বাংলাদেশের বিজয় ও স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হতে চলল। কালের বিচারে এটা নেহাত কম সময় নয়। কিন্তু পেছনে তাকিয়ে আত্ম সমীক্ষা করলে মনে হয় স্বাধীনতার ঊষালগ্নে আওয়ামী লীগ ও সিপিবি এই দুই দলের দুটি ঐতিহাসিক ভুল কাজের পরিণামে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আজ আক্রান্ত, পরাজিত ধর্মান্ধ শত্রুর বিকট আস্ফালনে দেশ সন্ত্রস্ত।
সশস্ত্র সুন্দরের এক মহাকাব্যিক আখ্যান আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুধু নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধ নয়, বরং দীর্ঘ তিন দশক ব্যাপি পরিব্যাপ্ত এক কঠিন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধের সাময়িক পরিসমাপ্তি মাত্র। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষ পাদে এসে সে লড়াই ক্রমে তীব্রতর হয়ে মুক্তিযুদ্ধের আবর্তে চলে যায়। এ দীর্ঘ লড়াইয়ে দুটি শক্তি, শক্তিতে-সামর্থ্যে এক না হলেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বচ্ছ, মুক্তির লক্ষ্যে ছিল তারা দৃঢ়ভাবে নিবেদিত। সেই লড়াইয়ের প্রধান নেতৃত্বে উঠে এসেছিলেন ডান ধারা থেকে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় ক্রমে বিবর্তিত হয়ে মধ্য বাম অবস্থানে চলে আসা অসম সাহসী বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর মেধাবী, প্রাজ্ঞ, স্থিতধী সহকর্মী তাজউদ্দিন আহমদ ও তাঁদের দল আওয়ামী লীগ। এ দু’জনের অসাধারণ রাজনৈতিক জুটি উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বিরল সম্মিলন। যতদিন এ জুটি অটুট ও অনড় ছিল ততদিন প্রবল পরাক্রান্ত প্রতিপক্ষ পশ্চাদপসরণ করেছে। অন্য শক্তিটি ছিল বিভ্রান্ত মাওবাদ ও বাম হঠকারী প্রবণতা থেকে মুক্ত মনি সিং-মোজাফ্ফর আহমদ নেতৃত্বাধীন বাম শক্তি ন্যাপ ও নিষিদ্ধ সিপিবি। দেশব্যাপী এই দুই সংগঠনের যেমন অভিন্ন বিস্তৃত সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক ছিল তেমনি ছিল শক্তিশালী ছাত্র ও শ্রমিক গণসংগঠন। এর বাইরে ছিল সেদিনের শক্তিশালী বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে সিপিবির দৃঢ় সংহতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, সিপিবি ও ন্যাপের মতামতের প্রভাবে ও চাপে প্রাথমিকভাবে দ্বিধাগ্রস্ত সোভিয়েত রাশিয়া পরবর্তীতে সর্বাত্মকভাবে এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয় না হলে একা ভারতের পক্ষে চীন মার্কিন অক্ষ শক্তিকে মোকাবিলা করা সম্ভব হত না। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ছাড়াও ন্যাপ-সিপিবির এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এখন বাজার রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের কালে কেউ আমলে নেয় না। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে অস্থায়ী সরকার ও যুদ্ধ পরিচালনায় তাজউদ্দীনকে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। একদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতা অন্যদিকে চীন-মার্কিন বৈরিতা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলে। তার চাইতেও দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলে বেশি। মার্কিন মদদে খন্দকার মোশতাক পাক-মার্কিন এজেন্ট হিসাবে পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন করার