বহির্নোঙরে যায়নি কোনো জাহাজ

আমদানিকারকদের কাছে আটকা কয়েকশ’ কোটি টাকা নিয়ে সংকট।। জাহাজ জট ও আমদানি বাণিজ্যে প্রভাব পড়ার শংকা

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ১৩ জানুয়ারি, ২০২১ at ৭:৫৮ পূর্বাহ্ণ

আমদানিকারকদের কাছে আটকা পড়া জাহাজ ভাড়ার কয়েকশ’ কোটি টাকার কোন সুরাহা না হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে জাহাজ পাঠানো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাতিল করে দেয়া হয়েছে ডব্লিউটিসির বার্থিং মিটিং। এতে করে প্রতিদিন অন্তত ৫০টি লাইটারেজ জাহাজ বহির্নোঙরে পণ্য খালাসে গেলেও গতকাল একটি জাহাজও যায়নি। জাহাজ মালিকদের পক্ষ থেকে ভাড়ার ধরন নির্ধারণের ব্যাপারে আমদানিকারকদের প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আমদানিকারক, লাইটারেজ জাহাজ মালিক, পণ্যের এজেন্ট এবং লোকাল এজেন্ট মিলে পক্ষে বিপক্ষের বিরোধে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) অবস্থা নাজুক আকার ধারণ করছে। জাহাজ মালিকদের পক্ষ থেকে আটকে পড়া কয়েকশ’ কোটি টাকা ভাড়ার টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত জাহাজ বরাদ্দ না দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়েছে। অপরদিকে আমদানিকারকদের পক্ষ থেকে ভাড়া নির্ধারণের সিস্টেমকে ‘বিতর্কিত’ এবং ‘নজিরবিহীন’ আখ্যায়িত করে বিষয়টি সুরাহার দাবি জানানো হয়েছে। জাহাজ ভাড়ার ধরন নির্ধারণ এবং টাকা আটকে পড়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেখা দেয়া এই সংকটে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে জাহাজ জট এবং দেশের আমদানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাবসহ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে পণ্য পরিবহন নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়ারও আশংকা তৈরি হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং চট্টগ্রাম চেম্বার দ্রুত সংকট সুরাহার আহ্বান জানিয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, লাইটারেজ জাহাজের ভাড়া নিয়ে আমদানিকারক এবং জাহাজ মালিকদের প্রতিনিধিদের বিরোধের জের ধরে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে পণ্য খালাসের জন্য জাহাজ বরাদ্দ প্রদান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সোমবার বহির্নোঙরে প্রায় ৬০টি জাহাজ পণ্য খালাস করতে গেলেও গতকাল একটি জাহাজও বরাদ্দ দেয়া হয়নি। এতে করে বহির্নোঙরে লাখ লাখ টন আমদানি পণ্য নিয়ে অপেক্ষমাণ ৫০টিরও বেশি জাহাজ থেকে পণ্য খালাস বন্ধ হয়ে যাবে। এই অবস্থা লাগাতার হলে বহির্নোঙরে অলস জাহাজের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। গতকাল ৫০টির মতো জাহাজ থাকলেও আজ আরো কয়েকটি জাহাজ বিশ্বের নানা দেশ থেকে পণ্য নিয়ে চট্টগ্রামে আসছে। এসব জাহাজের মধ্যে ৮.৫ মিটার ড্রাফট এবং ১৯২ মিটার লম্বা জাহাজই শুধু বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে। এই ধরনের জাহাজ সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টন পণ্য বহন করতে পারে। এর থেকে বেশি ধারণক্ষমতার জাহাজগুলোকে বহির্নোঙরে অবস্থান করে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পণ্য খালাস করতে হয়। বিশ্বের নানা দেশ থেকে লাখ লাখ টন পণ্য নিয়ে আসা বড় বড় মাদার ভ্যাসেলগুলো থেকে এই প্রক্রিয়ায় পণ্য খালাস করতে হয়। আবার কিছু কিছু জাহাজ ড্রাফট কমানোর জন্যও বহির্নোঙরে পণ্য খালাস করে। চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙরে বর্তমানে বছরে নয়শ’রও বেশি মাদার ভ্যাসেল হ্যান্ডলিং করে। এসব জাহাজে অন্তত ছয় কোটি টন পণ্য হ্যান্ডলিং করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে প্রায় দেড় হাজার লাইটারেজ জাহাজ রয়েছে। এসব জাহাজের স্বাভাবিক চলাচলের উপর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরসহ দেশের পণ্য পরিবহন নেটওয়ার্ক পুরোপুরি নির্ভর করে। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় বেশ কিছু লাইটারেজ জাহাজ রয়েছে। যেগুলো নিজেদের মতো করে চলাচল করে। এর বাইরে সাধারণ আমদানিকারকদের পণ্য পরিবহনের ব্যাপারটি ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ডব্লিউটিসি প্রতিদিনই বার্থিং সভা করে আমদানিকারকদের চাহিদার বিপরীতে লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। ভাড়ার ধরণ এবং আটকে পড়া টাকা আদায়ের অনিশ্চয়তায় গতকাল থেকে ডব্লিউটিসি জাহাজ বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে। এতে করে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিদিন গড়ে ৬০টির মতো জাহাজ বহির্নোঙরে গেলেও গতকাল আমদানিকারকদের পণ্য খালাসে একটি জাহাজও বরাদ্দ দেয়া হয়নি।
সূত্র জানিয়েছে, ডব্লিউটিসি দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় করে জাহাজ বরাদ্দ এবং ভাড়া আদায় করে থাকে। এরমধ্যে আমদানিকারকদের প্রতিনিধি হিসেবে ডব্লিউটিসির তালিকাভুক্ত পণ্যের এজেন্ট এবং জাহাজ মালিকদের প্রতিনিধি লোকাল এজেন্টদের কাছ থেকে জাহাজ ভাড়া নেয়। ভাড়ার টাকা ডব্লিউটিসির নিকট প্রদান করা হয়। ডব্লিউটিসি আদায়কৃত ভাড়া লোকাল এজেন্টকে প্রদান করে। লোকাল এজেন্ট ভাড়া প্রদান করে জাহাজ মালিকদের। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলে ৩৩ জন পণ্যের এজেন্ট এবং ৬০ জন লোকাল এজেন্ট রয়েছেন। দেশের অভ্যন্তরীণ খাতের পণ্য পরিবহনের পুরোটাই এদের উপর নির্ভরশীল। আবার অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন খাতের এই কর্মকাণ্ডের উপর নির্ভরশীল চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরের কার্যক্রম থেকে শুরু করে দেশের আমদানি বাণিজ্য। কিন্তু আমদানিকারকদের কাছে আটকে পড়া ভাড়ার টাকাকে কেন্দ্র করে গতকাল ডব্লিউটিসি জাহাজ বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়ায় পুরো সিস্টেমটি ভেঙে পড়েছে। ডব্লিউটিসি বার্থিং সভা বাতিল করে দিয়ে বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের জন্য একটি জাহাজও বরাদ্দ দেয়নি। জাহাজ মালিকেরা পণ্যের এজেন্টদের কাছে আটকে পড়া টাকা না পাওয়া পর্যন্ত জাহাজ বরাদ্দ দেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য আমদানিকারকদের প্রতিনিধি পণ্যের এজেন্টদের পক্ষ থেকে এই ভাড়া নির্ধারণে বড় ধরনের ‘সংকট’ রয়েছে বলে দাবি করেছে। তারা বলেছেন, একটি লাইটারেজ জাহাজ বহির্নোঙর থেকে পণ্য নিয়ে কোথাও গেলে ১৮ দিনের মধ্যে খালাস করে দেয়ার নিয়ম করা হয়েছে। এর মধ্যে খালাস করা সম্ভব না হলে পরবর্তী ১৭দিন যদি জাহাজটি ঘাটে অলসও বসে থাকে তবুও সেকেন্ড ট্রিপ হিসেবে ভাড়া হিসেব করা হয়। এক্ষেত্রে মূল ভাড়ার আশি শতাংশ ধরা হয়। এর ১৭দিন পরে ধরা হয় থার্ড ট্রিপ। সেকেন্ড বা থার্ড ট্রিপের জন্য নির্দিষ্ট দিনের আগে যদি জাহাজ খালি করে দেয়া হয় সেক্ষেত্রে প্রতিদিনের জন্য ১০/১২ হাজার টাকা করে (জাহাজের আকৃতির উপর এই অংক নির্দিষ্ট থাকে) ডেমারেজ হিসাব করা হয়। করোনাকালে সেকেন্ড ট্রিপ এবং থার্ড ট্রিপের এই অংক ৬০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। করোনাকালীন সুবিধা ৩১ মে পর্যন্ত প্রদান করা হয়। এরপর থেকে আবারো আগের নিয়মে ভাড়া হিসাব করা হচ্ছে। কিন্তু আমদানিকারকদের প্রতিনিধি পণ্যের এজেন্টদের পক্ষ থেকে ৩১ মে’র পরেও করোনাকালীন দেয়া ৬০ শতাংশ সুবিধা অব্যাহত রাখার দাবি জানানো হয়। তারা ব্যবসা বাণিজ্যের নাজুক অবস্থায় বিষয়টি বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে জরুরি পত্র দেয়। