৭ জানুয়ারি ২০২১ বর্তমান সরকারের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের যুগপূর্তি হলো। ২০১৮ এর ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর ২০১৯ এর এ দিনে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার টানা তৃতীয় মেয়াদে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে এ বছর ২০২১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে। এ সময়কে সামনে রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য প্রদান করেন। যা খুবই আশাব্যঞ্জক। তাঁর সময়কালে বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য উত্থান হয়েছে। যা অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর। বিগত দশকে বাংলাদেশের সাফল্যগাথা নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে বোধ হয় কোনো স্বল্পোন্নত দেশ বা উন্নয়নশীল দেশ নিয়ে এতো হয়নি। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আবারো আলোচনায় বাংলাদেশ এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। ২০০৯ হতে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের মাথা পিছু আয় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। হংকং সংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশনের প্রক্ষেপণ, বাংলাদেশে বলা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে ২৬ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। সেন্টার ফর ইকোনিমিঙ এন্ড বিজনেস রিসার্চের (সিইবিআর) এর প্রক্ষেপন মতে, ২০৩৫ সালেই বাংলাদেশ ২৫ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের বিস্ময়, বাড়ছে দেশের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) পরিমাণ, বাড়ছে অর্থনীতির আকার। পাকিস্তানী দুঃশাসনের হাত থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর মাত্র কয়েক কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যাত্রা শুরু করে ছিল। সে ছোট অর্থনীতির দেশটি স্বাধীনতার সূর্বণজয়ন্তী পালনকালে তাদের বাজেট আজ পাঁচ লাখ কোটিকেও ছাড়িয়ে গেছে। ছোট অর্থনীতির দেশটি আজ বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে এশিয়ার ‘টাইগার ইকোনোমি’ হিসেবে।
সরকারের বিস্ময়কর উত্থান ও শিল্প উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় অনেক সময় কিছু কিছু স্ববিরোধী সিদ্ধান্ত ও কিছু মহলের অতি উৎসাহী মনোভাব ও সিদ্ধান্তে সরকারের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং এ মহলের এত বেশি উৎসাহী হওয়ার পিছনের কারণ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সরকারের ভিতরের এসব হাইব্রিডদের কারণে সরকারের উন্নয়শীল শিল্প বিপ্লব এবং উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
দেশের উন্নয়নে জ্বালানি অন্যতম উপসর্গ। সে জ্বালানি সংকটের দীর্ঘ একযুগের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম এলাকায় সকল পর্যায়ে গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকে। ফলে দেশের শিল্পায়নের অগ্রগতি এক প্রকার থমকে ধারায়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় এবং চট্টগ্রামের উন্নয়নের স্বার্থে এবং দেশে শিল্পায়নের স্বার্থে দেশে গ্যাস সংকট মেটানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে চট্টগ্রামের শিল্প উদ্যোক্তাদের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে এলএনজি (লিকুফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) আমদানির পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
চট্টগ্রাম বিদ্বেষী কতিপয় আমলার সকল বাধানিষেধ অগ্রাহ্য করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় চট্টগ্রামে শিল্প কারখানার ক্যাপটিভ ও শিল্প খাতে গ্যাস সংযোগ প্রদানের নির্দেশনা দেয়া হয়। ফলে দেশে শিল্পায়ন প্রক্রিয়া দ্রুত গতিতে এগোতে থাকে। দ্রুত শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে একটি মডেল হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু সুযোগ সন্ধানীরা সরকারের উন্নয়ন এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বাপ্নিক সফল যাত্রাকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করতে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