চক্রান্তে মেতে উঠে। অন্যদিকে শেখ মণি- সিরাজুল আলম খান প্রমুখ তরুণ তুর্কিদের নেতৃত্বে ছাত্র-যুবকদের এক বিরাট অংশ তাঁর সরাসরি বিরোধিতা শুরু করে। তাজউদ্দিন ধৈর্য্য, বৌদ্ধিক মননশীলতা, সততা ও আন্তরিকতা দিয়ে পরিস্থিতি সামলে নেন। এ সময়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম পাশে থেকে সমর্থন না দিলে বিপর্যয় ঘটে যেতে পারত। শুধু যুদ্ধ পরিচালনা নয় বিজয়ের প্রত্যাশায় প্রত্যয়ী তাজউদ্দিন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন নিয়েও বিস্তৃত পরিকল্পনা তৈরি করে রাখেন এবং মার্কিন সাহায্য না নিয়ে যুদ্ধের মত দৃঢ়তা, সাহস, সততা, তারুণ্যের শক্তি ও উদ্দীপনা নিয়ে দেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। আশা ছিল ‘মুজিব ভাই’ মুক্ত হয়ে পাশে থাকলে কোন কিছুই অসম্ভব হবে না।
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার কিছুদিন পরই তাঁর স্বপ্নভঙ্গের পালা শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার জন্য মোশতাককে শাস্তি দেওয়ার বদলে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়। শেখ মনির তাঁর প্রতি বিরুদ্ধতা ও বিরূপ আচরণ ক্রমে বাড়তে থাকে। মোশতাক হয়ে পড়েন ৩২ নম্বরের প্রাত্যহিক অতিথি, আর “মুজিব ভাই” বরং কেন যেন তাঁকে এড়িয়ে চলছিলেন। অভিমানাহত আত্মমর্যাদা সচেতন তাজউদ্দিন আপন বৃত্তের মধ্যে চলে গেলেন। লোক চক্ষুর অন্তরালে ধীরে ধীরে দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিনের মধ্যে। তাঁর গৃহীত উন্নয়ন পরিকল্পনা, পুনর্বাসন কর্মসূচি, পররাষ্ট্র নীতির মৌলিক অভিমুখ পাল্টে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের প্রতি নমনীয় মনোভাবের প্রকাশ ঘটতে থাকে। দলের এক বিরাট সংখ্যক নেতাকর্মী জড়িয়ে পড়ে নানা অনৈতিক কাজে। উপেক্ষিত, উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত তাজউদ্দিন অস্থির হয়ে পড়েন। ৭৪’ সালের প্রথম দিকে কোন উপায়ান্তর না দেখে তিনি সরকার ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। কেননা তাঁর প্রিয় “মুজিব ভাই” তাঁকে আর তখন আস্থায় নিচ্ছেন না। মার্কিন চক্রান্তে দেশে দেখা দিল খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ। তখন দেশের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে যেন এক ট্রাজিক নাটকের মঞ্চায়ন চলছিল। তিনি পদত্যাগের প্রস্তুতি নিতে না নিতেই হঠাৎ একদিন সরকার প্রধানের নির্দেশ এল ‘দেশের স্বার্থে’ তাঁকে পদত্যাগ করতে। একদিকে ভারমুক্তির আনন্দে অন্যদিকে দেশের ভবিষ্যত নিয়ে অজানা আশংকায় তাজউদ্দিন বিষাদঘন মনে বাড়ি ফিরলেন। চিরতরে ভেঙ্গে গেল সেই দুঃসময়ের জন্য অপরিহার্য এক রাজনৈতিক জুটি। আত্মঘাতী এক ভুলের কবলে পড়লো দেশ। ক্লাইমেক্সে উঠল ট্র্যাজেডি। এদিকে মোস্তাক গংদের চক্রান্ত ক্রমে চূড়ান্ত রূপ নিতে থাকে। বিবেকের দংশনে থাকতে না পেরে ‘অবাঞ্চিত’ তাজউদ্দিন ’৭৫ এর মধ্য জুলাইয়ের এক রাতে ছুটে গেলেন ‘মুজিব ভাইয়ের’ বাসায় তাঁকে শেষ বারের মত সাবধান করতে, কিন্তু মুজিব ভাই তো তখন তাঁর কথা শোনার মত অবস্থায় ছিলেন না। ট্রাজেডির নির্মম শেষ দৃশ্য মঞ্চস্থ হল ১৫ আগস্ট। দলে এবং সরকারে না থেকেও ২২ আগস্ট গ্রেপ্তার হলেন তাজউদ্দিন। জেলে যাবার সময় স্ত্রী জোহরা কতদিন জেলে থাকতে হতে পারে জিজ্ঞাসা করলে ভাবলেশহীন তাজউদ্দিন বললেন ঃধশব রঃ ভড়ৎবাবৎ তিনি জানতেন মোশতাক তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে না। ৩ নভেম্বর যা ঘটল তা তো ট্র্যাজেডির বঢ়রষড়মঁব; অসমাপ্ত প্রতিবিপ্লবের অনুবর্তিকা। “কাদম্বিনি মরিয়া যেমন প্রমাণ করিল যে সে মরে নাই”, তেমনি তাজউদ্দিন জীবন দিয়ে প্রমাণ করলেন যে তিনি ছিলেন ‘মুজিব ভাইয়ের’ প্রতি চির বিশ্বস্ত।
