বর্তমান বিশ্বে নারীবাদ একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী দার্শনিক মতবাদ। পাশ্চাত্যে এই মতবাদের উদ্ভব। নারীবাদ হলো একটি আন্দোলন যা পুরুষের মত নারীর সমান অধিকারের দাবি করে। সিমোন দ্যা বুভোয়ার, মেরিডেলি,শুলামিথ,ফায়ারস্টোন,কেটমিলেট প্রমুখ নারীবাদী আন্দোলনের নেত্রী। ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমনের সাথে সাথে পাশ্চাত্যের নানা জ্ঞান-চিন্তা এদেশে প্রবেশ করে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত আধুনিকমানুষ রামমোহন থেকে শুরু করে বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র, সরলা দেবী, রমাবাঈ, রোকেয়ার মত মানুষেরা নারীর অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হন। সারা বিশ্বে আজো নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে বিভিন্ন নারী আন্দোলনের কর্মীরা লড়াই করছে। আজকের সময়ে আমরা দেখি শিরীন এবাদী, মালালা ইউসূফ জাই প্রমুখ নারীবাদী নেত্রী নারীর অধিকার বিষয়ে সোচ্চার। আজকের নিবন্ধে রোকেয়ার নারীবাদী চিন্তা আলোচনার পূর্বে নারীবাদ বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা দরকার। ফরাসী শব্দ Femmenisme থেকে Femme অর্থ নারী, রং সব অর্থ মতবাদ। অর্থাৎ Feminism অর্থ নারীবাদ। নারীবাদ হলো পরিবার, কর্মক্ষেত্র, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর প্রতি সকল প্রকার শোষণ নিপীড়ন সম্বন্ধে সচেতনতা এবং এ অবস্থা বদলের লক্ষ্যে নারী (পুরুষের) সচেতন প্রয়াস। ১৭৭২ সালে ইংরেজ লেখিকা Mary Wollstone তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ “A vindication of the Rights of Women” প্রকাশ করেন। বইটিকে নারীবাদের ইশতেহার বলা হয়। যাতে নারীর অধিকার এবং স্ব্বাধীনতার ঘোষণা করা হয়। মেরীর পরবর্তী সময়ে নারীর প্রতি শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে এবং নারীর অধিকার আদায়ে দেশে দেশে নারী আন্দোলন সংঘঠিত হয়। নারীবাদী আন্দোলনে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের প্রেক্ষিতে আজকের নারীবাদী আন্দোলনকে ৪টি তরঙ্গ দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়। যেমন-
প্রথম তরঙ্গ (১৯০০-১৯৫৯): এ সময়ের প্রধান দাবি নারীদের ভোটাধিকার এবং সম্পত্তির অধিকার।
দ্বিতীয় তরঙ্গ (১৯৬০-১৯৮০): এ সময়ের প্রধান দাবি পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ।
তৃতীয় তরঙ্গ (১৯৯০-১৯৮০): এ সময়ের প্রধান দাবি ব্যক্তিস্ব্বাতন্ত্র ও বৈচিত্র্যকে আলিঙ্গন।
চতুর্থ তরঙ্গ (২০০০-বর্তমান): এ সময়ের প্রধান দাবি যৌন হয়রানি, নারী বিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। নারীমুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে পাশ্চাতে যে আন্দোলনের সূচনা তা আজ উগ্র ব্যক্তি স্বধীনতার রূপ নিয়েছে। আজকের নারীবাদ তাই নারীর পরাধীনতার জন দায়ী করছে পুরুষতন্ত্রকে। কিন্তু যে ঐতিহাসিক কারণে নারী পুরুষের অধীনস্থ হয়েছিল, বিজ্ঞানসম্মতভাবে তা বিশ্লেষণ করে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে নারী পুরুষের বৈষম্য তথা শোষণ মুক্তির লড়াই যদি করা না হয় তাহলে সত্যিকার অর্থে নারীমুক্তি সম্ভব নয়। রোকেয়ার নারীবাদী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাঁর লিখিত নানা প্রবন্ধে বিশেষকরে মতিচূর, সুলতানার স্ব্বপ্ন এবং পদ্মরাগ উপন্যাসে। রোকেয়া তাঁর গ্রন্থসমূহে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার নারীর অধঃস্তন অবস্থার পাশাপাশি দেখিয়েছেন অবরোধ প্রথার কঠোরতা। নারী পুরুষের সমান অধিকারের যে বার্তা উক্ত গ্রন্থসমূহে তিনি লিখেছেন তা অনেকের কাছে তাঁর