হালিশহরের বিস্তৃত সাগর পাড়ে প্রতিবছর অর্গানিক ফসল চাষ করে শত কোটি টাকা আয় করেন কৃষকরা। তবে এবারের ফলন দেখে একেবারেই হতাশ তারা। এবার সাগরপাড়ে ‘সবজি রাজ্যে’ যে বিপর্যয় তা আর কখনো ঘটেনি বলেও জানান কৃষকরা। তবে এই বিপর্যয়ের পেছনে বীজের সমস্যা, টানেল প্রকল্পের কারণে পানি নিষ্কাশনে সংকট এবং প্রতিকূল আবহাওয়াকে দায়ী করছেন তারা। সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর দক্ষিণ হালিশহর আনন্দবাজারে ময়লার ভাগাড়ের পাশে সাগরপাড়ে কয়েক হাজার একর জমিতে গত বেশ কয়েক বছর ধরে গড়ে উঠেছে ‘সবজি রাজ্য’। আউটার রিং রোডের পাশ ধরে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে গড়ে উঠা এই সবজি রাজ্যে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার সবজি উৎপাদন হয়। শীতকালীন সবজির মধ্যে টমেটোর চাষই বেশি হয় এখানে। এর পাশাপাশি ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউসহ নানা ধরনের শাক সবজির ফলন চোখ জুড়িয়ে দেয়। একজন মাত্র কৃষকই এক কোটি টাকার টমেটো বিক্রি করার রেকর্ড রয়েছে এখানে। এই ধরনের শতাধিক কৃষক আনন্দবাজারের বিস্তৃত এলাকায় চাষাবাদ করেন। পতেঙ্গা উপকূলের চাষীদের বিষমুক্ত অর্গানিক ফসল উৎপাদনের সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। বিশেষ করে আগাম টমেটো চাষ এই এলাকার কৃষকদের কোটি টাকার স্বপ্ন দেখতে সহায়তা করে। মৌসুম শুরুর বহু আগেই এখানে বিশেষ পদ্ধতিতে টমেটো চাষ শুরু হয়। বিষমুক্ত টাটকা টমেটোর তীব্র চাহিদায় কৃষকদের চোখে হাসি ফুটে উঠে। ক্ষেতের পাড় থেকেই পাইকারীতে একশ’ টাকা পর্যন্ত কেজি দরে টমেটো বিক্রি করেন কৃষকরা। এবারও সেই লক্ষ্যে যথারীতি চাষ করা হয়। শত শত একর জমিতে লাগানো হয় হাজার হাজার টমেটো চারা। গাছও বাড়তে থাকে। হলদে ফুলে ভরে উঠে মাঠ। হাসি ফুটে কৃষকের মুখে। কিন্তু দিন যাওয়ার সাথে সাথে ফুল ঝরে পড়ার হার বাড়তে থাকে। গাছের গোড়ার মাটি হলদে ফুলে ভরে যায়। ফুল হলেও কোনো সবজি ধরে না। এই দৃশ্য দেখে কৃষকদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে।
গতকাল সরজমিনে এলাকা পরিদর্শনকালে একাধিক কৃষক দৈনিক আজাদীকে জানান, প্রচুর ফুল ধরেছে, কিন্তু ফল হয়নি। অন্যান্য বছর যে পরিমাণ টমেটো ধরতো তার বিশ ভাগের এক ভাগও নেই এবার। একেকটি গাছের পেছনে ৫০ থেকে ৬০ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু আধা কেজি ফলনও নেই। টমেটোর আকারও ছোট। অন্যান্য বছর একটি গাছ থেকে দশ কেজি পর্যন্ত ফলন পাওয়া যেতো। এবার তা আধা কেজিতে এসে ঠেকেছে। তাও মানহীন টমেটো। ছোট সাইজের। দামও নেই। গতকাল প্রতি কেজি টমেটো পঞ্চাশ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছিল। অর্থাৎ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে একটি গাছ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ টাকার ফলন পাওয়া যাচ্ছে। অথচ এই গাছটির পেছনে কৃষকের ইতোমধ্যে ব্যয় হয়ে গেছে ৬০ টাকা। ভয়াবহ এই দুরবস্থার মাঝে চোখের জল ফেলাই যেন নিয়তি কৃষকদের।
হালিশহর আনন্দবাজার এলাকায় পরিচিত মুখ কৃষক মহসীন মিয়া। একশ’ কানিরও বেশি জমিতে অর্গানিক ফসল ফলান তিনি। গত বছর এক কোটি টাকারও বেশি টমেটো বিক্রি করে তিনি খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন। এবার মারাত্মক সমস্যায় পড়লেও কৃষক মহসীন চাষাবাদ ছাড়েননি। বেশ কিছু জমিতে টমেটোসহ নানা ধরনের সবজি চাষ করেছেন। কিন্তু ফলন নেই। ভয়াবহ রকমের খারাপ অবস্থা তার ক্ষেতের। কৃষক ফরিদুল আলম দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে জানান, এত নাজুক পরিস্থিতি আগে কোনো দিন পড়তে হয়নি। বাজে অবস্থায় আর কোনদিন পড়েন নি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বিশ ভাগের এক ভাগ ফলনও হয়নি। অন্যান্য বছর একটি গাছ থেকে অন্তত দশ কেজি টমেটো পেতাম। এবার আধা কেজি টমেটো পেতে কষ্ট হচ্ছে। গাছে প্রচুর ফুল, কিন্তু ফল নেই।
কৃষক লেদু নিজের এবং অন্যান্যদের অবস্থা বলতে গিয়ে আফসোস করে বলেন, এমন বিপর্যয় আর কোনদিন দেখিনি। চাষের খরচ উঠবে না। শ্রমিকদের বেতন ভাতার যোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আগাম টমেটোর চাষ করে প্রতি বছর বেশ লাভবান হলেও এবার সাগরপাড়ের কৃষকদের অবস্থা খুবই খারাপ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
কৃষক কামরুল ইসলাম নিজের ক্ষেতে দাঁড়িয়ে দৈনিক আজাদীকে বলেন, এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠা অনেক কঠিন হবে। প্রচুর ঋণ করেছি। এমন ভয়াবহ অবস্থায় পড়বো কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি।
টমেটো চাষের বেহাল অবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে কৃষকেরা দৈনিক আজাদীকে বলেন, ফুল ফুটলেও টমেটো না ধরার জন্য আমাদের মনে হচ্ছে বীজে বড় কোন সমস্যা রয়েছে। হাইব্রিড বীজ লাগানো হয়েছিল। এই বীজের সমস্যার কারনেই ফুল আসলেও ফলন হয়নি। এছাড়া দুই দফায় বৃষ্টি এবং ঝড়ো হাওয়া প্রচুর ক্ষতি করেছে। কর্ণফুলী টানেলের জন্য বাঁধ দেয়ায় পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে আগে অতি সহজে পানি সরে গেলেও এবার জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। যাতে গাছের ক্ষতি হয়েছে।
অবশ্য চট্টগ্রামের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আখতারুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, টানেলের বাঁধের কারনে একটি সমস্যা হয়েছে বলে শুনেছি। তবে বীজ নিয়ে কোন সমস্যা আছে কিনা তা পরীক্ষা করার পরই বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। তিনি বীজ বিক্রেতাদের সাথেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন বলে জানালেন। তিনি বলেন, হালিশহরের সাগরপাড়ে মৌসুম শুরুর বেশ আগেই চারা লাগিয়ে টমেটোর চাষ করা হয়। এবার বেশি আগে গাছ লাগানো হয়েছিল। তখন তাপমাত্রা ছিল অনেক বেশি। এত বাড়তি তাপমাত্রায় ফলন ঠিকভাবে পাওয়া কঠিন বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এখন তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে ফলন ভালো হবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।