চট্টগ্রামে ব্যবহার্য প্রাকৃতিক গ্যাসের পুরোটা বর্তমানে আমদানিকৃত এলএনজি দিয়ে পূরণ করা হয়। আর আমদানিকৃত এসব গ্যাস বিক্রিতে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) দৈনিক ক্ষতি প্রায় পৌনে ৯ কোটি টাকা। এ ক্ষতির পুরোটাই ভর্তুকি হিসেবে দিচ্ছে সরকার। বর্তমানে এলএনজির মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে বছরের যেকোনো সময়ের চেয়ে কম হওয়ার কারণে ক্ষতির পরিমাণ কম হয়েছে উল্লেখ করে কর্ণফুলী গ্যাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজি দাম বাড়তির দিকে। দাম বাড়লে ক্ষতির পরিমাণও বাড়বে। বর্তমানে গড়ে দৈনিক ৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাচ্ছে কেজিডিসিএল।
জানা যায়, দেশে গ্যাসের সংকট কাটাতে এলএনজি আমদানি ও সারা দেশে সরবরাহের জন্য ৫ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) মাধ্যমে চারটি মেগা পাইপলাইন নির্মাণ করে পেট্রোবাংলা। পাশাপাশি আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহের জন্য সরকারি চুক্তির মাধ্যমে মহেশখালীতে দুটি এফএসআরইউ (এলএনজি মজুত ও পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর করার ভাসমান টার্মিনাল) নির্মাণ করে এক্সিলারেট এনার্জি ও সামিট এলএনজি টার্মিনাল কোম্পানি (প্রা.) লিমিটেড। টার্মিনাল দুটি থেকে দৈনিক ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নির্মিত সঞ্চালন পাইপলাইনের মাধ্যমে সারা দেশে সরবরাহের কথা রয়েছে। ২০১৮ সালের ১৪ আগস্ট জাহাজ থেকে এফএসআরইউর মাধ্যমে ট্রান্সমিশন লাইনে গ্যাস সরবরাহ দিতে সক্ষম হয় পেট্রোবাংলা। এ পর্যন্ত আমদানিকৃত এলএনজি থেকে এ পর্যন্ত দৈনিক সর্বোচ্চ ৭শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দিতে সক্ষম হচ্ছে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। এর মধ্যে দৈনিক সর্বোচ্চ ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেয়ে আসছিল কেজিডিসিএল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বৃদ্ধির কারণে এলএনজি সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে পেট্রোবাংলা। সারা দেশে এলএনজি সরবরাহ ৫০০-৫২৫ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে যায়। এতে গ্যাস সরবরাহে রেশনিং শুরু করে কর্ণফুলী গ্যাস। কারণ আমদানিকৃত এলএনজি হতে চট্টগ্রামের চাহিদা মেটানোর পর অবশিষ্ট জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে চট্টগ্রামের বাইরে সরবরাহ দেওয়া হয়।
কেজিডিসিএল সূত্রে জানা যায়, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্পখাত মিলিয়ে চট্টগ্রাম গ্যাসের গ্রাহক ৬ লাখের বেশি। আবাসিক গ্রাহক ৫ লাখ ৯৮ হাজারের কাছাকাছি। শিল্প গ্রাহক রয়েছে ১১২৭, বাণিজ্যিক গ্রাহক ২৮৬২, ক্যাপটিভ পাওয়ার ১৯০, সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন ৭০টি, বিদ্যুৎকেন্দ্র ৫টি ও সার কারখানা রয়েছে ৪টি। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা থাকে ৪৮০-৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এলএনজি আমদানির আগে চাহিদার বিপরীতে চট্টগ্রামে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কম গ্যাস পেত গ্রাহকরা। বর্তমানে ৩০০-৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাচ্ছে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) ২০১৯ সালের ৩০ জুন জারি করা সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনে কেজিডিসিএলের গ্রাহকদের জন্য গ্যাসের মূল্যহার নির্ধারণ করে দেয়। ওই প্রজ্ঞাপনে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের মূল্য ৪ টাকা ৪৫ পয়সা, ক্যাপটিভ পাওয়ারের জন্য ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা, সার কারখানার কাঁচামাল হিসেবে ৪ টাকা ৪৫ পয়সা, শিল্প কারখানা ও চা বাগানের জন্য ১০ টাকা ৭০ পয়সা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ২৩ টাকা, সিএনজি স্টেশনের জন্য প্রতি ঘনমিটার ৪৩ টাকা এবং আবাসিকে মিটারভিত্তিক ব্যবহারের জন্য ১২ টাকা ৬০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়।
পেট্রোবাংলার উপ-মহাব্যবস্থাপক (এলএনজি) মো. শাহ আলম আজাদীকে বলেন, নভেম্বর মাসের হিসাব অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটার এলএনজির গড় মূল্য ২০ টাকা। তবে প্রতি মাসে এলএনজির মূল্য ওঠানামা করে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বাড়তির দিকে। ডিসেম্বর মাসে প্রতি ঘনমিটারের মূল্য ২৫-৩০ টাকায় দাঁড়াতে পারে। এই মূল্যটি টার্মিনালের (এফএলআরইউ) চার্জ বাদে শুধু গ্যাসের ক্রয়মূল্য। টার্মিনালের চার্জসহ হিসেব করলে দাম আরো বেড়ে যাবে।
তিনি বলেন, গ্যাসের সংকট কাটাতে এলএনজি আমদানি শুরু করেছে। সরকার দুই বছর ধরে ভর্তুকি দিয়ে গ্রাহকদের আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহ করছে, যা হিসেব করলে অনেক টাকা।
কেজিডিসিএলের তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় গ্রিড থেকে বর্তমানে গড়ে দৈনিক ৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট (৯০ লক্ষ ৬১ হাজার ৩৯০ ঘনমিটার) গ্যাস পাচ্ছে কর্ণফুলী গ্যাস। সবই আমদানিকৃত এলএনজি থেকে। এর মধ্যে শিল্প কারখানা ও চা বাগানে দৈনিক সরবরাহকৃত গ্যাসের মধ্যে গড়ে ১৪ শতাংশ হিসাবে গ্যাস ব্যবহৃত হয় ১২ লাখ ৬৮ হাজার ৫৯৫ ঘনমিটার, সার কারখানায় গড়ে ২০ শতাংশ হিসেবে ১৮ লাখ ১২ হাজার ২৭৮ ঘনমিটার, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ২৭ শতাংশ হিসেবে ২৪ লাখ ৪৬ হাজার ৫৭৫ ঘনমিটার, ক্যাপটিভ পাওয়ারে গড়ে ১৪ শতাংশ হিসেবে ১২ লাখ ৬৮ হাজার ৫৯৫ ঘনমিটার, আবাসিকে গড়ে ১৯ শতাংশ হিসেবে ১৭ লাখ ২১ হাজার ৬৬৪ ঘনমিটার, বাণিজ্যিক গ্রাহকদের গড়ে ১ শতাংশ হিসেবে ৯০ হাজার ৬১৪ ঘনমিটার এবং সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনে গড়ে ৫ শতাংশ হিসেবে ৪ লাখ ৫৩ হাজার ৭০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহৃত হয়।
প্রতি ঘনমিটার ২০ টাকা হিসেবে কিনে সরকার ঘোষিত মূল্যে গ্যাস সরবরাহ দিতে গিয়ে প্রতিদিন ৮ কোটি ৭৮ লাখ ৭৩ হাজার টাকা ক্ষতির শিকার হচ্ছে কর্ণফুলী গ্যাস। আর এ ক্ষতির পুরোটাই সরকার ভর্তুকি হিসেবে দিচ্ছে। এর মধ্যে শিল্পখাতে ১ কোটি ১৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহে ২ কোটি ৮১ লাখ ৮১ হাজার টাকা, বিদ্যুতে ৩ কোটি ৮০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৭৮ লাখ ২ হাজার টাকা, আবাসিকে ১ কোটি ২৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা ভর্তুকি দিলেও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহে ২৭ লাখ ২ হাজার টাকা এবং সিএনজিতে গ্যাস বিক্রি করে ১ কোটি ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা মুনাফা করছে কর্ণফুলী গ্যাস।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেজিডিসিএলের এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার এলএনজির ক্রয়মূল্য গড়ে ২০ টাকা। কোভিড সংক্রমণের আগে ৩৫ টাকা পর্যন্ত ছিল। বর্তমানে চট্টগ্রামের জন্য এলএনজি থেকে দৈনিক ৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাচ্ছি। প্রতি ঘনমিটারের ক্রয়মূল্য ২০ টাকা হিসেবে গ্যাস বিক্রিতে শুধুমাত্র চট্টগ্রামে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে পৌনে ৯ কোটি টাকা। সবই সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন দাম বাড়ছে, সামনে এ ভর্তুকি আরো বাড়বে।
তিনি বলেন, দৈনিক পৌনে ৯ কোটি টাকা হলে মাসে ২৬৩ কোটি টাকা। বর্তমান ক্রয়মূল্যে শুধু চট্টগ্রামে গ্যাসের গ্রাহকদের জন্য বছরে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার।