জুম্‌’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৭ নভেম্বর, ২০২০ at ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ

অলীকুল শিরোমণি হযরত আবদুল কাদের জিলানী (র.) জীবনাদর্শ
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! তাঁরই নির্দেশিত পথে পরিচালিত সত্যান্বেষী সত্যনিষ্ঠ সালেহীন আউলিয়ায়ে কেরামের পদাঙ্ক অনুসরণ করুন। সুন্দর ও আলোকিত জীবন গঠনে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জীবন কর্ম অনুসরণ করুন। অন্যায়, অসত্য, মিথ্যাচার, পাপাচার ও অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকুন। সততা, নিষ্ঠা, খোদাভীতি ও উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনে সচেষ্ট হোন। সম্মানিত নবী রাসূল, সাহাবা, অলী-বুজুর্গ, সূফী-সাধক ও পুণ্যাত্ম্য বান্দাদের আদর্শ গ্রহণ করুন।
আল কুরআনের আলোকে অলীদের মর্যাদা: পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তা’আলা আউলিয়ায়ে কেরামের মর্যাদা আলোকপাত করেছেন এরশাদ হয়েছে, “সাবধান! নি:সন্দেহে আল্লাহর অলীদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না। যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে তাঁদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। পার্থিব জীবনে এবং পরলৌকিক জীবনে আল্লাহর বিধানে কোন পরিবর্তন নেই। এটিই মহা সাফল্য। (সূরা: ইউনূস: আয়াত: ৬২,৬৩,৬৪), অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, “তাকাওয়া সম্পন্ন লোকেরাই হচ্ছে অলী। (সূরা: আনফাল, আয়াত: ২৩)
হাদীস শরীফে অলীদের আলোচনা: পৃথিবীর দেশে দেশে ইসলামের প্রচার প্রসারে সূফী সাধক ও আউলিয়ায়ে কেরামের অবদান অপরিসীম। তাঁদের ব্যবহারিক জীবনের আদর্শ ও উত্তম গুণাবলীতে মুগ্ধ হয়ে অসংখ্য বনী আদম ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় লাভে ধন্য হয়েছে। তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ, ঈমানের পরিচায়ক। তাঁদের প্রতি অসম্মান অশ্রদ্ধা ও বিদ্বেষ পোষণ আল্লাহর আযাব ও গযব নাযিলের অন্যতম কারণ। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে আল্লাহ তা’আলা বলেন, যে আমার অলীর সাথে বিদ্বেষ পোষণ করে আমি তার সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দিই। (বোখারী শরীফ, হাদীস নং: ৬৫০২)
আজকের আলোচনায় অলীকুল শিরোমনি বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (র.)’র জীবন সাধনা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
গাউসে পাকের পরিচিতি: নাম: সৈয়্যদ আবদুল কাদের (রা.) উপনাম আবু মুহাম্মদ, উপাধি, মুহিউদ্দিন, গাউসে আজম, মাহবুবে সোবহানী, পীরানেপীর দস্তগীর।
জন্ম: ৪৭০/৪৭১ হিজরির ১ রমজান মুবারকে।