দ্বিতীয় যে ভুল দেশ ও রাজনীতির উল্টো যাত্রার অন্যতম কারণ বলে আমার মনে হয় তা হল সিপিবির’ ১৯৭১ সালে গৃহীত একটি সিদ্ধান্ত। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একই আদর্শ, একই লক্ষ্য এমনকি একই নেতৃত্বে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পরিচালিত ন্যাপ ও সিপিবি স্বাধীন দেশে আলাদা দুটি রাজনৈতিক দল হিসাবে আবির্ভূত হয়। একই আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি দেশে তো দুটি পার্টি গড়া যায় না। বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্টরা কৌশল হিসেবে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের নিয়ে ভিন্ন নামে কিন্তু কমিউনিস্ট আদর্শ ও গঠনতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ একটি পার্টির হিসাবে কাজ করে। ক্রমে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা পার্টিতে মিলে যায়। আমাদের দেশে পার্টি বিলুপ্ত না করেও ন্যাপকে সে আদলে পুনর্গঠন করা যেত। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দল হিসাবে ন্যাপকে বিচ্ছিন্ন আলাদা একটি দল করার দিকে ঠেলে দিয়ে, শ্রমিক ছাত্র গণসংগঠনগুলোকে পার্টির নিয়ন্ত্রণে এনে কার্যত এটিকে অবলুপ্তির দিকে ঠেলে দেয়া হয়। অথচ ন্যাপ-সিপিবি মিলে একটি সংগঠন হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের বিকল্প একটি শক্তিশালী বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা ছিল সব চাইতে বেশি, শাসক দলের সাথে ঐক্য ও সংগ্রামের সঠিক লাইনে ঐ শক্তি এগিয়ে গেলে পরিস্থিতি ভিন্নতর হত। ঐ সিদ্ধান্তের ফলে ন্যাপ ও সিপিবি কোনোটাই শেষ পর্যন্ত দেশের রাজনীতিতে শক্তি হিসাবে দাঁড়াতে পারল না। সে শূন্য স্থানে প্রথমে এল জাসদ, ’৭৫ এর পরে এল বিএনপি ও ধর্মান্ধ জামাত ইত্যাদি। সমাজ তো এখন কার্যত রাজনৈতিকভাবে ধর্মব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণেই চলে গেছে যদিও ’৭১-৭৫ এর মধ্য বাম অবস্থানের আওয়ামী লীগ এখন মধ্য ডানে গিয়ে ক্ষমতা ধরে রেখেছে। সেই রাজনীতির অনুষঙ্গ হিসাবে মুক্ত বাজার অর্থনীতির নামে চলছে কর্পোরেট পুঁজি বেশুমার লুটপাট ও সমাজ এগিয়ে চলছে ধর্মান্ধতা ও চূড়ান্ত অবক্ষয়ের দিকে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে এসে নির্দ্ধিধায় বলতে পারি দুই দলের উপরোক্ত দু’টি ঐতিহাসিক ভুলের কারণে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ খোল নলচে পাল্টে গেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতেই প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে হাত দিয়েছে ধর্মান্ধ দুর্বৃত্তরা। ১৯৭৫ থেকে শাসক গোষ্ঠীর আশ্রয় আর প্রশ্রয়ে পুষ্ট বেপরোয়া পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তি আজ খামচে ধরেছে জাতির পতাকা, জাতির অস্তিত্ব। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আজ আক্রান্ত মুক্তিযুদ্ধ, আক্রান্ত মানবতা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, অধ্যাপক