: একাত্তরের এই দিনে।
: বিজয়ের বার্তা প্রতিজন বাঙালির ঘরে ঘরে। কিশোর বন্ধুরা পাকিস্তানী ঘাতকদের এলাকায় দেখতে পাচ্ছে না। ঘাতকদের সহযোগী বিহারির কসাই মার্কা ছেলেরা এখন আর পথে প্রান্তরে নেই। ৬ ডিসেম্বরের পর থেকে কিশোর তরুণরা পাড়ার অলিতে গলিতে প্রকাশ্যে বের হয়েছে। মৃত্যু ভয় থাকলেও শহরের মুক্তিযোদ্ধাদের দাপটে ঘাতক বাহিনী নিজেদের স্থাপনায় অনেকটা অবরুদ্ধ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী, বি বি সি, ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা সংবাদ যুদ্ধের গতি প্রকৃতি স্পষ্ট করেছে। মানুষ এই সংবাদগুলো এতোদিন শুনতেন অতি গোপনে এবং জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে ঘরের গোপন কক্ষে বসে। সময় যতোই গড়িয়ে যাচ্ছিলো স্বাধীনতা প্রিয় বাঙালিরা আস্তে আস্তে ভয়কে জয় করে বেরিয়ে এলো। জয় বাংলা শব্দ গভীর রাতে মাঝে মধ্যে শোনা যায়। এলাকার মানুষ এখন মুক্তিযোদ্ধাদের চিনতে শুরু করেছে, জানতে শুরু করেছেন। যারা এতোদিন আমাদের পাড়া, মহল্লা এবং এলাকাকে জিম্মি করে রেখেছিলো, বাড়ি ঘর লুট করেছিলো, বাঙালিদের ধরে পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দিয়েছিলো, কোন কারণ ছাড়াই হত্যা করেছিলো, নির্যাতন করেছিলো তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। তারপরও স্বাধীন বাংলা সরকারের নির্দেশ ধৈর্য ধারণ করুন, আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। এই নির্দেশনা ছিলো স্বাধীন দেশের মানুষ যেন ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তখনো সাধারণ মানুষ জানেন না ঘাতক বাহিনী চট্টগ্রাম শহরে ফয়’স লেক এর নিকটবর্তী স্থানে হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা করেছে, নদী ও সাগর পাড়ের স্থানে স্থানে হাজার হাজার বাঙালির লাশ জলে ফেলেছে। প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো অসংখ্য নির্যাতন কেন্দ্র, বধ্যভূমি। ১৪ ডিসেম্বর ঘাতকদের দোসরের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে অসংখ্য বাঙালি শহীদ বুদ্ধিজীবীকে। একথাগুলো বাঙালি ভালো করে জেনেছিলেন ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর।
: শহর চট্টগ্রামের কথা বলি।
: ৩ ডিসেম্বর হালিশহর ইপিআর ক্যাম্পে ঘাতকদের একটা বৈঠক হয়েছিলো। আলোচ্যসূচি ছিলো বাঙালিদের ব্যাপকভাবে হত্যা করবে। এজন্য শহর চট্টগ্রামকে তারা ৮টি অঞ্চলে বিভক্ত করেছিলো। এই অঞ্চলে বাঙালি নিধন প্রক্রিয়ায় প্রতিটি গ্রুপের সাথে থাকবে পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনী, পাকিস্তানী মিলিশিয়া বাহিনী, আল্ শামস্ তাদের সহযোগী কিছু বাহিনী। এই বাহিনীগুলো সন্ধ্যার পর আর্মি লরিতে করে অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে পড়বে এবং গণহত্যা শেষ করে তারা সকাল হওয়ার আগেই ইপিআর ক্যাম্পে ফিরে আসবে। তাদের হত্যার ছকের কথা এতোটাই গোপন ছিলো যে সার্কিট হাউজে অবস্থানকারী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকেই জানতো না। পাকিস্তানী বাহিনী রাতের খাবার শেষ করে অপারেশনে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ঠিক তখনই চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে বাঙালিদের পক্ষে আকাশে বিমান হামলা হলো। পাকিস্তান বাহিনী হঠাৎ বিমান আক্রমণে বিহ্বল হয়ে পড়ে। অবাঙালির ছেলেরা প্রথম দিকে মনে করেছিলো এগুলো পাকিস্তানী যুদ্ধবিমান পরে যখন বুঝলো মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ তখন তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে পালাতে শুরু করলো। মহান আল্লাহর রহমতে সে বিমান হামলা। যদি বিমান হামলা না হতো তাহলে সে রাতে হাজার হাজার বাঙালি হত্যার শিকার হতেন। ২৫ মার্চের রাতে ঘাতক বাহিনী যেমন করে ভারী অস্ত্র দিয়ে অসংখ্য বাঙালি হত্যা করেছিলো চট্টগ্রাম শহরেও এমন হত্যাকান্ডের ঘটনা আরো ঘটতো।
: ৬ ডিসেম্বর একরাতের যৌথ অপারেশন।
: শহর চট্টগ্রামে গেরিলা যোদ্ধারা যৌথ কমান্ড গঠন করেছিলেন। সিদ্ধান্ত হলো পাকিস্তানী বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা, জ্বালানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে হবে। তাই গেরিলা যোদ্ধারা ঠিক করলেন ৬ ডিসেম্বর রাতে শহর চট্টগ্রামকে পাকিস্তানী বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। সে জন্য সব গ্রুপের নেতারা বসে শহরকে কয়েক ভাগে ভাগ করে রেকি সম্পন্ন করলেন। রাত ১০ টা থেকে শেষ রাত পর্যন্ত পাকিস্তানীদের প্রতিটি সহযোগী স্থাপনায় আঘাত হানবে। পরে ঠিক হলো একই সময়ে এ আঘাত হানা হবে। রাত ১২.০১ মিনিটে গেরিলা যোদ্ধারা পূর্ব নির্ধারিত পাকিস্তানী ক্যাম্প, রাজাকার, আল্ বদর, আল্ শামস, মিলিশিয়া ক্যাম্প, পেট্রোল পাম্প, বিদ্যুৎ ট্রান্সফরমার বিষ্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলো বীর বাঙালির ছেলেরা। পুরো শহরে বিস্ফোরণের শব্দ, আগুনের শিখা জ্বলে উঠলো। প্রথম দিকে নগরবাসী আতংকিত হলেও পরে যখন স্বাধীন বাংলা বেতার ও আকাশবাণী বিস্তারিত জানালো তখন মানুষ আনন্দিত হলেন, সাহস সঞ্চয় করে পথে প্রান্তরে অবস্থান নিলেন। সেদিনের পরই শহরের পাকিস্তান বাহিনী চলাচল অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। অন্যদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা অঞ্চল ভিত্তিক প্রকাশ্যে আসতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের বেশির ভাগই অবস্থান করতেন গ্রামীণ জনপদে। রাজাকার, আল্ শামস্, আল্ বদরের সদস্যরা হাওয়ার সাথে মিশে যায়। পাকিস্তানী সৈন্যরা শুধু মিলিশিয়া বাহিনীকে তাদের আশ্রয়ে নিয়ে রাখে। এতোগুলো মাস এদেশের কিছু বাঙালি, অবাঙালি পাকিস্তানী বাহিনীর দোসর হিসেবে যারা বাঙালিদের সাথে বেঈমানী করেছে পাকিস্তানী বাহিনী বিভিন্ন ক্যাম্পে হত্যা করেছে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। ঘাতকদের দোসররা আর স্থান পায়নি তাদের কাছে। বেঈমানদের সাথে বেঈমানী করেছে পাকিস্তান বাহিনী। আল্ বদর, রাজাকার বাহিনী স্থান বদল করে রূপের বদল ঘটিয়ে নিজেদের আত্মীয় স্বজনের নিকট আশ্রয় নিয়ে তাৎক্ষণিক বেঁচে ছিলো। আবার অবাঙালির ছেলেরা কেউ কেউ পানির জাহাজে করে চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। কেউতো চলে যায় রংপুর, খালীসপুর সহ দেশের অবাঙালি প্রধান এলাকায়, পরে অবশ্য ১৬ ডিসেম্বরের পর ঐ অবাঙালি ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর নিরাপদ হেফাজতে ছিলো বিভিন্ন জেনেভা ক্যাম্পে।
: বিজয়ের প্রাক্কালে চট্টগ্রাম।
: বলা চলে ৬ ডিসেম্বরের পর থেকে মানুষ বিজয়ের গন্ধ পাচ্ছিলেন। কৌতূহলী মা বোনরা বাড়ি ছাদে বা রাস্তার মোড়ে মোড়ে জড়ো হয়ে দীর্ঘদিনের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তির স্বাদ পেতে থাকে। আকাশে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ বিমানের খেলা দেখে ভয়কে জয় করে নিয়েছে। কিশোর, তরুণ ও সমবয়সী পুরুষরা রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। সন্ধ্যার পর মানুষ স্বাধীন বাংলা বেতার শুনছেন, অপেক্ষা করছেন কখন বিজয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পাবেন। প্রচার মাধ্যমের বদৌলতে বাঙালিরা জেনে গেছে পাকিস্তানীরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। মুক্তি ও মিত্রবাহিনী জোর কদমে এগিয়ে আসছে। জয় বাংলা এবং জয় বাংলাদেশ ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। রাস্তা ঘাটে পাকিস্তানী বাহিনী নেই। নেই তাদের ঘাতক দোসরের দলগুলো। আনন্দে শিশুরা আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে দিয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো বিজয় পতাকা স্বাধীন বাংলার আকাশে। চট্টগ্রাম তখনো বিজয় থেকে দূরে। ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ পেলো চট্টগ্রাম।
: বিজয়ের মঞ্চেও ক্রন্দনের আহাজারি।
: হারিয়ে যাওয়া সন্তানের জন্য মা-বাবারা মুক্তি ক্যাম্পে জড়ো হয়েছেন, স্বজন হারানো মানুষের সংখ্যা বাড়ছে তো বাড়ছেই। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে স্বজন হারানো পরিবারগুলোর মিছিল দেখে বুঝা গেলো ঘাতক বাহিনী কতো হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা করেছে। অসংখ্য মা-বোনদের ইজ্জত নিয়েছে। যুদ্ধের ৯ মাস এমন করুণ তথ্য সামান্য পাওয়া গেলেও বড় সংখ্যক তথ্য এখন বেরিয়ে আসছে। মুক্তিযোদ্ধারা জেল থেকে অসংখ্য বাঙালিদের উদ্ধার করে এনেছে। নির্যাতন কেন্দ্র থেকে অনেক মা-বোনকে উদ্ধার করেছে। সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে অসংখ্য বধ্যভূমির। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অন্তত: ৩ লক্ষ বাঙালির সন্ধান তখনো পাওয়া যায়নি। এতো আনন্দের মধ্যেও বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিলো শহর চট্টগ্রামের।
জয় আমাদের হয়েছে, বিজয় আমরা পেয়েছি কিন্তু অসংখ্য মানুষ যারা শহীদ হয়েছেন বা নির্যাতনের শিকার হয়ে জীবমৃত হয়ে পড়েছিলেন নির্যাতনের শিকার হওয়া মা-বোনরা সম্মানের চাইতে অসম্মান হয়েছেন বেশি। পরাজিত সেই মানুষরা এখনো নখরের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করছে বিজয়ের জয় বাংলাদেশকে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট