স্কুল জীবনে পাঠ্য বই এর একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম। প্রবন্ধটির নাম ছিল ‘সুখ না দুঃখ’। যদি আমার ভুল না হয় তবে বলা যায় প্রবন্ধটির লেখক ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি প্রবন্ধটি শুরু করেছিলেন এভাবে-“ মাছি-মারা-কেরানি নিয়ে যত ঠাট্টা-রসিকতাই করি না কেন, মাছি ধরা যে কত শক্ত সে কথা পর্যবেক্ষণশীল ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করে নিয়েছেন, মাছিকে যেদিক দিয়েই ধরতে যান না কেন, সে ঠিক সময়ে উড়ে যাবেই ”। প্রবন্ধটিতে প্রারম্ভিক আলোচনা শেষ করে তিনি সুখের সংজ্ঞা দেন। যতটুকু মনে পড়ে, তিনি সুখের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে এমন অনেক বিষয় আলোচনা করেন যে, প্রচুর সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও কোন ব্যক্তি সুখী হতে পারেন না। আবার পর্যাপ্ত অর্থাভাবেও দরিদ্র ব্যক্তিরা সুখী হতে পারে না। মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি এরূপ যে, মানুষ দিন-রাত হন্য হন্য হয়ে সুখের পিছনে দৌড়ে। তবে সুখী হওয়ার পথ এক একজনের কাছে এক এক রকম। কেউ অর্থ উপার্জন করে সুখী হতে চায়। কেউ ভালবেসে সুখী হতে চায়। কেউ সন্ধ্যাকালীন ক্লাবে গিয়ে সুখী হতে চায়। আবার কেউও নিষিদ্ধ দ্রব্য পান করে সুখী হতে চায়। এ সত্য উপলব্ধি করে ভারতীয় আধুনিক গানটি সাজানো হয়েছে এভাবে- ‘সবাই তো সুখী হতে চায়, কেউ সুখী হয়, কেউ হয় না। জানি না বলে যা লোকে সত্য কিনা, কপালে সবার নাকি সুখ সয় না’।
আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুসারে ‘জনসংখ্যা অর্থনীতি’- নামে এক গ্রন্থ রচনা করেছি অনেক আগে। গ্রন্থটি সারা বাংলাদেশে অর্থনীতি বিষয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট আজও বেশ জনপ্রিয়। জনসংখ্যা অর্থনীতিতে মানব জাতির জীবন চক্র সম্পর্কেও বলা আছে। একটি মানব সন্তান পৃথিবীতে আসার পর বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যে জীবন ব্যবস্থা আবর্তিত হয় তাহাই মানব জাতির জীবনচক্র বলে মনে করা হয়। এ জীবনচক্রে যৌবন পরবর্তী সময় থেকে মানুষ সুখী হবার জন্য ক্রমাগত পরিশ্রম করে। কেউ মনে করে যৌবনকাল থেকে আরম্ভ করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সুখী হবার একমাত্র উপায় হচ্ছে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ আয় করা। আবার কেহ মনে করে নরনারীর অকৃত্রিম ভালবাসার মধ্যে দিয়ে সুখী হওয়ার একমাত্র পথ। এ কারণে সুখের সংজ্ঞা দেয়াটা কঠিন কাজ। তাই রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী তাঁর প্রবন্ধের শেষ প্রান্তে এসে স্পষ্ট করে সুখের সংজ্ঞা প্রদান করেন। তিনি লিখেছেন, সুখ হয় একটি অলীক বস্তু। ধনী লোকের কাছে কারী কারী টাকা থাকলেও তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তিনি সুখী কিনা- তবে এর উত্তর নিশ্চিত হবে যে, তিনি সুখী নয়। আবার দরিদ্র ব্যক্তিকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে তিনি সুখী কিনা- তবে তিনি বলবেন- অর্থাভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা মিটাতে পারেন না বলে তিনি সুখী নয়। অতএব সুখের নির্দিষ্ট কোন আঙ্গিক নেই। যে ব্যক্তি যা পেয়ে নিজকে সুখী মনে করে সেই ব্যক্তিই সুখী। এই সুখী মনে করাটা দরিদ্র ব্যক্তিও হতে পারে। আবার ধনী ব্যক্তিও হতে পারে।
২০২০ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এশিয়ার ৩০টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে সুখী দেশের একটি ধারাবাহিক তালিকা তৈরি করে। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ২৬তম। এডিবি আরো বলেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। চীন, ভারত ও মালদ্বীপের পরেই সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হবে বাংলাদেশে। তাতে এশিয়ার প্রবৃদ্ধিতে ৪র্থ শীর্ষ দেশ হবে বাংলাদেশ। কিন্তু উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেও তাতে বাংলাদেশের নাগরিকেরা ভালো থাকতে পারছে না। এডিবি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০২০’- প্রকাশ করেছে। সেখানে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসের পাশাপাশি ভালো থাকার তথা সুখী হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। এডিবি মনে করে যে, শারীরিক ও মানসিকভাবে ভালো থাকার জন্য একটি অর্থনীতি আছে। ভালো থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের ভোক্তা পণ্যের বাজারে আছে। এমন কি পর্যটন খাতও ভালো থাকার অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত। ২০১৮ সালের হিসেবে, ভালো থাকার অর্থনীতির আকার প্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি ডলারের। এশিয়ার মোট জিডিপির ১০ শতাংশ খরচ হয় ভালো থাকার জন্য। এত প্রবৃদ্ধির পরও বাংলাদেশের মানুষের সুখ তুলনামূলক কম। অবশ্য এর পিছনে কয়েকটি কারণ আছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, প্রবৃদ্ধির সুফল বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তুলনামূলক কম পাচ্ছে। বরঞ্চ বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা বিশাল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিভিন্নভাবে সরকারি সহায়তা পেলেও উপার্জনের সুযোগ তাদের বাড়ছে না। তারা খেয়ে পড়ে কোন রকমে জীবন নির্ধারণ করলেও ক্রয়ক্ষমতা তাদের বাড়ছে না। তারা জীবন ধারণের জন্য অন্ন গ্রহণ করলেও তা ক্রমাগত পরিমাণে স্বল্প হয়ে আসছে। কার্ল মার্ঙের ভাষায় বলা যায়, এ বিশাল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পূর্বের ন্যায় দৈনিক সমপরিমাণ রুটি গ্রহণ করলেও তা দিন দিন পাতলা হয়ে আসছে। ২০১০ সালের পর প্রবৃদ্ধি বাড়লেও বৈষম্য বেড়েছে অধিক হারে। প্রবৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষ কম পাওয়ায় তাদের ভাল থাকার সক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এতই অস্বচ্ছ যে, দুর্বৃত্তায়ন শুধুমাত্র রাজনৈতিক অঙ্গনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরে এসে সেই সব রাজনৈতিক ব্যক্তিরা প্রভাব খাটিয়ে অর্থনীতির অন্যান্য শাখাকেও করেছে কলুষিত। ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জন্য তাঁরা রাজনীতি করলেও বাস্তবে এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা কেউ চিন্তা করে না। ফলে তাদের ক্রয়ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায় না। এ কারণে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও দারিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। ফলে সুখ প্রাপ্তির চিন্তাধারা থেকে তাঁরা বহুদূরে অবস্থান করছে।
করোনা পরবর্তী বাংলাদেশের মানুষ করোনাভীতি কাটিয়ে শামিল হচ্ছে জীবিকার মিছিলে। আর সরকারের নিষেধাজ্ঞা শিথিলের কারণে ক্রমেই গতি ফিরছে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা বাণিজ্যে। নেতিবাচক ধারায় চলে যাওয়া রপ্তানি খাতও নতুন বছরে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। পুঁজিবাজারেও চাঙ্গাভাব দেখা দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও শক্ত অবস্থানে আছে। করোনা অর্থনীতির নানা খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও কৃষি তুলনামূলক শক্ত অবস্থানে রয়েছে। ২০২০ সালের শুধুমাত্র জুলাই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ২৬০ কোটি ডলার। এ মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩৯১ কোটি ডলার। রপ্তানি প্রবৃদ্ধির পরিমাণ হয় ৫৯ শতাংশ। এ সময়ে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ হয় ৩৭.২৮৭ বিলিয়ন ডলার। পুঁজির বাজার মূলধন বেড়েছে ১৩ হাজার ৭৬৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। লেনদেনের সূচক বেড়েছে ২২৫ পয়েন্ট।
করোনাকালীন অবস্থায়ও বাংলাদেশে অর্থনীতির অগ্রগতি ক্রমবর্ধমান। অথচ ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিতে সুখের পরিমাপও উর্ধ্বমুখী হবার কথা ছিল। কিন্তু তা হচ্ছে না। বর্তমান সময়ে যদি সম্পদের বৈষম্য কমানো যায়, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন হ্রাস করা যায়, সর্বপরি বিশাল জনগোষ্ঠীর শারীরিক ও মানসিক চাপ কমানো যায়, তবে ভালো থাকার সক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব হবে। সুখের মাত্রাও বৃদ্ধি পাবে।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।