‘সম্পত্তি নয়, পিতৃ পরিচয় চাই’

আদালতের দ্বারস্থ ৪২ বছরের সালাউদ্দিন

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ৩১ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:২০ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিকে পিতা দাবি করে মোহাম্মদ ইসহাক নামের ২৬ বছর বয়সী এক যুবকের আদালতে মামলার পর দেশজুড়ে আলোচনার দেড় মাসের মাথায় মহানগরীতে একই ধরণের আরেক ঘটনা আলোচনায় এসেছে। নগরীর বায়েজীদ থানাধীন ৩নং পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের ওয়াজেদিয়া পশ্চিম শহীদ নগর এলাকার বাসিন্দা ৫ সন্তানের জনক ৪২ বছর বয়সী মো. সালাউদ্দিন পিতৃ পরিচয়ের দাবিতে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। সালাউদ্দিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘পিতার সম্পত্তি নয়, আমি পিতৃপরিচয় চাই। তাই আদালতে গিয়েছি।’
দৈনিক আজাদী অফিসে এসে সালাউদ্দিন বলেন, দেলোয়ার কোম্পানি আমার পিতা। আমার পিতার বাড়িতেই আমি বড় হয়েছি। রহমানিয়া
স্কুলে পড়েছি। ১৫-১৬ বছর বয়য়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি নানার বাড়ি চলে যাই। এরপর থেকে ঝামেলা শুরু করেছে। আমাকে কয়েকবার বাড়ি থেকে বের কয়ে দিয়েছে, আবার নিয়েছে। এখন আমাকে সন্তান হিসেবে স্বীকার করতে চাইছে না। এ যুবক বলেন, আমার পিতার দ্বিতীয় ঘরে ৬ মেয়ে এক ছেলে রয়েছে। আমার বোনদের বিয়ে হবে না চিন্তা করে পিতাকে কখনো বিরক্ত করিনি। এখন বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। পিতার কোন সম্পত্তি আমার দরকার নেই। আমি পিতৃপরিচয় চাই। সালাউদ্দিন বলেন, আমার পিতার শিপের ব্যবসা আছে, ব্রিকফিল্ড আছে, কক্সবাজারে হোটেল ব্যবসা আছে। কক্সবাজারের হোটেল সী পার্ক হোটেলটিও আমার পিতার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মো. সালাউদ্দিনের জাতীয় পরিচয়পত্র হিসেবে পাওয়া স্মার্ট কার্ডে পিতার নাম মো. দেলোয়ার কোম্পানি ও মাতার নাম মরজিনা বেগম উল্লেখ আছে। স্মার্ট কার্ড অনুযায়ী সালাউদ্দিনের জন্ম ১৯৭৯ সালের ৪ মার্চ তারিখে। তাছাড়া ২০০৫ সালের ২৮ জুলাই তারিখের তৎকালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শফিকুল ইসলামের দেওয়া জাতীয়তা সনদপত্রেও সালাউদ্দিনের পিতা হিসেবে দেলোয়ার হোসেন কোম্পানির নাম লেখা রয়েছে। একইভাবে সদ্য সাবেক কাউন্সিলর কফিল উদ্দিন খান স্বাক্ষরিত ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তারিখের জাতীয়তা সনদপত্রেও পিতা হিসেবে দেলোয়ার কোম্পানির নাম রয়েছে। ৩নং পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত কাউন্সিলর মো. শফিকুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘এটি অনেক আগের ঘটনা। সালাউদ্দিনের সব ধরণের সার্টিফিকেট রয়েছে। সালাউদ্দিন হচ্ছে দেলোয়ার কোম্পানির ছেলে, এটা সত্য। এখন শুনেছি এটা নিয়ে আদালতে মামলাও হয়েছে।’
এদিকে সালাউদ্দিনের অভিযোগের সত্যতা জানতে কথা হয় পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর কফিল উদ্দিন খানের সাথে। তিনি বলেন, ‘সালাউদ্দিন ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ পিতৃপরিচয় না দেওয়ার অভিযোগ এনে দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে একটি দরখাস্ত দিয়েছিল। আমি উভয় পক্ষকে নোটিশ দিয়ে ডেকেছিলাম। সালাউদ্দিন দেলোয়ার হোসেনের ঔরসজাত সন্তান বলে দাবি করলেও দেলোয়ার কোম্পানি তা অস্বীকার করছে। সেজন্য আদালতের আশ্রয় নিয়ে ডিএনএ টেস্ট করার পরামর্শ দিয়ে অভিযোগটি নিষ্পত্তি করেছিলাম।’ ওই ঘটনার পর সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আদালতে প্রতারণার মামলা করেন দেলোয়ার হোসেন। জালিয়াতির মাধ্যমে জাতীয় পরিচয় পত্র এবং ভোটার তালিকায় সালাউদ্দিনের পিতার নামের স্থলে তার (দেলোয়ার হোসেন) নাম বসিয়েছেন বলে মামলার আর্জিতে উল্লেখ করেন তিনি। কিন্তু মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এক আদেশে ‘এনআইডি ও ভোটার তালিকাটি জাল নয় এবং এতে প্রতারণার মাধ্যমে সম্পদ আত্মসাতের কোন অভিযোগ নেই’ মর্মে দেলোয়ার হোসেনের মামলাটি খারিজ করে দেন।
