পীরানে পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) ও তাঁর যেয়ারত
বাগদাদ নগরীতে শায়িত রয়েছেন পীরানে পীর হযরত শেখ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)। কাদেরিয়া তরিকার ইমাম বিশ্বখ্যাত মহান ওলি। ৪৭০ হিজরি তথা ১০৭৭-৭৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম। বিশাল ইরান দেশের একটি প্রদেশের নাম গিলান, যার অবস্থান কাস্পিয়ান সাগরের তীরে। সাগর বলা হলেও ইহা বিশ্বের বৃহত্তম লেক লবণাক্ত। এই প্রদেশের নীফ বা নয়ফ গ্রামে জন্ম। হযরত ইমাম হাসান (র.)’র সরাসরি বংশধর। ইরানসহ ঐ সব অঞ্চলে হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)কে গিলানী বলা হয়। আমাদের দেশে উচ্চারণগত ব্যবধানে জিলানী। পারিবারিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি কুরআন মাজীদ মুখস্থ করেন। ১৮ বছর বয়সে উচ্চতর শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে বাগদাদ গমন করেন। কিন্তু তাঁর আব্বাজান আম্মাজান গিলান প্রদেশে শায়িত। গিলানের প্রাদেশিক রাজধানীর নাম রাস্ত। এখান থেকে প্রায় ২০ কি.মি দূরত্বে সুমেসারা নামক স্থানে তাঁর মাতা সৈয়দা উম্মুল খায়ের ফাতেমা শায়িত। ইরান সফরকালে হযরত সৈয়দা উম্মুল খায়ের ফাতেমার যেয়ারত করার সৌভাগ্য হয়। তাঁর পিতা সৈয়দ আবু ছালেহ মূসা শায়িত এখান থেকে অনেক দূরত্বে বিধায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যেয়ারত করা সম্ভব হয়নি। তাঁর পিতা মাতা উভয়ে ছিলেন দরবেশ।
প্রথম দিকে কয়েকজন ওস্তাদের নিকট আরও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে ত্যাগ স্বীকার করেন। এ সময়ে সুযোগে হজ্বব্রত পালন করেন। দাম্পত্য জীবেন পা বাড়ান। ইমামে আজম আবু হানিফার মাজারে খাদেম হিসেবে সময় কাটান বলে উল্লেখ রয়েছে। বাগদাদে মাদ্রাসা নিজামিয়ায়ও তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি ইসলামের ১৩টি শাখা প্রশাখার উপর জ্ঞার্নাজন করেন। তৎমধ্যে হাদীস শরীফ ও ফিকাহ অন্যতম। তিনি পারস্য ভাষী হয়েও আরবি ভাষাবিদ ছিলেন। বাগদাদের শ্রেষ্ঠ ওলিগণের সোহবত অর্জন করতে থাকেন। বাগদাদে অবস্থাকালীন দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করেন। জীবনের পরবর্তী সময়ে তিনি সুফিজমের দিকে ধাবিত হন, রেয়াযতে সময় কাটান। এশারের নামাজের ওযু দ্বারা ফজরের নামাজ পড়তেন। নিদ্রাকে প্রতিহত করতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামাজের মধ্যে কুরআন মাজীদ খতম করতেন। তিনি রেয়াযতের দিকে ধাবিত হওয়ার সাথে সাথে প্রায় এক বছরকাল ইরাকের মাদায়েন শহরের জনবসতিহীন দালানের নির্জনে এবাদতে সময় কাটান। দিবারাত্রি আল্লাহর এবাদত এবং ধ্যানই ছিল তাঁর একমাত্র এবাদত।
ঐ সময় পীরানে পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) হযরত শেখ আবু সায়ীদ মাখজুমীর হাতে মুরিদ হন। ঐ সময় তিনি এলমের সাগরে ভাসমান বলা যাবে। তথা ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে অতুলনীয় এলমের অধিকারী ছিলেন। হযরত মাখজুমী ছিলেন হযরত আবুল হাসান আলী (রহ.)’র খলিফা। তিনি তথায় শিক্ষকতা করতেন। এতে শুধু বাগদাদ নয়, তাঁর নিকট জ্ঞানার্জনের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে জ্ঞান পিপাসুরা আসতে শুরু করে। এতে তিনি ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিতেন-বিশেষ করে তাফসীর, হাদীস, আদব, উসূল, কাওয়ায়েত, আদব-কায়দা, আচার-ব্যবহার ইত্যাদি। প্রথম দিকে তিনি শাফী মাজহাব মতাবলম্বী ছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর থেকে শিক্ষা গ্রহণকারীদের মধ্যে রয়েছে শত হাজার জ্ঞানী ওলি দরবেশ। এদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় মাদ্রাসার মাঠে, নিকটতম ঘরসমূহের ছাদে এমনকি সড়কের উপরে জ্ঞানার্জনকারীরা অবস্থান নেন।
হযরত পীরানে পীর আড়ম্বরপূর্ণ উত্তম পোশাক পরিধান করতেন। তিনি সহজে মানুষের হাদিয়া গ্রহণ করতেন না। কেউ কিছু দিলে অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। বাগদাদের খলিফা মনসুরের পুত্র ইউসুফ এক থলি স্বর্ণ মুদ্রা উজিরের মাধ্যমে পাঠান, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। সপ্তাহে ৩ দিন নসিহত করতেন। শুক্রবার জুমার পর মসজিদ প্রাঙ্গণে, শনিবার রাতে মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে, বুধবার বাদ ফজর ঈদগা ময়দানে। খলিফা থেকে আরম্ভ করে জ্ঞানী-গুণী, আলেম-ফাজেল, সুফি-দরবেশ, ইহুদি-খ্রিস্টান-মুশরিক, কুলি-মজুর লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত। তাঁর নসীহত শুনতে শুনতে হাজার হাজার মানুষ আত্মহারা হয়ে যেত।
হিজরি ৫২১ সাল থেকে হিজরি ৫৬১ সাল পর্যন্ত শিক্ষা দীক্ষা কাজে মশগুল ছিলেন। তাঁর অসংখ্য করামতের মধ্যে ইহা একটি ছিল যে, সে সময় হাজার হাজার শ্রোতা সামনে পেছনে সবাই এক সমান আওয়াজ শুনতে পেত।
হযরত আবদুল কাদের জিলানী অনেক অমূল্য গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। তৎমধ্যে কয়েকটি হল-(১) গুন্ইয়াতুত ত্বালেবীন (২) আল-ফাত্হুর-রাব্বানী (৩) ফুতহুল গায়ব (৪) হিযবু বাশাইরিল (৫) জিলাউল খাতির (৬) আল-মাওয়াহিবুর-রাহমানিয়া (৭) ইয়াওয়াকীকতুল হিকাম (৮) আল-ফয়ূদাতুর রাব্বানিয়া ফিল-আওরাদিল কাদিরিয়া (৯) বাহ্জাতুল আসরার।
অধিকাংশ জ্ঞানীগুণী লেখকেরা তাকে অতি উচ্চ মর্যাদাবান ব্যক্তি বলে উল্লেখ করে গেছেন এবং তাকে নানান লকবে ভূষিত করেন। তৎমধ্যে ওলি দরবেশগণের সুলতান অন্যতম। যথা- পীরানে পীর, তথা পীরগণের পীর।
তাঁর করামতের (কারামত/কেরামত) ভাণ্ডার বিশাল। তাঁর বিভিন্ন অলৌকিকত্ব নিয়ে গ্রন্থও রচিত আছে। সে সময় এবং পরবর্তী কালেও আহলে হাদীস পন্থিরা তাঁর করামতের বিশালত্ব নিয়ে দ্বিমত পোষণ করতে সাহস করেন নিই। তবে তাদের পক্ষ থেকে একটি যৌক্তিকতা গ্রহণযোগ্য রয়েছে। হযরত পীরানে পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) সারা জীবন ইসলামের খেদমত করে গেছেন। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ের প্রচারের চেয়ে করামতের প্রচারটা হয় বেশি।
তিনি জীবনের শেষ বয়সে বাগদাদ থেকে জন্মভূমি গিলানে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাগদাদবাসীর অতি আবদার অনুরোধ উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। বিশ্বখ্যাত মহান ওলি পীরানে পীর ৫৬১ হিজরি ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দে ১১ রবিউস সানি প্রায় ৯১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। বাগদাদ নগরীর প্রাণকেন্দ্রে বিশাল মাজার কমপ্লেঙ নিয়ে শায়িত।
যেয়ারতঃ ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে হজ্বের পর যেয়ারতের উদ্দেশ্যে বাগদাদে গমন করার সৌভাগ্য হয়। বাংলাদেশের ১৮ জন যেয়ারতকারী হজ্বের পর এ সফর। কুমিল্লা শাহপুর দরবারের পীর হযরত মুহাম্মদ পেয়ারা (রহ.) এ সফরের আয়োজক, ১০ দিনের সফর। জেদ্দা থেকে ২ ঘণ্টার যাত্রায় জর্ডানের রাজধানী আম্মানে পৌঁছা। শেষ রাত্রে বিমান বন্দর থেকে হোটেলে। ফজরের নামাজের পর সকালের নাস্তা, অতঃপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম। জুমার জন্য তৈরি হয়ে আম্মানের বিখ্যাত আবদুল্লাহ জামে মসজিদে নামাজ। হোটেলে ফিরে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে ৭ দিনের যেয়ারতের প্রোগ্রামে বাগদাদ রওনা। বাগদাদ থেকে এসে ২ দিনের জন্য ফিলিস্তিনে রওনার প্রোগ্রাম। ৯৫০ কি.মি দূরত্বে বাগদাদের উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে দিল আম্মানের হোটেল থেকে। বাস একটি চালক ২ জন, যাত্রী আমরা ১৮ জন। অবরোধের কারণে আকাশপথ বন্ধ, সড়কপথই একমাত্র মাধ্যম। পরদিন দুপুর ১২ টার দিকে আমরা বাগদাদ নগরীর প্রাণকেন্দ্রে হযরত বড় পীর (রহ.) মাজার কমপ্লেঙের আধা কি.মি দূরত্বে একটি হোটেলে উঠি এক সপ্তাহের জন্য। ফলে নিয়মিত যেয়ারতে যাওয়ার সুযোগ হয়। হযরত বড় পীর (রহ.)’র মাজার এক গম্বুজ বিশিষ্ট, সংলগ্ন প্রকাণ্ড জামে মসজিদ। মাজার ও মসজিদের বারান্দা সমান্তরাল তথা এক। মাজারের ভিতর মূল কবরের তিন দিকে খালি জায়গা। এতে যেয়ারতকারীগণ মাজারের ভিতর প্রবেশ করে যার যার সুবিধা মত যেয়ারত করে। মাজার মসজিদে বারান্দার পর সামনে চত্ত্বর। চত্ত্বরের পর হযরত বড় পীর (রহ.)’র সন্তান-সন্ততির বংশধরগণের কবরস্থান, ছোট ছোট অফিস। মাজার ও মসজিদের দু’দিকে নানান স্থাপনা। এখানে রয়েছে মাদ্রাসা, গেস্ট হাউস, অফিস। মূল সড়ক থেকে মাজার কমপ্লেঙ ২/৩ শত মিটার হতে পারে। বাগদাদবাসীর কাছে হযরত বড় পীর (রহ.) শাইখ হিসেবে পরিচিত। টেঙীসহ যে কেউ বাবুস শাইখ বললেই চিনে। তথা শাইখের গেইট।
