দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ২৭ নভেম্বর, ২০২০ at ৬:২০ পূর্বাহ্ণ

বিদায় ঈশ্বরের হাত, বিদায় ম্যারাডোনা
অতল দারিদ্রতায় জন্ম হয়েছিল আপনার। সে কথা আমরা সবাই পড়েছি। কিন্তু আমরা যেটা পাঠ করতে ভুলে যাই কিভাবে কোন মনোবলে আপনি এই দারিদ্রতা জয় করে হয়ে উঠেছিলেন ফুটবল ঈশ্বর। আপনার যখন খ্যাতি আর জনপ্রিয়তা সারা বিশ্বে স্বাভাবিকভাবেই আঁতে ঘা লেগেছিল বিলেতের। মিডিয়া তাদের হাতে। আর তাদের আঁতে লাগার কারণ আপনার সোজা সাপটা কথাবার্তা। রেফারি যদি ধরতে না পারে হাতে না মাথা দিয়ে গোল করা হয়েছে তার দোষ খেলোয়াড়ের? কিন্তু আপনি যেমন তেমন ই বললেন। এ ছিলো ঈশ্বরের হাত। আর আপনার পাও যে কি জিনিস তা দেখা গেলো কিছু সময় পর। সে গোলে কুপোকাত ইংল্যান্ডকে আপনি একহাত নিলেন ফকল্যান্ড যুদ্ধের প্রতিশোধ মনে করিয়ে দিয়ে। আপনার এই স্বাধীনতা বোধ তাদের ভালো লাগে নি।
মনে পড়ে বিলেতে এক বার ভাষণ দেয়ার সময় আপনাকে লক্ষ্য করে কাগজের ছোট বল বানিয়ে ছুঁড়েছিল এক অতি উৎসাহী দর্শক। হল ভর্তি ওরা খুব মজা নিচ্ছিল কারণ ঐ কাগজে বলটি আঘাত করেছিল আপনার ললাটে। কি করলেন আপনি? রাগলেন না। বরং ঐ বলটি হেড করে ডান পায়ে নিয়ে বাঁ পায়ে এনে এমনভাবে মারলেন যা গিয়ে আঘাত করলো সে মানুষটির কপালে। আপনার কারসাজিতে ফুটবলের ভেলকিতে পুরো হল হয়ে উঠেছিল আপনার ভক্ত।
একবার ফিফা সিদ্ধান্ত্ত নিলো তারা সমুদ্র সীমা থেকে দুই হাজারের অধিক উচ্চতায় ফুটবল খেলা হবে না। যার মানে দুনিয়ার বহু দেশে বহু শহরে ফুটবল আর হবে না। বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকার বলিভিয়া আর ইকুয়েডরে চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে এই খেলা। তখন আপনিই প্রতিবাদ করে বলেছিলেন ফুটবল খেলা না খেলা একটি জাতির অধিকার। ঈশ্বর দত্ত অধিকার কেড়ে নেয়ার ফিফা কে? বলাবাহুল্য ফিফা পরাজয় বরণ করে পিছু হটেছিল।
আপনাকে আমি প্রথম দেখি ষোল ইঞ্চির সাদাকালো ছোট পর্দায়। ভরা যৌবনের শুরুতে চট্টগ্রাম শহরের লাভ লেইনের টিনের চালার বাড়িটি সারারাত গমগম করতো আপনার তেজও নান্দনিক কৌশলে। বিশ্বকাপের খেলা শুরু হতো গভীর রাতে। মেঙিকোর সে বিশ্বকাপ ছিলো ফুটবল তথা পুরো দুনিয়ার এক টার্নিং পয়েন্ট। মূলত এরপরই উপমহাদেশের ফুটবল দর্শক সমর্থক দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সকার শুরু হলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহুদেশের বাড়িতে বাড়িতে উড্ডীন পতাকা দেখে বোঝার উপায় থাকে না এ কোন দেশ? একি আর্জেন্টিনা না ব্রাজিল? এ মূলতঃ আপনার অবদান। আপনিই এই দুইদেশে সমান সমান জনপ্রিয় করে দিয়েছিলেন খেলাও প্রতিযোগিতা। যা আজ সারা দুনিয়ায় একাকার।
না আমি স্প্যানিস জানি, না আপনি জানতেন বাংলা। তাও সে বয়সে নায়ক হয়ে ওঠা আপনাকে একখানা চিঠি লিখে রেখেছিলাম। সে চিঠি কোথায় জানি না তবে আজ তা আকাশের ঠিকানায় হারিয়ে গেছে।বর্ণঢ্য হওয়াটা সহজ কিছু না। নিয়ম আপনাকে টানে নি। অনিয়ম ব্যতিক্রম আর বাঁধনহীন প্রতিভা বলেই ঈশ্বরের হাতে গোল হয়েছিল। সে অপমান কখনো ভোলেনি ইংরেজ ভোলেনি ইংলিশ মিডিয়া। তারপর থেকে ক্রমাগত ছোট করার কাজটি করে গেছে তারা।