পরবর্তীতে পিতৃপরিচয়ের দাবিতে ঘোষনামূলক প্রতিকারের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হন মো. সালাউদ্দিন। সালাউদ্দিনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মধুসূধন দাশ দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমরা সালাউদ্দিনের পক্ষে আদালতে গিয়েছি। সালাউদ্দিন কাগজপত্রের মাধ্যমে দেলোয়ার হোসেনকে তার পিতা হিসেবে দাবি করেছেন। সেটার জন্য আইনগত ব্যবস্থার পাশাপাশি ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রাথমিকভাবে আদালতে বাদীর দাবি যদি বিবাদী অস্বীকার করেন, তাহলে আমরা ডিএনএ টেস্ট করে বিষয়টি সুরাহার জন্য আদালতে দরখাস্ত করবো।’
এ ব্যাপারে সালাউদ্দিনের মা দৈনিক আজাদীকে বলেন, দেলোয়ার কোম্পানি সম্পর্কে আমার খালাতো ভাই। আবার আমার ভাইয়ের জন্য দেলোয়ারের খালাতো বোন এনেছি। সেদিকে আমার তালতো ভাই এবং খালাতো ভাই দুটোই হয়। স্মৃতি আউড়িয়ে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর পরের ঘটনা। আমি ছোট ছিলাম। আত্মীয়তার সূত্রে তাদের বাড়িতে বেড়াতে গেলে বিয়ের কথা বলে ফুঁসলিয়ে আমার সাথে দৈহিক সম্পর্ক করে দেলোয়ার। এখন আমি বুড়ো হয়ে গেছি। আমার নাতি-নাতনিও বড় হয়েছে। এখন কাউকে বললে সমাজে আমাকে খারাপ মহিলা বলবে। কিন্তু আমার কপালের দুঃখ মুচছে না। ছোটবেলায় তাকে (সালাউদ্দিন) নিয়ে যায় দেলোয়ার কোম্পানি। রহমানিয়া স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি করিয়ে দেয়। পরে আবার তার (দেলোয়ার) স্ত্রী জোর করে সালাউদ্দিনকে তাড়িয়ে দেয়। ওইসময়ে তার (দেলোয়ার) মেয়ে মমতা এসে সালাউদ্দিনকে নিয়ে যায়। এখন আবার বের করে দিয়েছে। এটা সত্য উনি (দেলোয়ার) টাকার জোরে সব ম্যানেজ করে ফেলছে। গরীব বলে আমরা কোন বিচার পাচ্ছি না।’ তিনি বলেন, এই ঘটনার পর আমার স্বামী-সংসার হয়েছে। ছেলে-মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। ছেলেরা আমাকে ভরণপোষন দেয়। আমার কোন জায়গা জমি নেই। কিন্তু সালাউদ্দিন পথে পথে ঘুরছে। কাউকে বুঝাতে পারি না। আমিও তাকে কিছু দিতে পারি না।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস্‌ ফাউন্ডেশন চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট এএম জিয়া হাবীব আহসান দৈনিক আজাদীকে বলেন, একজন মানুষ তার পিতা কে? এই পরিচয় নিয়ে বাঁচতে পারবেনা, এটা মানবাধিকারের সুস্পষ্ঠ লংঘন। এটা তার অধিকার। তার পিতৃপরিচয় ঘোষণার জন্য যদি আদালতে যান এবং আদালতে ডিএনএ টেস্টের জন্য আবেদন করেন, তাহলে আদালতের নির্দেশে ডিএনএ টেস্ট করিয়ে পরিচয় নিশ্চিত করা যেতে পারে। যেহেতু পিতা বেঁচে আছে, সেহেতু এটা সম্ভব। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিনের সমস্যাটি নিষ্পত্তি হতে পারে। এ বিষয়ে দেলোয়ার হোসেন কোম্পানি গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ও (সালাউদ্দিন) কিসের সন্তান? আইডি কার্ড একটি বানালেই সন্তান হয়ে যায়? ও কোর্টে মামলা করেছে। মামলায় প্রমাণ করে আসতে পারলেতো ভালো কথা। এখন এটি আদালতের বিষয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসব পথ এসে মিশেছে বহদ্দারবাড়িতে
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে হবে, জানাতে হবে