নারীবাদী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। রোকেয়া যখন পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনের দাবি জানান তৎকালীন সমাজে এধারণা ছিল অভিনব। তিনি বলেছেন পুরুষের সমকক্ষতা লাভেরজন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয় তাহাই করিব। … আবশ্যক হইলে আমরা লেডি কেরাণী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডি ম্যাজিষ্ট্রেট, লেডি ব্যারিস্টার, লেডি জজ সবই হইব।” তৎকালীন সমাজের পুরুষ ও স্ত্রী শিক্ষার পার্থক্য দেখাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন-“স্বামী যখন কল্পনার সাহায্যে পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য প্রস্থ (সেলাইয়ের জন্য) মাপেন!” রোকেয়া নারীর এই পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে লিখেছেন- আমাদের শয়নকক্ষে যেমন সূর্যালোক প্রবেশ করে না, তদ্রুপ মনোকক্ষেও গগনের আলোক প্রবেশ করিতে পায় না। … বহুকাল হইতে নারী হৃদয়ের উচ্চবৃত্তিগুলি অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়ায় নারীর অন্তর, বাহির, মস্তিষ্ক, হৃদয় সবই ‘দাসীদ্ধ হইয়া পড়িয়াছে।”
দাসত্বে অভ্যাস হয়েছে বলে আজ দাসত্বের নিদর্শন বিশেষও নারীর প্রিয়। তিনি বলেছেন- আর এই যে আমাদের অতিপ্রিয় অলঙ্কারগুলি- এগুলি দাসত্বের নিদর্শন বিশেষ। এখন ইহা সৌন্দর্য বর্ধনের আশায় ব্যবহার করা হয় বটে, কিন্তু অনেক মান্যগণ্য ব্যক্তির মতে অলঙ্কার দাসত্বের নিদর্শন ছিল। …এই অলঙ্কারের জন্য ললনাকুলের কত আগ্রহ? যেন জীবনের সুখ সমৃদ্ধি উহারই উপর নির্ভর করে। তাই দরিদ্র কামিনীগণ স্বর্ণরৌপ্যের হাতকড়ী না পাইয়া কাঁচের চুড়ি পরিয়া দাসী-জীবন সার্থক করে। যে (বিধবা) চুড়ি পরিতে অধিকারিণী নহে, তাহার মতো হতভাগিনী যেন এই জগতে আর নাই । অভ্যাসের কি অপার মহিমা! দাসত্বে অভ্যাস হইয়াছে বলিয়াদাসত্ব সূচক গহনাও ভালো লাগে।” রোকেয়ার অন্যতম সৃষ্টি ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন,আধুনিক প্রযুক্তির ফলে নারী রান্নাঘর হতে রাষ্ট্র পরিচালনা সকল ক্ষেত্রে পারদর্শী। এই প্রবন্ধে ভগিনী সারার কদ্মে রোকেয়া বলেছেন,শারীরিক শক্তি নয় বুদ্ধিমত্তাই শ্রেষ্ঠ। তাই সিংহ মানুষের চেয়ে শক্তিশালী হলেও মানুষই সিংহকে পরিচালনা করে।
রোকেয়ার একমাত্র উপন্যাস ‘পদ্মরাগ’। উপন্যাসে তারিনীভবন পরিবারের মাধ্যমে সমাজে সকল শ্রেণিরনিপীড়িতনারীদের ঐক্যবদ্ধ করেছেন। যেখানে নারীরা শিক্ষিত, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী, কর্মবীর ও আত্মমর্যাদাশীল। নায়িকা সিদ্দিকাকে মানসচরিত্র তৈরি করে রোকেয়া বলেছেন- “তুই জীবন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হ! যাতে মুষ্টিমেয় অন্নের জন্য তোকে কোন দুরাচার পুরুষের গলগ্রহ না হইতে হয় আমি তোকে সেইরূপ শিক্ষা-দীক্ষা দিয়া প্রস্তুত করিব।” আন্তর্জাতিক নারীবাদের প্রশ্নে রোকেয়া সৃষ্টিকরেছেন ‘Murder of Delicia’ যেখানে তিনি দেখিয়েছেন, ইংরেজ শিক্ষিত নারী ডেলিশিয়া এবং ভারতবর্ষের নিরক্ষর নিপীড়িত নারীচরিত্র মজলুমাকে। অর্থাৎ পৃথিবীর সর্বত্রই নারী নিপীড়িত। পরিশেষে বলা যায়, ঊনিশ শতকে নারীর সমান অধিকারের প্রশ্নে বিশ্বব্যাপী যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার উত্তরসূরী হিসেবে রোকেয়ার অবদান অনস্ব্বীকার্য। রোকেয়ার চিন্তায়, কর্মে, লেখায় সর্বোপরি জীবন সাধনার অংশ হিসেবে নারীমুক্তিকে তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। কর্মে, দক্ষতায়, চিন্তায় কোন অংশে নারী পুরুষের চেয়ে নিকৃষ্ট নয়। এটি ছিল তাঁর চিন্তাদর্শন । আর এই চিন্তাদর্শনের প্রভাব আজ একবিংশ শতাব্দীর নারী আন্দোলনের এক প্রেরণা।