ট্রাম্প-মোদী পপুলিস্ট সরকার
ট্রাম্প-মোদী-পুতিন-জনসন এরা হলেন বর্তমান রাজনৈতিক বিশ্বে পপুলিস্ট সরকার ও পপুলিস্ট নেতার উদাহরণ। পপুলিস্ট শব্দটা গত এক যুগের আবিষ্কার। এর অনেক আগেও কোন ব্যক্তি বিশেষের নিজস্ব ধ্যান ধারণা ও স্টাইলের উপর বিভিন্ন রাজনৈতিক নামকরণ হয়েছে। যেমন চীনের নেতা মাও সে তুং এর জীবনকালে মাও এর সরকার পরিচালনার স্টাইলকে ‘মাওবাদ’ বলা হত। মিসরের আবদাল নাসেরের প্যান-আরব মতবাদ আরব বিশ্বের তরুণদের উদ্বুদ্ধ করত। এসব দেশে মাও বা নাসেরের স্মৃতি এত বেড়ে গিয়েছিল যে প্রায় মানুষ পকেটে মাওবাদ নাসেরবাদের পুস্তিকা রাখত।
পরবর্তী বিশ্বে বৃটেনে মার্গারেট থ্যাচার পুঁজিবাদের ক্রম লয় রোধে কিছু অর্থনৈতিক সংস্কার করে বিলাতের অর্থনীতি চাঙ্গা করেন। মানুষ থ্যাচারকে ৩ বার ভোট দেয়। তখনও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ‘থ্যাচারবাদ’ বলতে থাকে।
বহুদিন পর আবার বিশ্ব ট্রাম্পবাদ মোদীবাদ ও পুতিনবাদ দেখছে। আগের যুগের ‘ব্যক্তিবাদ’গুলো যেমন যুগের পরিবর্তনে মানুষ ভুলে গেছে তেমনি বর্তমান ট্রাম্প-মোদী দুইজন চটকদার বক্তব্য দিয়ে মানুষকে সম্মোহিত করে টিকে আছে।
এটা বিশ্লেষণের দরকার আছে ট্রাম্প এর চমক এক টার্মেই শেষ হয়ে গেল কিন্তু মোদী ইজম এখনও টিকে আছে কি ভাবে?
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ‘পপুলিস্ট’ নেতাদের সমস্যা প্রকট হয়ে গেছে। বিলাতে জনসন নিজের কথাবার্তা দিয়ে যেন বিরোধী লেবার পার্টির ক্ষমতায় আসার পথ তৈরি করছে। মেঙিকোতে লোপেজকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। পুতিনের দল স্থানীয় পরিষদের নির্বাচনে তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলসনারো প্যানডেমিক এ জনগণকে ‘ক্যাশ’ প্রণোদনা দিয়ে কোনমতে টিকে আছে। তুরস্কের এরদোগান ‘ইসলামিক আইডেনটিটির’ রাজনীতি নিয়ে এখনো টিকে আছে। ট্রাম্প বেহাল অর্থনীতি সামলাতে পারেনি। প্যানডেমিক মোকাবিলায় ব্যর্থতা, অহেতুক চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ ইত্যাদি কারণে পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ট্রাম্পের বিপুল জনসমর্থন। পপুলিস্ট এমনই জিনিস। হিটলার যেমন পুরো জার্মান জাতিকে সম্মোহিত করতে পেরেছিলেন তেমনি পপুলিস্ট নেতারাও কথায় ফুলঝুরি দিয়ে জাতিকে সম্মোহিত করে রাখে, অর্থনীতি, কর্ম-সংস্থান, সুশাসন ইত্যাদির প্রবল সংকট থাকে এসব নেতাদের সরকার পরিচালনায়।
বিশ্বের এই টালমাটাল অবস্থায় মোদী এখনো কিভাবে দেদীপ্যমান তার উপর অনেকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। মোদীর ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ভারত বড় বড় সমস্যায় পড়েছে। যেমন নোট প্রত্যাহার বহু মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আগে নোট প্রত্যাহারের কি সুফল এসেছে কোন মোদীপন্থী নেতা বলতে পারছে না। বিদেশে পাচারকৃত অর্থ প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের ঘরে ভাগ করে দেবে-অঙ্গিকার নিয়ে প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসেছিলেন মোদী। তার কোন খবর নেই। মাত্র ৪ ঘণ্টার নোটিশে ‘লকডাউন’ করে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে রাস্তায় ফেলে রেখেও মোদী দেদীপ্যমান, ভারতীয় অর্থনীতি, বেকারত্ব গত ৪৫ বৎসরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। তারপরেও মোদী টিকে আছেন। সর্বশেষ চায়নার আক্রমণ সম্বন্ধে ঘোষণা দিতে ৩ দিন দেরি হয়। প্রথমে জানতই না যে, ভারতীয় সেনাদের ধরে নিয়ে গেছে। এতসব সত্ত্বেও মোদীর রাজত্ব টিকে আছে তার কারণ কি?
রিকিন ভবানী ও মার্ক কোপেলভিচ নামে দুই রাষ্ট্র বিজ্ঞানী মোদীর পপুলিস্ট সরকার টিকে থাকা নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন। উত্তর প্রদেশ ও বিহারের মত রাজ্য-যেখানে পরিযায়ী শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানেও আশ্চর্যমূলকভাবে মোদীর দল জিতেছে।
মোদীর ‘হিন্দুত্ববাদী’ প্রচারণা হিটলারের ‘জার্মানিই সেরা’ মতবাদের মত পুরো ভারতকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। তার উপর মোদীর অত্যন্ত শক্ত প্রচারণা টিম রয়েছে। এই টিম কখনো গুজব ছড়িয়ে দাঙ্গা ছড়ায়। কখনো পরিসংখ্যান দিয়ে তাক লাগায়। সব কিছুর ফায়দা পায় মোদী। মোদীকে অপরিহার্য ‘নেতা’ রূপে জাতির কাছে তুলে ধরতে মোদীর প্রচারণা টিম অত্যন্ত সফল হয়েছে। যে কাজ অনেক ভারতীয় রাজনৈতিক দল করতে পারেনি। তা হল মোদী তৃণমূল পর্যায়ে কর্মী সংঘবদ্ধ করেছে। দু একটা রাজ্য ছাড়া সব রাজ্যেই মোদীর দল অত্যন্ত সংঘবদ্ধ।
যে কাজগুলো পৃথিবীর অন্য পপুলিস্ট সরকার করতে পারেনি অর্থাৎ অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, সুশাসন তা মোদীও পারেনি। কিন্তু মোদী ভারতের মূল সমস্যাগুলো পাশ কাটিয়ে নন ইস্যুকে ‘ইস্যু’ বানাতে সমর্থ হয়েছেন। তাই ট্রাম্পের এক টার্ম খতম হলেও মোদী হয়তো অনেক টার্ম টিকে যাবেন। মোদীর প্রচারণা টিম সরকারের সফলতা থেকেও নেতা মোদীই ভারত, ভারতই মোদী এই কাজে সফল। সমস্ত জাতীয় নেতাদের বিপরীতে মোদীকে এক অনন্য উচ্চতায় ফোকাস করে- যার কারণে অনেক অর্থনৈতিক মাইনাস পয়েন্ট পেয়েও মোদী হয়তো আরো দীর্ঘ সময় টিকে থাকবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও চিকিৎসক