চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক লাইব্রেরী-অফিসার লোকসাহিত্য ও প্রাচীন সাহিত্য সংগ্রাহক ও গবেষক ইসহাক চৌধুরী আর নেই সংবাদটা পেলাম আকস্মিক ভাবে। আমাকে কে যেন শোক ভারাক্রান্তভাবে খবরটা জানালেন মনে করতে পারছি না। কিন্তু আমারও হঠাৎ পাওয়া অবিশ্বাস্য সংবাদটি বিশ্বাস করা এবং সহ্য করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠলো।
সেদিন ছিল ২০ সালের নভেম্বরের ৪র্থ সোমবার অর্থাৎ ২৩ তারিখ। ঐ দিন তিনি ‘নগরীর একটি হাসপাতাল’ থেকেই চলে গেলেন। গবেষকরা সাধারণত এমনি অবহেলার মধ্য দিয়েই বিদায় নেন। তাই পরদিন চট্টগ্রামের সবগুলি দৈনিকে এই সংবাদ যেমন সাধারণ তেমনি প্রধান হয়ে উঠবে, অতটা ভাবি নি। বন্ধু প্যাথলজিস্ট ও লেখক ক্ষণরঞ্জণ রায় আমাকে (ঢাকায়) চট্টগ্রামের ৪/৫টা পত্রিকা পাঠালেন, তাতেই বিষয়টা স্পষ্ট হলো, বুঝলাম চট্টগ্রাম ভোলে নি তাঁকে । এ কথা বলার কারণ তিনি ছিলেন নীরব সাধক, নিভৃত গবেষক, শান্ত, ধীর, অপ্রকাশী স্বভাব এবং নির্লোভ মানুষ। সম্মান পাওয়ার জন্য আদৌ প্রত্যাশী হতেন না। প্রচুর মূল্যবান কাজ থাকা সত্ত্বেও খুব সাধারণভাবে থাকতেন, তাঁকে দেখে বোঝা যেত না তিনি কত নিবিষ্ট গবেষক, সে কথা কাউকে বলারও প্রয়োজন মনে করতেন না ; যাকে বলা চলে লো-প্রোফাইলে থাকা, তিনি সে ভাবেই থাকতেন বা চলতেন। ভিড়ের মাঝে তাঁকে কখনওই পাওয়া যেত না। অথচ কোনও সভায় তাঁর উপস্থিতি সভাকে উজ্জ্বল করতো। সুধীবর্গ তাতে আনন্দিত হতেন। যে কোনও তথ্যের জন্য তিনি হতেন তাৎক্ষণিক রেফারেন্স-বুক, বিশেষত মধ্যযুগ বা লোকসাহিত্য কিংবা লোকজ কবি বা সাহিত্য এবং প্রাচীন বা লোকধর্মী কোনও শব্দ সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর অধিকার ছিল ঈর্ষণীয়। স্থানীয় অনেক লোক-কবিকেও তিনি যথার্থ চিহ্নিত করে গেছেন। আস্কর আলী পণ্ডিতকে তিনি না হলে এভাবে তাঁর মূল্যায়ন হতো কি না সন্দেহ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (জধৎব ঝবপঃরড়হ) বিভাগটি তাঁর তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হয়েছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথি সংগ্রহের বৃত্তান্ত এবং পুঁথির তালিকাটি তাঁর উপস্থিতির কারণেই লিপিবদ্ধ করা ও প্রকাশ করা সহজ হয়। যে কোনও বিভাগের গবেষকদের তিনি প্রয়োজন মত সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। রিসার্চ পেপারের জন্য ছাত্রদেরও তিনি সাহায্য করতেন। তিনি হতেন তাদের নির্ভয়-দাতা। এ ছাড়া ঐ বিভাগে বসে আমার সামনেই দেখেছি অধ্যাপক (পরে উপাচার্য) ড. আবু ইউসুফ আলম, অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক প্রমুখ ছাড়াও আরও অনেককে গবেষণা করতে, সেটা অতিরিক্ত হিসাবে তাঁর সহযোগিতা ছিল বলেই। আমার এও মনে হয় যে, প্রয়াত উপাচার্য ঐতিহাসিক অধ্যাপক আবদুল করিম এবং তাঁর দেখাদেখি অধ্যাপক ভুঁইয়া ইকবাল, আমি এবং আরও কেউ কেউ তাঁদের মূল্যবান সংগ্রহ এই বিভাগে দান করে ছিলেন, অবশ্যই তার একটি কারণ বিভাগটিতে এই দায়িত্বশীল ব্যক্তিটি গবেষকদের ব্যবহার উপযোগী করে বইগুলি সাজিয়ে রাখতেন এবং যত্ন নিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। এ সব কারণে তাঁর অবসর গ্রহণের পরেও আরও কিছুদিনের জন্য তাই তাঁকে চাকরিতে ‘এঙটেনশন’ দিয়ে রাখা হয়েছিল সম্মানের সাথে।
পত্র পত্রিকায় তাঁর বিয়োগ তথ্যটি পরিবেশিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীর বিশেষ গবেষণা কক্ষটি বা বিরল গ্রন্থ বিভাগের (‘রেয়ার সেকশন’) অতীত ও বর্তমান গবেষকেরা মুহূর্তে স্তব্ধ, হতবাক এবং অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলেন। ফেসবুকে মুহূর্তে চারিদিকে ছড়িয়ে গেল খবরটা। বাংলা বিভাগের প্রধান কবি-সাহিত্যিক মহীবুল আজিজ খবরটি প্রকাশের দায়িত্ব নিলেন। মাত্র ৬৮ বৎসর বয়সে তাঁর এই অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত তিরোধান আমাদের, বিশেষত চট্টগ্রামের গবেষণা জগতে একটা কালো পর্দা টেনে দিল। সবারই মনে হলো তাত্ত্বিক গবেষক অনেকেই আছে, এখন লোকজ সম্পদের মাঠভিত্তিক তথ্য সংগ্রহের ও পাঠোদ্ধারের লোক পাওয়া কঠিন হয়ে উঠবে। ইসহাক চৌধুরী ছিলেন সেই শেষ গবেষক। তাঁর সেই সরল আন্তরিকতা ও গভীর অভিনিবেশ এবং মমতা আর কারও মাঝে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। বাংলা একাডেমিতে চট্টগ্রামের ৪১টি লোকগীতির টেক্স্ট অনালোচিতভাবে পড়ে আছে এ কথা তাঁকে কতদিন দু:খের সাথে বলতে শুনেছি। বহু গবেষণা তিনি আরব্ধ, অসমাপ্ত ও অপ্রকাশিত রেখে গেছেন । তিনি চলে গেলেন অকালে এবং আকস্মিকভাবে।
তাঁর নামের বানান আমি দুই ভাবেই পেয়েছি- স এবং ছ দিয়ে। চট্টগ্রামে সাধারণত তালব্য (চ/ছ) অক্ষরই অধিক ব্যবহৃত হয়। যেমন আবদুচ সালাম বা আবদুস ছালাম প্রভৃতি। যাই হোক, ইছহাক এবং ইসহাক চৌধুরী দুই নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। মৃত্যুৎকালে তার বয়স পত্রপত্রিকায় ৭১ বলা হলেও আমার ‘লোকসাহিত্যের ভিতর ও বাহির’ গ্রন্থ অনুযায়ী অর্থাৎ আমাকে তিনি যা বলেছিলেন, সেই মোতাবেক তাঁর জন্ম হয় ১৯৫২ সনের জুন মাসের কোনও এক দিন। সেই হিসাবে তাঁর বয়স হয় ৬৮ মাত্র। আমার ঐ গ্রন্থে আমি তাঁর পিতা পুঁথিসংগ্রাহক আবদুস সাত্তার চৌধুরী (১৯১৯-১৯৮২) সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বুঝতে পারি ‘লাইক ফাদার লাইক সান’-ই শুধু নন, অর্থাৎ ইসহাক সাহেব শুধু পুঁথি উদ্ধারেই আবদ্ধ থাকেন নি, প্রাচীন সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও প্রবেশ করেছেন। আমি সে জন্য পিতাপুত্র উভয়কে নিয়ে পাশাপাশি আলোচনায় রেখেছিলাম। সেই আলোচনাটি (পুত্রের অংশ) ছিল নিম্নরূপ :