মেজাজ চড়া ছিলো বটে। অন্যায় অপমান আর একচোখা কিছু মিনমিনে লোকেরা মেনে নিলেও সাহসীরা মানে না। তাই মাঠ থেকে যেমন লাল কার্ড নিয়ে বেরিয়ে গেলেন এরপরই ত লাল পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে চুরুট খেয়ে গড়লেন ইতিহাস। আজ পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় দুনিয়ার সমাজতান্ত্রিক নেতারাই ছিলেন আপনার বন্ধু। ফিদেল হুগো শ্যাভেজ এমনকি কলকাতা এসে জ্যোতি বসুর সাথেও দেখা করেছিলেন আপনি। সাদামাটা আচরণের খোলা মানুষ কাউকে পাঁচ মিনিট বললেও আডডা দিতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। মুখে হাভানা চুরুট মাথার টুপি মনে করিয়ে দিতো আপনি ও চে গুয়েভারা এক দেশের মানুষ।
ক্ষণজন্মা শব্দটি সবার বেলায় খাটে না। কিংবদন্তি কিংবা ম্যাজিশিয়ান হয়ে ওঠাও কঠিন। একবার যে দেখেছে সে তার মনে গোপনে জানে অমন শৈলী অমন দশজনকে পরাস্ত করে গোল করা একবারই হয়, আর তা করতে পারতেন আপনি।
শিল্প ও খেলা যদি সমার্থক হয় আপনার দেশের ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোও রবীন্দ্রনাথের ভালোলাগা ও সমার্থক বৈ কি। সে কারণেই আরো বেশী ভালোবাসতাম আপনাকে।
যতো বিশৃঙ্খল যতো নিয়ম বহির্ভূত আচরণ ততোই হয়ে উঠেছিলেন জনপ্রিয়। সে জোয়ারে ভাটা পড়ে নি কখনো।
এখনো মন ভালো করার জন্য বা আর্জেন্টিনা হেরে গেলে ঘুরে ফিরে আপনার চোখ জুড়ানো খেলাগুলো দেখি। মুহূর্তে মন ভরে ওঠে আনন্দে।
যাবার সময় হয়নি আপনার, নিয়ম না মানার মানুষ কি আর নিয়ম মানে? চোখ ভিজিয়ে বুক ভেঙে দিয়ে তারার দেশে উধাও তারকা ম্যারাডোনা।
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি নামে পরিচিত আরেক বিশ্ব সেরা পেলের ট্যুইট টা দিয়েই শেষ করি, ‘একদিন আমরা দু জন ফুটবল খেলবো একসাথে আকাশের মাঠে”। এরপর আর কোন কথা থাকে না দিয়াগো। আপনি যে কতোবড় বিস্ময় তার প্রমাণ বাংলাদেশ। কোনদিন দেখে নি সে দেশের নাম শোনে নি তারাও শুধু আপনার কারণে আজ মেসীকে পাগলের মতো ভালোবাসে। সে দেশের পরাজয়ে অসুস্থ হয় মানুষ। গ্রামে গঞ্জে অনেকে বিশ্বাস করেন ম্যারাডোনা নাকি বাংলা নাম। এও এক অর্জন । দুনিয়ায় বহু নামী দামী খ্যাতিমান ফুটবলার আসবে যাবে । কিন্তু মুখের ওপর ক্যাথলিক গুরুকে গরীবের জন্য গীর্জার সোনা বিক্রির কথা বলবে না কেউ। কেউ করবে না প্রতিভাময় এমন পাগলামি।
একটাই দুঃখ মাদক আর উন্মাদনা না থাকলে আপনাকে হয়তো আরো অনেকদিন পেতো এই পৃথিবী। জিনিয়াস কি এমনই হয়? এটাই তাদের নিয়তি? তারকা হয়তো অনেকে কিন্তু এমন মন দাপানো বিশ্ব আকাশের তারা ক ‘জন?
শান্তিতে ঘুমাও দিয়াগো ম্যারাডোনা। শুভ বিদায়।
লেখক : কবি-প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধচন্দনাইশে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে কিশোর আহত