সপ্তাহখানেকের প্রোগ্রামে কাজেমাইন, সালমান পাক, কুফা, নজফ, কারবালা, মসূল যেয়ারতের প্রোগ্রাম রাখা আছে। সেই মতে ২য় দিন মূল বাগদাদ নগরীতে যেয়ারত। এরপর একদিন কুফা, নজফ, কারবালা প্রায় ১০০-১৩০ কি.মি দূরত্বের মধ্যে। আরেক দিন প্রায় ৩ শত কিলোমিটারের অধিক দূরত্বে মসূলে যাওয়া হয় যেয়ারতের উদ্দেশ্যে।
২য় দিন বাসে ইরাকী গাইডের মাধ্যমে সারা দিন বাগদাদ নগরীর ভিতর যেয়ারতে কাটানো হয়। বাগদাদে মতান্তরে ৪ হাজার বিশ্বখ্যাত ওলি দরবেশ শায়িত। আমরা মাত্র কয়েকজনের যেয়ারত করতে পারি। তৎমধ্যে ইমাম আবু হানিফা, হযরত আবু বকর শিবলী, ইমাম আবু ইউসুফ, হযরত জুনাইদ বোগদাদী, হযরত সররী সকতি, হযরত আবু আহমাদিল আরবী, হযরত সৈয়দ আবদুল্লাহ আবু যারম, হযরত বাহলুল দানা, হযরত মারুফ কারকী, সরওয়ার্দী তরিকার ইমাম সাহাবুদ্দিন সরওয়ার্দী, হযরত ইমাম গাজ্জালী, হযরত মনসুর হাল্লাজ অন্যতম।
বাগদাদ মহানগরীর উপকণ্ঠে শায়িত হযরত ইমাম মূসা কাজেমী ও হযরত ইমাম জাওয়াদ তকী। এ এলাকাকে কাজেমাইন বলা হয়। ইহা বৃহত্তর বাগদাদে বহু কোটি টাকা ব্যয়ে বিশাল আকৃতির মাজার। এখানে শিয়াদের উপস্থিতি ব্যাপক।
পরবর্তীতে আরেকদিন হযরত মহিউদ্দীন মুজাদ্দেদী (রহ.)সহ আমরা কয়েকজন একটি টেঙী নিয়ে ইমাম আজমের যেয়ারতে যাই। ইমাম আজমের মাজার প্রকাণ্ড কবরস্থান সংলগ্ন। এ কবরস্থানে হযরত আবু বকর শিবলী (রহ.)সহ বিশ্বখ্যাত কয়েকজন ওলি শায়িত।
সপ্তাহখানেক বাগদাদে অবস্থানকালীন চারদিকে খুব অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল। অভাবে বাগদাদ জর্জরিত। ৫/১০/২০ টাকার দিনারের নোট দেখামেলা ভার, আমাদের দেশের ভাংতি পয়সার মত। ১৯৮০ এর দশকে ইরানের সাথে ৮ বছর ব্যাপী ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের আগে ইরাকের এক দিনারে আমেরিকার সাড়ে তিন ডলার পাওয়া যেত।
১৯৯০ সালে সাদ্দাম হোসাইন কর্তৃক কুয়েত দখল, আমেরিকার নেতৃত্বে টিকতে না পেরে কুয়েত ছেড়ে দেয়া, অতঃপর ইরাককে অবরোধে ফেলা হয়। এমনি অবস্থায় ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ইরাকে যেয়ারতে গমন করি। তখন ১ ডলারে ১৩ শত দিনার পাওয়া যাচ্ছিল। (ইরাকে টাকাকে দিনার বলে)।
সপ্তাহ পর আমরা আবারও সড়কপথে আম্মান ফিরে আসি। আম্মান থেকে ২ দিনের প্রোগ্রামে জেরুজালেম কেন্দ্রিক ফিলিস্তিন রওনা করি।
বিশ্বের মত আমাদের দেশে ১১ রবিউস সানি হযরত বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)’র ওফাত বার্ষিকী পালিত হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট