যাঁদের রক্তের কাছে ঋণী স্বদেশ

সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার | সোমবার , ১৪ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এদিন আমরা দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী বরেণ্য সন্তানকে হারিয়েছি। তাই এদিন এলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করে আমাদের জাতির হৃদয় বিশেষভাবে দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনাতেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। এই গণহত্যার পাশাপাশি তারা দেশকে মেধাশূন্য করার লক্ষে সারাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যায় তৎপর হয়।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এদেশে তাদের দোসরদের সাথে নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘৃণ্য তৎপরতা চালায়। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বর্বর আক্রমণের সূচনা করে। ঐ রাতেই তারা পিলখানা ও রাজারবাগসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাস, অধ্যাপক বুদ্ধিজীবীদের বাসগৃহের ওপর নৃশংস আক্রমণ চালায়। এরপর দীর্ঘ নয় মাস সমগ্র দেশে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবী সহ লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে। তারা দেশকে শ্মশান বানিয়ে নিজেদের দখলে আনার জন্যে এ ঘৃণ্য গণহত্যায় মেতে উঠেছিলো। প্রচণ্ড সাহসিকতার সাথে বাঙালি জাতি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো মুক্তিযুদ্ধে। বাঙালি জাতির তীব্র বাধার সম্মুখীন হয়ে পাকহানাদার প্রমাদ গুণলো। তারা বুঝতে পারলো শিবির গুটিয়ে তাদেরকে এদেশ থেকে পালাতে হবে।পরাজয় অবশ্যম্ভাবী দেখে তারা শুরু করে নতুন এক চক্রান্ত। তারা তাদের এদেশীয় দোসরদের সাহায্য নিয়ে প্রণয়ন করে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী একথা ভালোই জানতো, বুদ্ধিজীবীরা একটি জাতির মেরুদণ্ড। তাদের মেধা বুদ্ধি জাতির বিবেক জাগ্রত করে। কোনও জাতির স্বাধীনতার চেতনাকে জাগাতে সাধারণত বুদ্ধিজীবীরাই প্রথম সোচ্চার হন। তাই বাঙালি জাতিকে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্যে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের প্রাক্কালে ঢালাওভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু করে। নির্মম নিষ্ঠুর ভাবে হানাদার বাহিনী আমাদের বুদ্ধিজীবী সন্তাদের ধরে বাড়ি থেকে দূরে নিয়ে বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করে। তারা সবচেয়ে বৃহৎ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড চালায় যুদ্ধকালীন সময়ে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। তাই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিহত সকল বুদ্ধিজীবীদের স্মরণের জন্যে এ দিনকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঢাকার রায়ের বাজার বধ্যভূমি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বধ্যভূমি এবং খুলনার গল্লামারি বধ্যভূমিতে যেভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যার মহোৎসবে মেতে উঠেছিলো তা ভাবলে সুস্থ মানুষের বিবেক কেঁপে ওঠে। তারা বুদ্ধিজীবীদের হাত পা চোখ বেঁধে গুলি করে, কুপিয়ে, বেয়নেটের খোঁচা দিয়ে বিভিন্ন পৈশাচিক কায়দায় তাদের হত্যা করে। এরূপ বুদ্ধিজীবী হত্যা বিশ্বে নজীরবিহীন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড.গোবিন্দ চন্দ্র দেবকে হানাদাররা তাদের এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় বাসা থেকে জোরপূর্বক বের করে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তারা হত্যা করেছে পরিসংখ্যান বিভাগের ড. মুনিরুজ্জামান, ইংরেজি বিভাগের ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা,মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের ড. ফজলুর রহমান খান, ইতিহাস বিভাগের ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ভূতত্ত্ব বিভাগের ড.আবদুল মোকতাদির, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউশনের এম এ ফয়জুল প্রমুখ অনেক কৃতী শিক্ষাবিদকে। এভাবে যুদ্ধকালীন বিভিন্ন সময় এবং ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী আরও যে-সব বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে তাঁদের মধ্যে আছেন, ড.মুনীর চৌধুরী, নিজামউদ্দীন আহমদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজউদ্দিন হোসেন, আনোয়ার পাশা, ড.আলীম চৌধুরী, গোলাম রহমান, সেলিনা পারভীন, ড. মো. ফজলে রাব্বী, আ.ন.ম গোলাম মোস্তফা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, নতুন চন্দ্র সিংহ, রাশীদুল হাসান, মোঃ মুরতাজা, আর পি সাহা, ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত, কবি মেহেরুন্নেছা,লুৎফুন নাহার,মীর আবদুল কাইয়ুম,প্রফুল্ল কুমার বিশ্বাস, আলতাফ মাহমুদ প্রমুখ শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক,লেখক,শিল্পী, সাংবাদিক ব্যক্তিবর্গ। এদেশে স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের সহযোগিতায় পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যরা সারাদেশে এভাবে বহু সংখ্যক বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছিলো। হত্যাকান্ডে নিহত বুদ্ধিজীবীদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা দেশ স্বাধীন হওয়ার এ দীর্ঘ সময় পরও পাওয়া যায়নি। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে ২৪৬ জনের নাম উল্লেখিত আছে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত এক গ্রন্থে শহীদ বুদ্ধিজীবী সংখ্যা দেখানো হয় ১০০৯ জন। অনেকের মতে সারাদেশে নিহত বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা দু’হাজার ছাড়িয়ে যাবে। দুঃখের বিষয় এখনো শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক তালিকা প্রস্তুতের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দেশের স্বাধীনতার জন্যে বুদ্ধিজীবীদের আত্মদান যদি সঠিকভাবে মূল্যায়িত না হয় তাহলে নব প্রজন্ম কর্তৃক আমাদেরকে হতে হবে ধিক্কৃত। ইউনিয়ন পরিষদ ইত্যাদি স্থানীয় সরকার, বিভিন্ন সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে সরকার উদ্যোগ নিলে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রকাশ সরকারের জন্যে সহজ হবে। আশা করি সরকার এব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন।
পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে এমন সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যা সংঘটিত হয়েছে কিনা সন্দেহ। পাকিস্তানী হানাদার কর্তৃক অসংখ্য বুদ্ধিজীবী ও লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ হত্যা এদেশেও সম্ভব হতোনা যদি দেশের স্বাধীনতা বিরোধী চক্র তাদের সহযোগিতা না করতো।
আজ লক্ষ লক্ষ সাধারণ শহীদ ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জীবনের বিনিময়ে আমরা দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। তাঁরা দেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রতিনিয়ত শ্রদ্ধা জানাতে হবে শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ সব শহীদের বিদেহী আত্মার প্রতি এবং সেই সাথে তাঁদের আত্মার শান্তির জন্যে আমাদেরকে করতে হবে দেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ রক্ষা করার মহান অঙ্গীকার।
লেখক: প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাম্প্রতিক চট্রগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি
পরবর্তী নিবন্ধশীতকালে বসন্ত বিকেল!