শিরদাঁড়া সোজা করে মানুষের পাশে দাঁড়ালে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারলে মানুষ হিসেবে বাঁচাটা অর্থবহ হয় একথা বুঝেছিলেন প্রথিতযশা লেখক অরুন্ধতী রায়। যে সমাজে শ্রেণি বৈষম্যের প্রকটতা চরম, মানবতা পথের ধুলোয় লুটোয়, একদিকে চাকচিক্যময়, বিলাসবহুল জীবন অন্যদিকে না খেতে পেয়ে মৃত্যুকে বেছে নেয় মানুষ, যেখানে সুবিধাভোগীরা কথা বলতে চায় না সুবিধাবঞ্চিতদের হয়ে সেখানে অরুন্ধতী দাঁড়িয়ে যান বঞ্চিতদের পাশে, নির্যাতিতদের পাশে। এখানেই জিতে যান অরুন্ধুতি, জিতে নেন মানুষের ভালোবাসা।
দক্ষিণ ভারতীয় মা এবং বাঙালি বাবার কন্যা অরুন্ধতী রায়ের জন্ম মেঘালয়ের শিলং শহরে এবং বেড়ে উঠা তামিল নাড়ুর উটি এবং পরবর্তীতে কেরালায় যদিও জীবনের অনেকখানি সময় কেটেছে দিল্লীতে। ছেলেবেলায় বেড়ে উঠা তামিলনাড়ু এবং কেরালার জীবনের উপর ভিত্তি করে লিখেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘গড অব স্মল থিংস’ যা জিতে নেয় ম্যান বুকার পুরস্কার, অরুন্ধতীকে এনে দেয় বিশ্বজোড়া খ্যাতি।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় একজন স্থপতি অরুন্ধতী বিভিন্ন কাজের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছেন। প্রথম জীবনে অরুন্ধতী টেলিভিশন, সিনেমায় অভিনয় করেছেন, স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। শ্রেষ্ঠ স্ক্রিনপ্লে’র জন্য জাতীয় পুরষ্কার জিতে নেন। তিনি চলচ্চিত্রসমালোচনাও করেছেন। কিন্তু তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘গড অব স্মল থিংস’ সবকিছুকে ছাপিয়ে তাকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। প্রথম উপন্যাসেই বুকার পুরষ্কার অর্জন তাঁকে পরিচিত করে বিশ্বব্যাপী।
অরুন্ধতী রায় এরপরই বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে প্রবন্ধ এবং নন-ফিকশন লেখা শুরু করেন। বিশ্বায়ন এবং নব্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ সোচ্চার হয়ে উঠে। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ভারতীয় রাজনীতির তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। এছাড়াও শিল্পায়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন যা তাঁর মতে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বুকের উপর পা দিয়ে তৈরি তাঁর বিরোধিতা করেন। তাঁর ‘লিসেনিং টু গ্রাসহুপারসঃ ফিল্ড নোটস অন ডেমোক্রেসি’ গ্রন্থে অরুন্ধতী রায়ের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুতে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যায়। ২০০২ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা তাঁর প্রবন্ধ নিয়েই এই বই যেখানে একজন সচেতন এবং দৃঢ় প্রত্যয়ী মানুষের পরিচয় সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।
স্বাধীন কাশ্মীর ভূমি প্রশ্নে অরুন্ধতীর অবস্থান তাঁকে আরেকবার আলোচনার আলোয় নিয়ে আসে। কাশ্মীর প্রশ্নে তাঁর অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট। তিনি পরিষ্কারভাবেই কাশ্মীর জনগণের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন যখন এই ইস্যুতে ভারতের কোন বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রকাশ্যে কাশ্মীরিদের পক্ষে দাঁড়ায়নি। এখানেই অরুন্ধতীর অন্যদের থেকে আলাদা এবং অনন্য। তিনি সাধারণ মানুষের প্রাণের দাবিকে নিজের করে নিতে পেরেছেন তাই সাধারণ মানুষ তাঁকে লেখক পরিচয়ের উর্ধ্বে গিয়ে তাঁকে ভালবেসেছেন।
নর্মদা খাল বাঁচাও আন্দোলনে তিনি মেধা পাটকারের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন। এই প্রকল্পের যে ভুল, ক্ষতিকর দিক আছে সেগুলো স্পষ্ট করে তিনি এর বিরোধিতা করেন। তাঁর বুকার পুরষ্কারের অর্থ তিনি এই আন্দোলনের নামে ব্যয় করেন। এই আন্দোলনের জন্য তিনি সাধারণ মানুষের আরও কাছে চলে আসেন। সাধারণ মানুষ তাঁকে নিজেদের মানুষ ভাবতে শুরু করেন অন্যদিকে তিনি অনেক সমালোচনার মুখোমুখি হন, এমনকি এজন্য তাঁকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতেও অরুন্ধতী সদা সোচ্চার ছিলেন। আফগানিস্তান ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। এগার সেপ্টেম্বর ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে আমেরিকার আফগানিস্তান আক্রমণ আরেকরকম সন্ত্রাসবাদ যা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। তিনি তালেবান শাসনেরও কঠোর সমালোচনা করেন।
সামপ্রতিক ভারতীয় এন আর সি এবং এন পি আর ইস্যুতেও অরুন্ধতী রায় মানবতার প্রশ্নে তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তিনি জনগণকে ভুল তথ্য দিয়ে জাতীয় ডাটা বেইসকে এলোমেলো করে দিতে আহবান করেন যদিও এজন্য তাঁকে কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয় এমনকি আইনের সামনে দাঁড়ানোর মত পরিস্থিতি তৈরি হয়।
শক্ত শিরদাঁড়ার মানুষ অরুন্ধতী কখনো মানবতার প্রশ্নে পিছু হটেননি। যেখানেই মানবতা আহত হয়েছে অরুন্ধতীর কণ্ঠ সেখানেই সোচ্চার হয়েছে।