরসাস্থল হিসাবে পরিগণিত হবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এদেশের প্রতি বছর ২.৫ লাখ থেকে ৩ লাখ মানুষ নতুন করে ক্যান্সার আক্রান্ত হচ্ছেন। ২০৩৫ সালে এটি দ্বিগুণ হয়ে যাবে। ধারণা করা হচ্ছে ২০৩০ সালে বাংলাদেশের মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ হবে ক্যান্সার।
আমাদের সম্পদ ও শিক্ষিত জনবল সীমিত। এই সম্পদ ও জনবলের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতাল সর্বাঙ্গীনভাবে কার্যকর করা দীর্ঘমেয়াদী সময়ের ব্যাপার। প্রতিষ্ঠিত ও চলমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার কাছাকাছি থেকে নতুন পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতালগুলো নির্মিত হলে এগুলোর পক্ষে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সেবা নিশ্চিত করা সহজতর হবে এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উৎকর্ষ সাধন সম্ভব হবে। মনে রাখতে হবে বর্তমানে বিশ্বে ক্যান্সার চিকিৎসা একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনার অধীনে পরিচালিত হয়। অনেক বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ, বহুমাত্রিক জনবল ও উন্নত যন্ত্রপাতি আধুনিক ক্যান্সার চিকিৎসার পূর্বশর্ত। সেই নিরিখে প্রস্তাবিত ক্যান্সার হাসপাতালগুলো নির্মাণ ও পরিচারিত হলে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
টেকনাফ থেকে ব্রাক্ষণবাড়িয়া পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগের মোট ১১টি জেলার প্রায় ৪ কোটি অধিবাসীর জন্য সরকারিভাবে ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। যদিও শয্যা সংখ্যা খুবই কম। সঠিক ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ রেডিওথেরাপি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুযায়ী প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি করে রেডিওথেরাপি মেশিনের প্রয়োজন হলেও পুরো চট্টগ্রাম বিভাগের প্রায় ৪ কোটি লোকের জন্য একটি মাত্র রেডিওথেরাপি মিশিন রয়েছে। দেশের এক চতুর্থাংশ মানুষের জন্য এই বিভাগের শয্যা সংখ্যা অপ্রতুল। এই স্বল্প পরিসরে নতুন কোন মেশিন বসানোর মত কোন স্থানও নেই এই বিভাগে। এতসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নবীন ও প্রবীণ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ক্যাম্পাস এ একটি স্বতন্ত্র ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হলে সরকারের আন্তরিকতায় ক্যান্সার চিকিৎসার সর্বাধুনিক মেশিন বসানো সম্ভব হবে। একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল ক্যান্সার রোগ গবেষণার একটি কেন্দ্র হয়ে উঠবে ও নবীন শিক্ষার্থীরা ক্যান্সার রোগ গবেষণার উৎসাহিত করবে। মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রচ এর কথা চিন্তা করলে ক্যান্সার বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত ভবনটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ক্যাম্পাসের বিকল্প নেই। কারণ ক্যান্সার পেশেন্টদের কেমোথেরাপি চলাকালীন বা কেমোথেরাপি পরবর্তী নানান রকম সমস্যা দেখা দেয়, এই সমস্যা সমাধানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজেই রয়েছে কার্ডিওলজি বিভাগ, যেখানে কেমোথেরাপি চলাকালীন বা পরবর্তী জটিলতার সমাধানের জন্য সকল সুযোগ বিদ্যামান, আছে গাইনি বিভাগ যেখানে যেসব মহিলাদের ক্যান্সারের পাশাপাশি গাইনি সমস্যা দেখা দেয় তাদের দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব, এছাড়াও রয়েছে সুপ্রতিষ্ঠিত সার্জারি বিভাগ যেখানে ক্যান্সার পেশেন্টদের সার্জারির ব্যবস্থা আছে যেটা খুবই সহজলভ্য। ব্রেইন টিউমার পেশেন্টের জন্য রয়েছে মেডিসিন, নিউরোসার্জারী, পিডিয়াট্রিক অনকোলজী বিভাগ। তাছাড়া চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিউক্লিয়ার মেডিসিন ডিপার্টমেন্ট আছে। যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একটি পেট সিটি মেশিনও আসছে যার ফলে রোগীদের সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব। রেডিয়েশন প্রটেকশনের কথা চিন্তা করলে রেডিয়েশন মনিটরিং এর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হল নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগ, যা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসেই অবস্থিত। উপরোক্ত সকল সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তা করলে বলা যায় প্রস্তাবিত ভবনটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ক্যাম্পাসের বিকল্প নেই।
উল্লেখ্য যে, মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতাল, ডেল্টা ক্যান্সার হাসপাতাল,ইউনাইটেড হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল ও আহসানিয়া ক্যান্সার হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগ সমূহ ঢাকা শহরের প্রাণ কেন্দ্রেই অবস্থিত।
বারো আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রাম একমাত্র ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এই অঞ্চলের কোটি মানুষের প্রয়োজন একটি আধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল। মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর ঐকান্তিক ইচ্ছায় সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপ লাভ করতে চলেছে। সর্বসাধারণের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে এই হাসপাতালের ক্যাম্পাসেই একটি সমন্বিত ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের সীমিত সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে একটি আধুনিক কার্যকরী অথচ জনসাধারণের সহজলভ্য ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার।
৪ঠা ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ক্যান্সার দিবসে আমাদের শপথ, সর্বাধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে পুরাপুরি সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক, রেডিওথেরাপি বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।