“ [আবদুস সাত্তার চৌধুরীর সুযোগ্য পুত্র মুহম্মদ ইসহাক চৌধুরী (জন্ম : পটিয়ার হুলাইন, জুন ১৯৫২) পিতার লোকসাহিত্য-প্রীতি, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের সাধনাতেই নিজেকে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছেন। একটি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক হিসাবে জীবন শুরু করেও তিনি চট্টগ্রামের অঞ্চলে অঞ্চলে মাঠে মাঠে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন হারানো মাণিক বা অবলুপ্তপ্রায় সম্পদের নষ্টোদ্ধারে। এই সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যাদুঘরে ও গ্রন্থাগারে প্রাচীন পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি ছাড়াও বহু পুরাকীর্তি সংগ্রহ করে দেন তিনি, তন্মধ্যে ফতেহাবাদস্থ ফকিরতাকিয়া থেকে প্রাপ্ত (তাঁর আবিষ্কৃত) সম্রাট আওরঙ্গজেবের নামাঙ্কিত একটি মধ্যযুগীয় শিলালিপি বিশেষ উল্লেখ্য।
জনাব ইসহাক এ যাবৎ প্রায় দু’ হাজার পুঁথির পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেন । তিনি বাংলা ভাষা ভিন্ন দ্বিভাষী পুঁথিও সংগ্রহ করেন প্রায় ৫০০ (পাঁচ শত)। এগুলোর কিছু কিছু এখনও বিভিন্ন নামী ব্যক্তিদের কাছেই জমা পড়ে আছে। আর কিছু পটিয়াতে তাঁর পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত একটি সংগ্রহ-শালাতে এখন শোভমান। এই সব পুঁথির রচনাকাল ষোড়শ শতক থেকে পরবর্তী কয়েক শতক। একবার উপরে উল্লিখিত ক্ষণরঞ্জন বাবু সপরিবারে ইসহাক চৌধুরীর পটিয়ার বাসায় গেলে তাঁর সাথের স্ত্রী-কন্যারা পুরনো পুথিও তাতে এই বিচিত্র হাতের লেখা দেখে বিস্ময়ে আমাদের জিজ্ঞেস করেছিল এগুলি সত্যি হাতের লেখা কি না।
পাণ্ডুলিপি এবং সেই সাথে সাথে প্রাচীন কিছু দুর্বোধ্য ও মূল্যবান দলিলের পাঠোদ্ধার জনাব ইসহাক-এর অপর কীর্তি। এ সবের ভিত্তিতে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা তাঁর অগ্রন্থিত প্রবন্ধসংখ্যা দুই শতাধিক।” (লোক সাহিত্যের ভিতর ও বাহির, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০২০ : ১৬৩ পৃষ্ঠা) তাঁর বিদায়ের মাত্র এক সপ্তাহ আগে ফোনে তাঁর সাম্প্রতিক কাজের কথা নিয়ে আমাদের মাঝে কথা হয়েছিল। আমিও জিজ্ঞেস করে ছিলাম আমার কিছু সমস্যার কথা। তিনি তাৎক্ষণিকভাবেই তার সমাধান দিয়েছিলেন। আমার ‘চট্টগ্রামের উপভাষা’ রচনা কালে তিনি এই ্উপভাষা বিষয়ে অনেক না জানার বিষয় আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছিলেন, তাই গ্রন্থের পরিশিষ্টে কৃতজ্ঞতার সাথে তাঁর নাম যুক্ত করতে আমি দ্বিধা করেনি।