সরকারের এক যুগপূর্তি এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা গতিরুদ্ধ করার জন্য এক শ্রেণীর অতি উৎসাহী মহল জ্বালানী অর্থাৎ গ্যাসকে আবারো হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে। সে কথাটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যুগপূর্তি উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশে যে বক্তব্য প্রদান করেছেন সেখানে তা বলেছেন। চট্টগ্রামে তথা দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে আবারো গ্যাস সরবরাহ রেশনিং শুরু করেছে। চট্টগ্রামের চাহিদা পূরণের জন্য ৫০০ মিলিয়ন গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের সকল মহলের সদিচ্ছা উদাহরণ হয়েছিল। এখন আবার সে মহল হতেই নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সংযোগকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন শিল্প সংযোগে কালক্ষেপণ করে বিনিয়োগকে সংকটে ফেলছে। এই না সেই বিভিন্ন আইন ও প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিল্প উদ্যোক্তাদেরকে নিরুৎসাহিত করার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। সরকারের এক যুগপূর্তি এবং বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে সরকার প্রধানের স্বাপ্নিক উন্নয়নের অভিযাত্রাকে গতিশীল রাখার স্বার্থে অতি উৎসাহী কিছু সংখ্যক উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার বিষয়ে সতর্ক নজর রাখা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের সংগঠনগুলোর মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা বিনিয়োগকারীদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখছেন। যা একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য মোটেই শোভনীয় নয়।
দেশে এলএনজি আমদানী শুরুর পর চট্টগ্রামে ৩৫০ হতে ৩৮০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছিল। এ সরবরাহ ব্যবস্থাকে ৫০০ এমএমসিএফডিতে উন্নীত করার লক্ষ্যে চট্টগ্রামের উপর বার বার চাপ দেয়া হয়েছে। অথচ সে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫০ হতে ২৬০ এমএমসিএফডি। চট্টগ্রামে শুরু করা হয়েছে গ্যাস সরবরাহে রেশনিং। শিল্প গ্রাহকদেরকে গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে বিলম্ব করা হচ্ছে। ক্যাপটিভ খাতে বিগত ৫/৬ মাসে একটি সংযোগেরও অনুমোদন দেয়া হয়নি। তারমধ্যে অনেকের জামানতের টাকা পরিশোধ করা রয়েছে, সিএনজি গ্রাহকদেরকে সকল প্রকার প্রস্তুতি যেমন অনুমোদনের, জামানত প্রদান, মেশিনারী আমদানি সহ সকল প্রকার প্রক্রিয়া শেষ করে ও গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় পথে বসতে চলেছে অনেক উদ্যোক্তা। আজকে যে আইনের মাধ্যমে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে আবার কালকে তা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। এ সেক্টর সকল ক্ষেত্রে অস্থিরতা চলছে। এতে ক্ষতির শিকার হচ্ছে জনগণ। পথে বসতে বসেছে উদ্যোক্তারা। আস্থা নষ্ট হচ্ছে সরকারের প্রতি। প্রত্যেকদিন শিল্পে গ্যাস সংযোগের জন্য আবেদন করা হচ্ছে। কিন্তু ২ মাসে কোন সংযোগের অনুমোদন দেয়া হয়নি। ৫/৬ মাসে ক্যাপটিভ খাতে গ্যাস সংযোগের কোন অনুমোদন দেয়া হয়নি।
শিল্পে দ্রুত উন্নয়ন দেশের ধারাবাহিক উন্নয়নের মাধ্যম। অর্থনীতিকে গতিশীল রাখার জন্য শিল্প স্থাপনের কোন বিকল্প নেই। সুযোগ সন্ধানীরা এ জায়গাতেই ষড়যন্ত্রের থাবা বসিয়েছে। শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিবন্ধকতা সরকারের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্তের এক প্রকার অপচেষ্টা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যুগপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রদত্ত ভাষণে এসব প্রতিবন্ধকতা অপসারণের ঘোষণা দিয়েছেন। তাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু ‘শর্ষের ভিতর ভূতকে’ কে অপসারণ করবে? অতি উৎসাহী মহলের তৎপরতা কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা প্রয়োজন। এদের কারণে সরকারের কার্যক্রম জনগণের নিকট প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। সরকার ও জনগণের মাঝে দূরত্ব তৈরি হয়। কাজেই সময় থাকতেই সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক, শিল্পশৈলী