রণাঙ্গনে শহীদ চার কিশোর যোদ্ধা

আরিফ রায়হান | বুধবার , ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৯:৩০ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। দীর্ঘ ৯ মাস বাঙালি ছাত্র-জনতা-পুলিশ, বিডিআর, সামরিক বাহিনীর জওয়ান, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও কৃষক শ্রমিকরা পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। মরণপণ এ যুদ্ধে পাকবাহিনীকে পরাস্ত করে এদেশের বীর সন্তানরা ’৭১ এর ষোল ডিসেম্বর ছিনিয়ে এনেছে স্বপ্নের স্বাধীনতা। বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করেছে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা যেমন অবদান রেখেছেন, তেমনি অবদান রেখেছে এদেশের অসংখ্য শিশু-কিশোর, যারা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রায় ৪ লাখই ছিল শিশু-কিশোর। আর যে সব নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল কিশোরী। এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বড়দের সঙ্গে যুদ্ধের রণাঙ্গণে নেমেছিল শিশু কিশোররাও। প্রয়োজনীয় যে কোনো মুহূর্তে এক ক্যাম্পের খবরা খবর অন্য ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়েছে। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে খাবার সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে তুলে দিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর হয়ে পাকিস্তানি শিবিরে ঢুকে প্রয়োজনীয় তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়েছে। আবার অনেক কিশোর প্রশিক্ষণ নিয়ে রণাঙ্গণে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। সম্মুখ যুদ্ধে পাকবাহিনীর তপ্ত বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে শহীদ হয়েছে অনেক কিশোর। যারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে অম্লান হয়ে আছে এদেশের ইতিহাসে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া অসংখ্য কিশোরের চার জন শহীদ কায়কাউস, শহীদ সবুজ, শহীদ শামীম ও শহীদ মতিউর। যাদের বীরত্বেও কথা স্মরণ করছি এই লেখায়।
শহীদ কায়কাউস: তার পুরো নাম কায়কাউস মোহাম্মদ রাজিউল আলম। সবাই ডাকতেন কাউসার। তার জন্ম ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি। তার বাবা সৈয়দ আলম খান এবং মা নজিফা খাতুন। চৌদ্দ ভাই বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আজিমপুর ওয়েস্ট স্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ত সে। ’৭১ এর ২৫ মার্চ কালরাতে নতুন পল্টন লেইনের বাসা ছেড়ে বাবা মা’র সাথে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের নিজ বাড়িতে চলে আসে কায়কাউস। বাবা-মা’র সাথে এখানে আসলেও তার মন পড়ে থাকে রণাঙ্গনে। একদিন বাবা-মাকে না জানিয়ে সে কুমিল্লা গোমতী- নদী সাঁতরে বিবি বাজার সীমান্ত দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেঘলায় ক্যাম্পে হাজির হয়। মুক্তিযুদ্ধের খাতায় নাম লিখিয়ে যুদ্ধের নানা প্রশিক্ষণ নেয়। প্রশিক্ষণ শেষে ২নং সেক্টরের আওতায় মন্দবাগ, নয়নপুর, কসবা, সালদা নদী এলাকায় সর্বকনিষ্ঠ যোদ্ধা হিসেবে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয় কায়কাউস। কনিষ্ঠ এ যোদ্ধা রণাঙ্গনে অনেক সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে বাবা-মা’র কোলে ফিরে এসেছিল। যুদ্ধের পর ১৯৭৪ সালের ২৪ জুন কতিপয় দুস্কৃতকারীরা এই বীর কিশোর যোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
শহীদ সবুজ: মাজহারুল মুনির সবুজের জন্ম ১৯৫৫ সালের ৭ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর জেলার পিয়ারাপুর গ্রামে। তার বাবা এ কে এম সিদ্দিক উল্লাহ এবং মা খুরশীদ আরা। স্ট্যাম্প ও কয়েন সংগ্রহ করা ছিল তার প্রিয় শখ। দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ছিল তার। তাই সবুজ ঢাকা ল্যাবরেটরি হাই স্কুলেল নবম শ্রেণীর ছাত্র অবস্থায় ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে ২নং সেক্টরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ’৭১ এর ২৩ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর হোসেলপুরে সম্মুখ যুদ্ধে পাকবাহিনীর সদস্যরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তার স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য নিজ গ্রাম পিয়ারাপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পিয়ারাপুর শহীদ মাজহারুল মুনির নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
শহীদ শামীম: শামীমুর রহমান শামীমের জন্ম ১৯৫৩ সালের ১৫ মার্চ, তারিখে। তার বাবা এ কে এম সিরাজুর রহমান এবং মা সাহারা বানু। বাবা-মা’র পাঁচ সন্তানের মধ্যে শামীম তৃতীয়। সাহসী এই কিশোর ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে মিছিলের অগ্রভাগে নেতৃত্ব দিয়েছে। তার হাতের লেখা ছিল ভারি সুন্দর। সুন্দর করে ব্যানার লিখতে পারতো বিধায় তাকে রাতের আঁধারে দেয়ালে লেখার কাজ করতে হতো। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার দেয়ালে- ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা’ তার হাতেরলেখা শোভা পেতো। যুদ্ধে পাকবাহিনীর বিভিন্ন খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাঠাতো শামীম। এক সময় তার বিষয় জেনে যায় পাকবাহিনীর সদস্যরা। ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল এলিফ্যান্ট রোড থেকে পাক সৈন্যরা জিপে করে তুলে নিয়ে যায় তাঁকে। পরদিন তার ক্ষত বিক্ষত লাশ মীরপুরের একটি ব্রিজের নিচে পাওয়া যায়।
১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ছাত্র জনতার মিছিলে অংশ নেয় পুরান ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক। মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয় মতিউর। এই মিছিল থেকেই সূচিত হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গণঅভ্যুত্থানের। মতিউরের মৃত্যুর পর তার লাশ নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্র-জনতা। এতে করে আরো জোরালো হয় স্বাধীনতার আন্দোলন। শহীদ মতিউরকেও মুক্তিযোদ্ধা বলা হয়। তার মৃত্যুর দিন প্রতিবছর ২৪ জানুয়ারি ‘গণঅভ্যুত্থান দিবস’ পালিত হয়। এই কিশোর শহীদের জামা-কাপড়, খেলনা, ঘুড়ি, ছবি, স্ট্যাম্প, কয়েন প্রভৃতি বাংলাদেশ শিশু একাডেমির শিশু জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনায় মৃত ব্যবসায়ীদের স্মরণে চাক্তাইয়ে দোয়া মাহফিল
পরবর্তী নিবন্ধলোহাগাড়ায় ব্যবসায়ীকে ছুরিকাঘাত করে টাকা ছিনতাই