আমার মনে প’ড়ে কষ্ট হয়, তিনি বহুবার আমাকে তাঁর পিতার আবিষ্কৃত চট্টগ্রামের গীতিকাগুলি নিয়ে কাজ করতে বলতেন। কিন্তু সেগুলি হাতের কাছে না থাকায় এবং বাংলা একাডেমি থেকে সেগুলি পুনরাবিষ্কার করার সময় আমার হাতে না থাকায় আমি তাঁর কথা রাখতে পারি নি। আমাকে প্রয়োজনীয় সমস্ত সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও। আমি অনেক কষ্ট করে ‘মৌলানা মনিরুজ্জমান এসলামাবাদী রচনাবলী-১ম খণ্ড’(১৯৯৩) প্রকাশ করলে তিনি মৌলানা এসলামাবাদীর আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কাগজপত্র (তাঁর এতদবিষয়ক দুর্লভ প্রবন্ধটি সহ) আমাকে সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ও রচনাদি এসলামাবাদী পরিবারের থেকে বাংলা একাডেমিতে চলে যাওয়ায় এবং সেখান থেকে প্রতিশ্রুতি পাওয়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তা উদ্ধার করতে না পারায় আমার পক্ষে এ বিষয়ে আর গবেষণা করা সম্ভব হয় নি। এ জন্যও ইসহাক সাহেব দু:খ করতেন। আমার চেয়ে তাঁরই আফসোস ছিল বেশি। লোক সাহিত্য নিয়েও আমার আরও কাজ করার কথা বলতেন তিনি, যেমন বলতেন বরুণ দা (লোকবিদ অধ্যাপক বরুণকুমার চক্রবর্তী)। ইসহাক সাহেব বলতেন, পুঁথি আমার প্রথম প্রিয় বিষয়, কিন্তু লোক-বিষয় তা থেকে তো দূরের নয়। আপনাকেও দেখেছি ‘বাংলাদেশে লোকসংস্কৃতি সন্ধান’(১৯৮২) গ্রন্থে গ্রাম্য ও ঐতিহ্যিক বিষয়গুলির সাথে পুঁথি ও পাণ্ডুলিপির মত বিষয়ও গ্রহণ করেছেন। এই পঞ্জির মূল্য একদিন লোকে বুঝবে। এটাকে আপডেট করা যায় কিনা সে বিষয়ে তিনি ভাবতে বলতেন আমাকে।
তিনি মজা করে বলতেন, সাহিত্যচিন্তা মানুষের মৌলিক চিন্তা। এটা লোকজীবনের প্রথম যাত্রা। প্রমথ চৌধুরী যেমন বলতেন কলম থেকে কথা আসে না, কথা থেকে কলমে আসে । তেমনি যত বেদ আর আবেস্তাই সৃষ্টি হোক. মাটি আর মানুষ ছাড়া তার মূল্য কই ? ঐ যে ‘অথর্ব’ কথাটা বেদের সাথে যোগ হল, সেও কিন্তু সেকেলে আর নড়বড়ে অর্থ ধরেই। অনেক দ্বিবেদী, ত্রিবেদী দেখেছি, চতুর্বেদী প্রায় নেই। এর কারণ ‘অথর্ব বেদে’ যা আছে, ‘ঋক-সাম-যজ’ুতে তা স্বীকার করা হয় না। কারণ আমরা কথায় কথায় যেমন বলি একটা আস্ত অথর্ব সেই ‘অথর্ব’ বেদেই আছে সেই অথর্ব মাটি ও মাটির জীবনের রহস্য কথা। অন্য বেদে যেখানে শুধু স্বর্গের কথা, স্বর্গের মহিমা কীর্তন। তিনি বোঝাতে চাইলেন, লোকজীবন ও লোক-মাহাত্ম্যের কথা এবং যা সহজিয়া দর্শনের কথা তা আমরা পেয়েছি এই সূত্রেই। এই দর্শন পরে মৃন্ময় চিন্তার প্রশ্রয়ে, অনেকের ধারণা সুফিবাদ, বাউলিয়া-ভাবের চিন্তন প্রভাবে লোকায়ত দর্শনে রূপ পায়। সেটাই মানবপন্থী চিন্তাধারা, যা শাস্ত্রীয় চিন্তা ও আদর্শ থেকে পৃথক হয়ে গড়ে ওঠে । লোক সাহিত্যই বলুন, আর বাতেনী ধারার প্রকাশই বলুন,- সেই মূল কথার বা শেকড়ের কথাই তার লক্ষ্য। অন্তরেরও, দেহের আবরণ বা লালনের ‘খাঁচা’রও কথামূল হচ্ছে এটাই। ‘মনের মানুষ’ কিংবা ‘পড়শী’-তত্ত্বও বলতে পারেন এটাকে। ঠিক এই বাক্যগুলি না হলেও এই কথাগুলিই ছিল তাঁর মূল বক্তব্য। আমি ‘প্যারালেল- লাইফ’-এর কথা বললে তিনি বলেন প্রতিবিম্ব আর সমান্তরালে তো তা এক হয় না। পরে বললেন, আমি পুঁথি থেকে লোক-বাচনে এসেছি। আপনি বুঝবেন ভাষা কখনও একরূপী নয়। তার মৌখিক রূপ বহুরূপী, পুঁিথ তার একটা লৈখরূপ।
ইসহাক সাহেব আমাকে একাধিকবার তাঁর গ্রামের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে গেছেন । কখনও তাঁর সংগৃহীত পুঁথির প্রদর্শনীতে, সেখানে তখন পটিয়ার মান্যগণ্য ব্যক্তিরাও আসতেন, এমনকি পটিয়ার মেয়রও। তিনি তাঁদের কাছে ব্যর্থ আবেদন জানাতেন তাঁর সংগ্রহশালার আংশিক হলেও দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। কখনও এমনি আলোচনার জন্যও আমাকে ডাকতেন। তখনই অন্তরঙ্গভাবে লিখিত এবং মৌখিক সৃষ্টিকলা নিয়ে তাঁর সাথে আমার দীর্ঘ আলোচনা হতো। তাতে আমিই উপকৃত হতাম বেশি। তারই সামান্য স্মৃতিচারণ আমার ওপরের কথাগুলো। তিনি যখন বলতেন অনেক গুরুত্ব দিয়েই কথা বলতেন। বেশিরভাগ সময়ই আমি কেবল শ্রোতার ভূমিকায়ই থাকতাম। আমি বলতাম, আপনি এসব কথা নিয়ে তো লিখতে পারেন। তিনি দু:খ করে জানাতেন, ‘আমি আমার মূল কাজেই এখনও হাত দিতে পারি নি। জীবন তো আর দুটো নয়। সময়ও ইচ্ছা করলে বাড়াতেও পারি না।’ হায়, তাঁর সময়টা ট্রাঙ্কেটেড হয়ে গেল তাঁর শেষ লেখা সমাপ্ত হবার আগেই।
২০০৮ সালে অবসর নেবার পর আমি ২০১২ সালের দিকে তাঁর আন্তরিক আবেদনে গেলাম হুলাইনে তাঁর মাটির বাড়িতে। সাথে ভ্রমণ সাথী হলেন বন্ধুবর ক্ষণরঞ্জন বাবুর পরিবারও। তিনি সেবার আমাদের নিয়ে পটিয়ার কয়েকটি জায়গা ঘুরিয়ে দেখালেন এবং আমরা যে যাচ্ছি সে খবরও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যথা যথা স্থানে । ফলে আমাদের কোথাও কোনও অসুবিধা হয় নি। আমরা প্রথমে গেলাম প্রীতিলতা কমপ্লেক্স ট্রাস্টের অধিকর্তা শ্রী পঙ্কজ চক্রবর্তী আমাদের যথেষ্ট সমাদর করে আপ্যায়নেরও ব্যবস্থা করলেন। শুনলাম কমপ্লেক্সের সামনের রাস্তা যেটা পটিয়া শহরে ঢুকেছে,তার নামকরণ করা হয়েছে প্রীতিলতার নামেই। সেখান থেকে আমরা গেলাম পটিয়া থেকে আরও ৬ কিমি দূরে আমির ভাণ্ডার শরীফে। সেদিন শুক্রবার