ইন্তেকাল: ১১ রবিউসসানী ৫৬১ হিজরীতে। অসংখ্য সাহাবা ও আউলিয়ায়ে কেরামের স্মৃতি রিজড়িত ইরাকের বাগদাদ শরীফে মাযারে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত। তাঁর জীবনকাল ৯১ বৎসর। পিতা: হযরত আবু সালেহ মুসা জঙ্গী দোস্ত (রা.)। মহিয়সী মাতা: উম্মুল খায়র ফাতেমা (রা.)।
বংশধারা: তাঁর বংশধারা বুজুর্গ পিতার দিক থেকে হযরত সৈয়্যদানা ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর সাথে মিলিত। মাতার দিক থেকে বংশধারা হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর সাথে মিলিত হওয়ায় পিতৃকুল ও মাতৃকুল উভয় ধারায় তিনি সায়্যিদ তথা আউলাদে রাসূল। (তাযকিরায়ে মাশায়েখে কাদেরীয়া, উর্দু, পৃ: ২২৭)
মাতৃগর্ভের অলী: গাউসে পাক (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ছিলেন মাতৃগর্ভের অলী। জন্মের পর থেকেই তাঁর অলৌকিক কারামাত প্রকাশ হতে থাকে। জন্মের পর সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দুধ পান করেননি। পুরো রমজান মাস ব্যাপী তিনি রোজা রেখেছেন। ইফতারের সময় মাগরীবের আজান হলে তিনি দুধ পান করতেন এ সংবাদ জীলান শহরের সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো যে সৈয়্যদ পরিবারে এমন এক নবজাত নূরানী শিশু সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে যিনি গোটা রমজান মাস ব্যাপী দিনের বেলায় দুধ পান করেনি। (কালায়েদুল জাওয়াহের, পৃ: ২, আনোয়ারুল বায়ান, ১ম খন্ড, পৃ: ৫৩৫)
খোদা প্রদত্ত বেলায়তের ইলম : আমাদের বড়পীর হুযুর গাউসে আজম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে জিজ্ঞেস করা হলো। কখন থেকে আপনার বেলায়তের জ্ঞান অর্জিত হলো? তিনি উত্তর দিলেন দশ বৎসর বয়সে আমি যখন পড়ালেখার জন্য মক্তবে যাচ্ছিলাম তখন পথিমধ্যে আমার পশ্চাতে ফেরেস্তাদের বিচরণ অবলোকন করতাম। যখন আমি মক্তবে পৌঁছে যেতাম ফেরেস্তাদের বলতে শুনতাম “তোমরা আল্লাহর অলীর জন্য বসার জায়গা করে দাও। মক্তবে উপস্থিত সকলেই এ আওয়াজ শ্রবণ করতেন। (বাহজাতুল আসরার, পৃ:৪৭, কালায়েদুল জাওয়াহের, পৃ: ৯, যুবদাতুল আছার, পৃ: ৭৯)
জ্ঞানার্জনে বাগদাদ সফর : হুযুর গাউসে পাক বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (র.) আঠার বৎসর বয়সে মহিয়সী মাতার অনুমতিক্রমে ধর্মীয় জ্ঞানার্জনে এক কাফেলার সাথে জিলান থেকে প্রায় চারশত মাইল দূরবর্তী বাগদাদের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলেন। কাফেলা যখন হামদান অতিক্রম করল, ডাকাতদল আক্রমন চালিয়ে সব মালামাল সামগ্রী ছিনিয়ে নিল। আমাদের বড়পীর একপ্রান্তে দন্ডায়মান! ঘটনা প্রত্যক্ষ করছেন, ডাকাতদলের এক সদস্য নিকটে এসে জিজ্ঞেস করলেন হে বালক? তোমার সাথে কি আছে বল? তিনি উত্তর দিলেন আমার নিকট চল্লিশটি দিনার আছে, ডাকাত কথা অসত্য মনে করে চলে গেল। দ্বিতীয় ডাকাত এসে একই প্রশ্নের অবতারণা করল, তাকেও একই উত্তর দিলেন। এবারেও ডাকাতের কথা বিশ্বাস করল