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল ডব্লিউটিসির কো-কনভেনর মোহাম্মদ নুরুল হক স্বাক্ষরিত এক পত্রে এই দাবি বাস্তবসম্মত নয় বলে নাকচ করে দেয়া হয়। ইতোমধ্যে আমদানিকারকদের কাছে জাহাজ মালিকদের প্রচুর টাকা আটকা পড়েছে। জাহাজ মালিকদের পক্ষ থেকে এই টাকা পরিশোধ করা এবং আগের নিয়মে ভাড়া এবং পরবর্তী ট্রিপের হিসাব নির্ধারণ করার ব্যাপারে লিখিত অঙ্গীকার না করা পর্যন্ত জাহাজ বরাদ্দ স্থগিত করে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের আলোকেই গতকাল নির্ধারিত বার্থিং সভা বাতিল করে দেয়া হয়।
গতকাল একাধিক পণ্যের এজেন্ট দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেন, করোনাকালে ব্যবসা বাণিজ্য খুবই খারাপ। পণ্য বোঝাই করার পর যে কোনো কারণে জাহাজ খালি করতে দেরি হতে পারে। কিন্তু প্রচলিত নিয়মে জাহাজ না চললেও নির্দিষ্ট সময়ের পর সেকেন্ড ট্রিপ এবং থার্ড ট্রিপ কাউন্ট করে মূল ভাড়ার আশি শতাংশ আদায় করা হয়। এই অংকটি বিশাল। করোনাকালে বিশেষ বিবেচনায় ৮০ শতাংশের স্থলে ৬০ শতাংশ করা হয়েছিল। কিন্তু মার্চের ২৬ তারিখ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত এই হিসেবে ভাড়া নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীতে আবারো আগের নিয়মে টাকা আদায় করা হচ্ছে। এভাবে ভাড়া নির্ধারণ দুনিয়ার কোথাও নেই বলেও তারা মন্তব্য করেন।
বিষয়টি নিয়ে লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের প্রধান নির্বাহী মাহবুব রশিদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি গতকালের নির্ধারিত বার্থিং মিটিং বাতিল করার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, যে কোনো কিছুর জন্য একটি নিয়ম আছে। কোনো কিছু আদায় করারও একটি সিস্টেম আছে। কিন্তু কোনো কিছু না মেনে যা ইচ্ছে তা করার তো সুযোগ নেই। মাহবুব রশিদ বলেন, ভাড়া কমাতে বা কোনো ছাড় চাইলে আবেদন করে একটি সময় দিতে হবে। যা পরবর্তী একটি তারিখ থেকে কার্যকর করার কথা বলা যেতে পারে। তা না করে অতীতের একটি বিষয় এখনই কার্যকর করার দাবি করা অযৌক্তিক। যেটা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় জাহাজ মালিকদের পক্ষ থেকে পণ্যের এজেন্টদের দাবি নাকচ করা হয়েছে। যার জের ধরে আজ বার্থিং মিটিং হয়নি। কোনো জাহাজই বহির্নোঙর থেকে পণ্য খালাস করতে যায়নি। আটকে পড়া টাকা প্রদান এবং ভাড়ার হিসাব আগের নিয়মে মেনে নেয়ার ব্যাপারে লিখিত অঙ্গীকার প্রদান না করলে জাহাজ বরাদ্দ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই বলেও তিনি জানান।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম চেম্বার প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, লাইটারেজ জাহাজ নিয়ে যে কোনো ধরনের সংকট দেশের আমদানি বাণিজ্যে সরাসরি আঘাত করে। আজ বার্থিং মিটিং না হওয়ায় কোনো জাহাজ বহির্নোঙরে যায়নি। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহন নেটওয়ার্ক ভেঙে যাওয়ার আশংকা প্রকাশ করেছেন তিনি। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তিনি দ্রুত সংকট সুরাহার আহ্বান জানিয়েছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, লাইটারেজ জাহাজ চলাচলের বিষয়টি বন্দর কর্তৃপক্ষ দেখভাল করে না। কিন্তু এই জাহাজ চলাচলের সাথে বন্দরের কার্যক্রম বেশ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। বহির্নোঙরে পণ্য খালাস বন্ধ হয়ে গেলে জাহাজজট সৃষ্টি হয় যা আমদানি বাণিজ্যের পাশাপাশি বন্দরের ইমেজ নষ্ট করে। বিষয়টি আলাপ আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সুরাহার জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধটিকা সংগ্রহ-বিতরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের আহ্বান টিআইবির
পরবর্তী নিবন্ধবাড়ছে সহিংসতা