১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু ভারতের সম্মানীয় শিল্পী সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমন্ত্রিত অতিথিরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে এই রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণ গ্রহণ করে উপস্থিত হয়েছিলেন। এঁদের সকলেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সহযোগিতা, সমর্থন ও কেউ কেউ সাংস্কৃতিকভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এঁদের অনেককেই বাংলাদেশ সরকার পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননায় সম্মানিত করেছেন।
সেবার ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বিশাল অনুষ্ঠান হয়েছিল কয়েকদিনব্যাপী। আমন্ত্রিত অতিথিরা পরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। সে-বছর এরপর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় শিল্পী, সাহিত্যিক এবং কলাকুশলীদের সমন্বয়ে বিশাল একটি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। তেমনই বাংলাদেশের একটি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলও ভারত সফর করেছিলেন। এরপর ১৯৭৪ সালে দু’দেশে দু’দেশের চলচ্চিত্রের সপ্তাহব্যাপী চলচ্চিত্র উৎসবও অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
১৯৭২ সালে সেই অনুষ্ঠানে অন্যান্য অতিথিদের সঙ্গে সলিল চৌধুরীও এসেছিলেন। সলিল অবশ্য এর আগে এবং পরে আরো কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছেন। তবে ১৯৭২ সালে সফরটা স্বভাবতই ছিল বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন। বঙ্গবন্ধু তখন বিশ্বের এক অবিসংবাদিত নেতা। প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সলিলেরও সাক্ষাৎ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি সলিল চৌধুরী ছিলেন বরাবরই শ্রদ্ধাশীল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও ছিল তাঁর অকুন্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা। তাঁর বিপ্লবী শিল্পীসত্তা বিশ্বের বিভিন্ন মুক্তিকামী জনতার স্বপক্ষে সর্বদা সোচ্চার থাকতো। আর বাংলাদেশ ও বাঙালির মুক্তিযুদ্ধতো তাঁর নিজের জাতিসত্তার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু সলিল চৌধুরীর গণসংগীতের একজন অনুরাগী ছিলেন। হেমন্তের কন্ঠে সলিলের নৌকা বাওয়ার গানটি বঙ্গবন্ধু খুব পছন্দ করতেন বলে এক সাক্ষাৎকারে জানা যায়।
এই উপমহাদেশের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সলিল চৌধুরীর গান বিপ্লবের গীতিমন্ত্র হয়ে অনেক ভূমিকা রেখেছে। নৌ বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ছেচল্লিশ ও সাতচল্লিশের দাঙ্গা, সাতচল্লিশের দেশভাগ এসব ঘটনা ও দুর্ঘটনাকে অবলম্বন করে তাঁর রচিত গান প্রতিটি ঘটনার সময় জনমনে চেতনা উজ্জীবিত করেছে।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়েও সলিলের গান রেখেছে প্রেরণাদায়ী ভূমিকা। ১৯৭১-এর সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন বেজেছে; ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’,‘মানবো না এ বন্ধনে,’ ‘ও আলোর পথযাত্রী’ ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’-অগ্নিঝরা এই সব গান। একটি দেশের, একটি জাতির মুক্তি সংগ্রামে এই গান রেখে গেছে অবিস্মরণীয় সঞ্জীবনী অবদান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বপক্ষে ভারতে গঠিত শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী ফোরামের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন একনিষ্ঠভাবে। ১৯৭১ সালে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী সবিতা চৌধুরী পুরো বছর ধরে তাঁদের রয়্যালটির অর্থ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তহবিলে দান করে গেছেন।
বিশ্বের সমস্ত মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে সলিল চৌধুরী ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক। খুব স্বভাবতই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ছিল তাঁর সশ্রদ্ধ সমর্থন। মুম্বাইতে তিনি ভারতীয় শিল্পী কলাকুশলীদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কেবল সোচ্চার সমর্থন নয়, নানভাবে সহযোগিতা করেছেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই তিনি ঢাকা এসেছিলেন। এসেছিলেন এর আগে ও পরে আরো কয়েকবার। তেভাগা আন্দোলনের সময় রংপুরে এসেছিলেন। এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তাঁর বিখ্যাত সেই গান রচনা, ‘হেই সামলো ধান হো’। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামের হরিখোলার মাঠে (এখনকার মোমিন রোডের মৈত্রী ভবন) অনুষ্ঠিত প্রথম নিখিল বঙ্গ সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলনে তাঁর নেতৃত্বে আইপিটিএ (ভারতীয় গণনাট্য সংঘ) অংশগ্রহণ করে। এই দলে ছিলেন সুচিত্র মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাসসহ শীর্ষস্থানীয় আরো অনেক শিল্পী সাহিত্যিক।
বাংলাদেশের দু’টি চলচ্চিত্র সলিল চৌধুরী সংগীত পরিচালনা করেন। ১৯৭২ সালে মমতাজ আলী পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘রক্তাক্ত বাংলা’ এবং ১৯৭৯ সালে আলমগীর কবির পরিচালিত ‘রূপালী সৈকতে’। রক্তাক্ত বাংলায় ‘ও দাদাভাই’ জনপ্রিয় এই গানটি বাংলাদেশে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া একমাত্র গান। দু’টি ছবিতে মোট আটটি গান ছিল যেগুলোর শিল্পী ছিলেন মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, শ্যামল মিত্র, তালাত মাহমুদ এবং সবিতা চৌধুরী। অবশ্য ছবি দু’টির গান রেকর্ডিং হয়েছিল কলকাতায় ও মুম্বাইতে। আবহ সংগীত নির্মাণের জন্যে তিনি দু’বারই ঢাকায় এসেছিলেন।
….আগামী সংখ্যায় সমাপ্য