না। উভয় ডাকাত, সর্দারের নিকট ঘটনা ব্যক্ত করলে ডাকাত সর্দার বললো ছেলেটাকে আমার নিকট নিয়ে এসো। হুযুর গাউসে পাককে সর্দারের নিকট হাজির করা হলো। জিজ্ঞেস করা হলো সাহেব জাদা সত্য বলো! তোমার নিকট কি আছে? তিনি জবাব দিলেন, আমার কাছে চল্লিশ দিনার আছে। যা জামার বগলের নীচে সেলাই করা আছে। ডাকাত দল ও র্সদারের অনুসন্ধানে তাঁর কথার সত্যতা দেখে বিস্ময়ে হতবাক। সর্দার বলল, হে বালক! তুমি অবশ্যই জান যে আমরা ডাকাতদল, এ দিনার তো তোমার নিকট একান্ত গোপনে সংরক্ষিত ছিলো। তুমি তো না বললেই হতো কেনই বা প্রকাশ করলে? তিনি মুসকি হেসে বললেন, আমি কিভাবে মিথ্যা বলতে পারি? আমার মহিয়সী আম্মাজান তো সর্বাবস্থায় যে কোন পরিস্থিতিতে আমাকে সত্য কথা বলার নির্দেশ করেছেন। কোনো অবস্থাতেই যেন মিথ্যা না বলি। আপনাদের ভয়ে ভীত হয়ে চল্লিশ দিনারের জন্য আমার মায়ের সাথে কৃত অঙ্গীকার কিভাবে আমি ভঙ্গ করতে পারি। শুনুন আমি সবকিছু ত্যাগ করতে পারি মায়ের নসীহত ভঙ্গ করতে পারিনা। মায়ের উপদেশ রক্ষার্থে সত্য কথাই আমি বলে দিলাম। গাউসে পাকের সত্যবাদিতার এ অনন্য দৃষ্টান্ত ও অনুপম আদর্শ ডাকাত দলের অন্তরে এমনভাবে রেখাপাত করলো সকলে অশ্রু সিক্ত হয়ে গেল। তারা বলে উঠলো তুমি তো তোমার মায়ের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছো না আমরা তো প্রতিনিয়ত আমাদের প্রতিপালকের সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করে চলছি। এ কথা বলেই ডাকাত সর্দার গাউসে পাকের কদমে লুটিয়ে পড়লো। বিশুদ্ধ অন্তরে তাওবাহ করলো। সর্দারের অবস্থা দেখে ডাকাত দলের সকলেই তাওবাহ করে নিলো। কাফেলার লুণ্ঠিত মালামাল ফিরিয়ে দিলো। তারা অপরাধ জগত থেকে ফিরে এলো, সকলে ইবাদত বন্দেগীতে নিয়োজিত হয়ে পড়লো। প্রত্যেকে সৎ, আদর্শবান, নেককার, পুণ্যবান বান্দা হিসেবে নিজেদের কে গড়ে তুললো। তাদের সম্পর্কে গাউসে পাক স্বয়ং বলেন, “সকলের পূর্বে তারাই সর্বপ্রথম আমার হাতে তাওবাহ করে আলোর পথে ফিরে এসেছে।” (বাহজাতুল আসরার, পৃ: ২৫৬, কালায়েদুল জাওয়াহের, পৃ:৯)
সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলী : একদল আদর্শবান জাহের বাতেন ইলমে দ্বীনের অধিকারী সম্মানিত শিক্ষক মন্ডলীর তত্বাবধানে তিনি জ্ঞান সাধনায় আত্ম নিয়োগ করেন তাঁর শিক্ষক মন্ডলীদের মধ্যে আল্লামা আবু জাকারিয়া, ইয়াহিয়া ইবনে আলী, আল্লামা আবুল ওয়াফা আলী আবনে আকীল, আল্লামা মুহাম্মদ বিন কাযী আবু ইয়ালা ও হযরত কাযী আবু সাঈদ মাহযুমী প্রমুখ শিক্ষাগুরুদের সান্নিধ্যে তিনি আরবি সাহিত্য, ফিকহ উসুল বালাগত, মান্তিক, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বুৎপত্তি অর্জন করেন। আল্লামা আবু গালিব মুহাম্মদ বিন হাসান বাকিল্লানীসহ প্রায় সতের জন খ্যাতিমান হাদীস বিশারদ গণের সান্নিধ্যে থেকে হাদীস শাস্ত্রে গভীর প্রজ্ঞা পান্ডিত্য ও পূর্ণতা অর্জন করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি স্বয়ং বলেছেন, “ইলমে দ্বীন অর্জনের দ্বারা আমি বেলায়তের উচ্চ মর্যাদা কুতবীয়তের সোপানে উন্নীত হয়েছি এবং মহীয়ান স্রষ্টার সৌভাগ্য তথা কল্যাণ লাভে ধন্য হয়েছি। (আনোয়ারুল বায়ান, ১ম খন্ড: পৃ: ৫৩৯)