ছিল বলে নূরে মওলার রওজার প্রবেশদ্বার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইসহাক সাহেবের পরিচয় পেয়ে সেটা আবার খোলা হলে আমরা ভিতরে যাওয়ার অনুমতি পাই। পরে প্রধান মোতাওল্লি সাহেব আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর দরবারে। আমাদের ফল এবং তোবারকও খেতে দিলেন। আমাদের নিয়ে দোয়া পড়লেন। ইসহাক সাহেবের কদরটা সেখানে উপলব্ধি করে আমরাও সম্মানিত বোধ করলাম। আমরা তো অপরিচিত, কিন্তু ইসহাক সাহেবের অতিথি হিসাবে আমরা প্রাপ্য সম্মানের অধিক সম্মান লাভ করলাম। সমাজে তাঁর অবস্থান লক্ষ্য করে বুঝলাম এটা খুব সহজ অর্জন নয়।
আমরা সেখান থেকে গেলাম আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও আহমদ শরীফের পৈত্রিক বাড়িতে। এটা শহরের এক প্রান্তে, কিন্তু অল্প দূরেই অবস্থিত। মাঝামাঝি দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে ঐ বাড়ি বা গ্রামের দিকে। গ্রামটার নাম সুচক্রদণ্ডী। শহরের এত কাছে হলেও শহরের সাথে বাড়িটার কোনও যোগাযোগ আছে বলে মনে হলো না। বাড়িতে সাহিত্য বিশারদের কিছু জিনিষপত্র, সম্মাননার চিহ্নায়ক এবং সংগৃহীত কিছু বইপত্র এখনও দেখা যায়। তবে এগুলি রক্ষণাবেক্ষণের তেমন কোনও সুব্যবস্থা নেই। অদূরে এক পুকুর পাড়ে পারিবারিক কবরস্থানে সাহিত্যবিশারদের কবরটা পাকা করা হলেও একটা ঘেরের ভেতরেই অন্যান্য কবরের সাথে তাঁকে রাখা হয়েছে। পাশের মসজিদে জুম্মা আদায় করে কবর জিয়ারত শেষে ফেরার উদ্যোগ নিলে বাড়ির মুরুব্বীরা মিনতি করে আমাদের আবার বাংলা ঘরে নিয়ে গেলেন। এই ঘরের প্রবেশদ্বারের ওপর সাহিত্যবিশারদের নামটা সুন্দরভাবে লেখা আছে দেখলাম। ঘরের ভেতরে মাটির দেয়ালে তাঁদের দুটো ছবিও দেখলাম। ইসহাক সাহেবের সাথে বাড়ির কর্তাদের অনেকক্ষণ কথা হলো। বুঝলাম কিছু সমস্যার কথাই তাঁরা আলোচনা করছিলেন। আপ্যায়নের জন্য পীড়াপীড়ি হচ্ছিল, আমরা বোঝাতে চাইলাম যে আপ্যায়ন চেয়েছিলাম তার অভাব দেখে আমরা মর্মাহত হয়েছি। একজন বল্লেন, ইসহাক ভাইকে জিজ্ঞেস করুন, ডিসির কাছে, সরকারের কাছে আমরা কত আবেদন করেছি। ইসহাক সাহেব শুধু বললেন, আপনারা তো বাইরের লোককে বিশ্বাস করেন না, আপনারাও কোনও পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে পারেন না। তাহলে হবে কি করে? এঁরা আজকে আমার অতিথি, এঁরা এখন আমার বাসায় যাবেন। ভবিষ্যতে কোনও অনুষ্ঠানাদি হলে তখন দেখা যাবে। এখন অনুমতি দিন, আমরা উঠি। সাহিত্যবিশারদের জন্য দু:খ এবং ইসহাক সাহেবের গ্রাম সংযোগের স্মৃতি আমাদের মনেই রয়ে গেল। আজ ইসহাক চৌধুরীও নেই। মূল্য দেবার লোকের অভাবে এই সব কৃতীমানদের কথা হয়তো শুধু কিংবদন্তী হয়েই থাকবে।