অমূল্য বাণী: বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (র.) মানব জাতির আদর্শ জীবন গঠনে যে অমুল্যবানী ও গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন তা মানব চরিত্র গঠনে এক অমূল্য সম্পদ।
নামায প্রসঙ্গ: হুযুর গাউসে পাক (র.) বলেন, নামায আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন, সম্মানিত নবীদের সুন্নাত ও ঈমানের মূলভিত্তি। নামায কবরের জ্যোতি, মুনকার-নকীর ফেরেস্তাদ্বয়ের প্রশ্নের জবাব এবং কিয়ামত অবধি কবর জগতে সহযোগী বন্ধু সমতুল্য। (গুনীয়াতুত তালেবীন, পৃ: ৫০৭)
তিনি আরো বলেন, যিনি নামাযের প্রতি অবহেলা ও নামাযকে তুচ্ছ মনে করবে অর্থাৎ যথাসময় নামায আদায় করেনা, সুন্নাত অনুযায়ী নামায আদায় করেনা, আল্লাহ তা’আলা তাকে পনের প্রকার শাস্তি দিবেন। ছয় প্রকার শাস্তি মৃত্যুর পূর্বে। তিন প্রকার মৃত্যুর সময়, তিন প্রকার শাস্তি কবরে এবং তিন প্রকার কবর থেকে উঠার সময়। মৃত্যুর পূর্বের ছয়টি শাস্তি ১. নামাযের প্রতি উদাসীন ব্যক্তির নাম নেককারদের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে। ২. তার জীবন কর্মে বরকত থাকবেনা। ৩. রিযকে বরকত হবে না। ৪. তার নেক আমল কবুল হবে না। ৫. তার দুআ কবুল হবেনা। ৬. নেককারদের দুআ থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে। মৃত্যুর সময় তিন প্রকার শাস্তি : ১. মৃত্যুর সময় পিপাসার্ত হবে। ২. মৃত্যুর সময় তাওবা এস্তেগফেরার করার সুযোগ হবে না। ৩. তার কাঁধে দুনিয়ার বোঝা ভীষণ ভারী হবে। কবরের তিন প্রকার শাস্তি: ১. কবর সংকীর্ণ হয়ে যাবে। ২. কবর ভীষণ অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে। ৩. মুনকার-নকীরের প্রশ্নের জবাব দিতে অক্ষম হয়ে যাবে। কবর থেকে উত্থিত হওয়ার সময়ের শাস্তি: ১. আল্লাহ তা’আলা তার উপর ভীষণ ক্রোধান্বিত হবেন। ২. তার হিসাব অত্যন্ত কঠিন হবে। ৩. আল্লাহর দরবার থেকে জাহান্নামের দিকে তার প্রত্যাবর্তন হবে। (গুনীয়তুত তালেবীন, পৃ: ৫১৩, আনোয়ারুল বায়ান, ১ম খন্ড, পৃ: ৫৮৭)
হে আল্লাহ আমাদেরকে আপনার মকবুল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমাদেরকে কুরআনের বরকত দান করুন। পবিত্র কুরাআনের আয়াত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ নসীহত দ্বারা আমাদেরকে উপকৃত করুন। নিশ্চয়ই তিনি মহান দানশীল, অধিপতি, পুণ্যময়, অনুগ্রহশীল, দয়ালু। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅসহায়ত্ব এবং আশার আলো
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে